বাংলাদেশে করোনা, লকডাউন ও শ্রমজীবী মানুষের ভোগান্তি

বাংলাদেশি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং বা সানেম -এর এক জরিপে বলা হয়েছে চলমান করোনা মহামারীর কারণে বাংলাদেশের সার্বিক দারিদ্র্যের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ শতাংশ।
লকডাউনে বাংলাদেশ
লকডাউনে বাংলাদেশনিজস্ব চিত্র
Published on

সম্প্রতী বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের (কোভিড-১৯) ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়া নিয়ে নতুন করে লকডাউন দেয়া হয়েছে। গত ২৭ জুন প্রথম দফায় সারাদেশের সাথে রাজধানী ঢাকার গণ-পরিবহণ যোগাযোগ বন্ধ করা হয়। এরপর জুলাই মাসের ০৫ তারিখ থেকে সারাদেশে কঠোর লকডাউন ঘোষণা করা হয়। লকডাউন কার্যকর করতে মাঠে সেনাবাহিনী নামানো হয় এবং ভ্রাম্যমান আদালয়ের মাধ্যমে সারাদেশের বাইরে বের হওয়ার দায়ে বা দোকানপাঠ, ছোট ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান খোলার দায়ে জরিমানা করা হয়। গত ১৫ তারিখে ইদ উপলক্ষে লকডাউন তোলে নেয়া হয় এবং স্বাস্থ্য বিধি মেনে সারাদেশের সবকিছু সচলের ঘোষণা দেয়া হয়। এবার গত ২৩ তারিখ শুক্রবার ভোর ৬টা থেকে আগামী ০৪ আগস্ট পর্যন্ত দ্বিতীয় দফায় সারাদেশে কঠোর লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে।

বর্তমানে বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি ও লকডাউনে শ্রমজীবী মানুষের দুর্দশা চরমে পৌঁছেছে। বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ রোধে দেয়া লকডাউনে সবচেয়ে ভোগান্তি ও অর্থনৈতিক ক্ষতির শিকার হয়েছে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের খেটে খাওয়া মানুষ।

নিজস্ব চিত্র
বাংলাদেশি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং বা সানেম এর এক জরিপে বলা হয়েছে চলমান করোনা মহামারীর কারণে বাংলাদেশের সার্বিক দারিদ্র্যের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ শতাংশ।

সরকারি হিসেব অনুযায়ী ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার ছিল ২০.৫ শতাংশ। আরেক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি (সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ) তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে মহামারীর সময়ে দেশের সাড়ে ৩ লাখ গার্মেন্টস শ্রমিক চাকরি চ্যুত হয়েছে। যা এই খাতের মোট শ্রমিকের ১৪ শতাংশ। (সূত্র : ২৫ জানুয়ারি, ২০২১, voabangla.com) আন্তর্জাতিক সংগঠন আইএলও হিসাবের গত বছর প্রায় ১৬ লাখ তরুণ গত বছর চাকরি হারিয়েছিল। তাদের বড় অংশ এখনও কাজে ফিরতে পারেনি। গত বছর ১১ শতাংশ দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ কমেছে এবং ৪৪ শতাংশ ক্ষুদ্র ও ছোট ফার্ম তাদের প্রায় ৫০ শতাংশ কর্মী ছাঁটাই করেছে।

অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবসায়ীদের জন্য যে অনুদান দেওয়া হয়েছে তা ৮৩ শতাংশ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা পায়নি। চামড়া, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, ট্রেডিং, টেক্সটাইল, কৃষি, প্যাকেজিংসহ বিভিন্ন খাতের উদ্যোক্তাদের মধ্যে চালানো এক জপিরে তথ্য বলছে, ৬৯ শতাংশ উদ্যোক্তা করোনার কারণে কর্মচারীদের বেতন ও অফিস খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট-বিল্ড এর জরিপ মতে, ৮৬ শতাংশ ব্যবসায়ী জানিয়েছে করোনায় তাদের বিক্রি কমে গেছে। ৯৫ শতাংশ জানিয়েছে করোনার আগের তুলনায় তাদের পণ্যের চাহিদাও কমে গেছে। এদের মধ্যে ৬১ শতাংশ মনে করে তাদের আয় চলতি বছর আরও কমে যাবে। (সূত্র : ২৪ জুন, ২০২১, newsbangla24.com)

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) তথ্যমতে, দেশের ১৬ কোটি মানুষের ৪ কোটি পরিবারের মধ্যে নিম্নবিত্ত ২০ শতাংশ; উচ্চবিত্ত ২০ শতাংশ আর বাকি ৬০ শতাংশ হচ্ছে নিম্ন, মধ্য ও উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবার। বৃহৎ সংখ্যার এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে সরকারি চাকরিজীবী, বহুজাতিক ও বড় কোম্পানিতে কাজ করা কিছু মানুষ বাদে অন্যরা সবাই পেশাগত ও উপার্জনগত সংকটে আছে। উক্ত জনগোষ্ঠীর বড় অংশই পেশাগত ঝুঁকিতে আছে। এদের মধ্যে অনেকের চাকরি থাকলেও বেতন দেওয়া হচ্ছে না। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ফলে বেতন তো পাচ্ছেই না উল্টো চাকরির ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) গত ৫ মে থেকে ২৯ মে পর্যন্ত অনলাইনে ২৯ হাজার ৯০৯ জনের ওপরে একটি জরিপ চালায়।

জরিপ থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, ফরমাল সেক্টরে কাজ করা ১৩ শতাংশ মানুষ চাকরি হারিয়েছে। ১১ হাজার টাকার কম আয়ের ৫৬ দশমিক ৮৯ শতাংশ পরিবারের আয় বন্ধ হয়ে গেছে এবং ৩২ শতাংশ মানুষের আয় কমে গেছে। ১৫ হাজার টাকা আয়কারী ২৩ দশমিক ২ শতাংশের আয় পুরো বন্ধ হয়ে গেছে এবং ৪৭ দশমিক ২৬ শতাংশের আয় কমে গেছে। ৩০ হাজার টাকার বেশি আয়কারী ৩৯ দশমিক ৪ শতাংশের কমেছে এবং ৬ দশমিক ৪৬ শতাংশের আয় বন্ধ হয়ে গেছে।

নিজস্ব চিত্র

উপরোল্লেখিত বর্ণনা থেকে খুব সহজেই অনুমেয় যে, করোনায় বাংলাদেশের অর্থনীতি ও জনজীবন কতটা বিধ্বস্ত হয়েছে। সেই পরিস্থিতিতে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট মোকাবেলায় নতুন করে যে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে তা আরও নির্মম হয়ে উঠেছে। মানুষ ইদের ছুটিতে বাড়িতে এসেছে। রাজধানী ঢাকাসহ সবগুলো জেলা শহর ছেড়ে মানুষ গ্রামে এসেছে। ইদেও একদিন পর তথা গত ২৩ তারিখে যখন নতুন করে সারাদেশের লকডাউন (সরকারির নাম বিধি নিষেধ) ঘোষণা করা হয়েছে তখন সাধারণ মানুষ জীবিকার টানে চাকরি বাঁচাতে বিধি নিষেধ উপেক্ষা করে পণ্য-পরিবহনের গাড়িতে করে ঢাকায় ও অন্যান্য শহরে নিজের কর্মস্থলে ফিরছে।

এর ফলে একদিকে যেমন তাদের স্বাস্থ্য বিধি উপেক্ষিত হয়েছে অন্যদিকে তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভ্রমণ করছে। এছাড়াও নিম্নবিত্তের শ্রমজীবি মানুষের জন্য খাদ্যের ব্যবস্থা না করে লকডাউন দেয়া হলে সাধারণ মানুষ ক্ষুধার তাড়নায় লকডাউন ও জরিমানর ভয় উপেক্ষা করে রাস্তায় বের হচ্ছে। এর ফলে হয়েছে একদিক যেমন কার্যকর লকডাউন বাস্তবায়ন করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে অন্যদিকে শ্রমজীবি মানুষের অর্থনৈতিক দুর্দশা আরও চরমে পৌঁছেছে।

লকডাউনের ফলে ইদের ছুটিতে যারা কর্মস্থল ছেড়ে বাড়িতে এসেছিল তারা সবচেয়ে দুর্ভোগে পরেছে। কারণ কর্মস্থলের ছুটি শেষ হয়ে গেছে কিন্তু লকডাউনে গণ-পরিবহন বন্ধ থাকার ফলে তারা কর্মস্থলে পৌঁছাতে পারছে না। চাকরি বাঁচাতে তারা বাধ্য হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কর্মস্থলের দিকে ছুটছে। এর আগে ইদ যাত্রার সময়ও দেখা গেছে টানা লকডাউনে রাখার পর ইদ যাত্রা উপলক্ষে সব বিধি নিষেধ তুলে দেয়া হয়েছে। যার ফলে লকডাউনের সময়ে মানুষ যেভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেছে সব ধরণের বিধি নিষেধ তুলে দেয়ার ফলে তা আর মান্য করা হয়নি। ফলত লকডাউনের যে সুফল তা পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় এভাবেই সমন্বয়হীনতা চলছে।

স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in