৮ নভেম্বর, ২০১৬। রাত আটটায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আচমকা নাটকীয় ঘোষণায় মাত্র ৪ ঘণ্টার মধ্যে দেশে বাতিল হয়ে গেছিলো ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট। দেশ থেকে কালো টাকা উদ্ধার, জাল নোটের ব্যবহার বন্ধ করা, সন্ত্রাসবাদের কোমর ভেঙে দেওয়া, ডিজিটাল লেনদেনে উৎসাহ বাড়ানো সহ একাধিক ঘোষণা ছিলো পাঁচ বছর আগের রাত ৮টার ঘোষণায়। প্রধানমন্ত্রীর এক ঘোষণায় বাতিল হয়ে গেছিলো বাজারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দেশের প্রায় ৮৬ শতাংশ কারেন্সি নোট। ঠিক পাঁচ বছর পূর্ণ করার পর এখনও সেই ক্ষত পূরণ হয়েছে কি?
রিজার্ভ ব্যাঙ্ক-এর তথ্য অনুসারে, বাজারে থাকা ৫০০ এবং ১০০০ টাকার ১৫.৪১ লক্ষ কোটি কারেন্সি নোটের মধ্যে ১৫.৩১ লক্ষ কারেন্সি নোটই নোটবাতিল পরবর্তী সময়ে জমা পড়ে সরকারের ঘরে।
নোট বাতিলের প্রধান উদ্দেশ্য হিসেবে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের পক্ষ থেকে যে কথা সামনে আনা হয়েছিলো তা ছিলো কালো টাকা উদ্ধার। যদিও নোটবাতিলের কয়েক মাসের মধ্যেই রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে যে তথ্য সামনে আসে তাতে প্রমাণ হয়ে যায় সেই প্রধান উদ্দেশ্যের ব্যর্থতা। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক-এর তথ্য অনুসারে, বাজারে থাকা ৫০০ এবং ১০০০ টাকার ১৫.৪১ লক্ষ কোটি কারেন্সি নোটের মধ্যে ১৫.৩১ লক্ষ কারেন্সি নোটই নোটবাতিল পরবর্তী সময়ে জমা পড়ে সরকারের ঘরে। যা প্রায় ৯৯.৯ শতাংশ। অর্থাৎ, নোট বাতিল করে কোনো কালো টাকাই উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি তা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্যতেই স্পষ্ট।
নোটবাতিলের সময় জানানো হয়েছিলো, বাজারে নতুন যে নোট আনা হবে তা জাল করা সম্ভব হবেনা। সেইসময় কোনো কোনো মিডিয়া চ্যানেল এবং তাঁদের সাংবাদিকরা ২০০০ টাকার নোটে মাইক্রোচিপ আছে বলে ফলাও করে প্রচার করেছিলেন। তথ্য বিকৃতি অথবা ভুয়ো তথ্য প্রচারের জন্য সেই সাংবাদিক কিংবা মিডিয়া চ্যানেলের কোনো শাস্তি হয়েছে বলে শোনা যায়নি। ইউটিউবে খুঁজলে এখনও সেই ভিডিও পাওয়া যাবে।
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্য অনুসারে, ২০১৬ সাল – অর্থাৎ নোটবাতিলের বছরে ৬.৩২ লক্ষ জাল টাকা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিলো। নোটবাতিলের সময় থেকে পরবর্তী চার বছর, অর্থাৎ ২০২০ সাল পর্যন্ত জাল কারেন্সি নোট উদ্ধার হয়েছে ১৮.৮৭ লক্ষ।
নোটবাতিলের পাঁচ বছর পর জাল টাকার কী অবস্থা একবার জেনে নেওয়া যেতেই পারে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্য অনুসারে, ২০১৬ সাল – অর্থাৎ নোটবাতিলের বছরে ৬.৩২ লক্ষ জাল টাকা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিলো। নোটবাতিলের সময় থেকে পরবর্তী চার বছর, অর্থাৎ ২০২০ সাল পর্যন্ত জাল কারেন্সি নোট উদ্ধার হয়েছে ১৮.৮৭ লক্ষ। এনসিআরবি রিপোর্ট অনুসারে, শুধুমাত্র ২০২০ সালে জাল নোট বা ফেক ইন্ডিয়ান কারেন্সি নোটস (এফআইসিএন) উদ্ধার হয়েছে ৮,৩৪,৯৪৭টি। অর্থমূল্যে যার পরিমাণ ৯২ কোটি টাকা। সবথেকে বেশি জাল নোট উদ্ধার হয়েছে মহারাষ্ট্রে – ৬,৯৯,৪৯৫টি। এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গে ২৪,২২৭টি, গুজরাটে ২০,৩৬০টি, অন্ধ্রপ্রদেশে ১৭,৭০৫টি এবং উত্তরপ্রদেশে ১৭,০৭৮টি জাল নোট উদ্ধার করা হয়েছে শুধুমাত্র ২০২০তে। ২০১৯-এ জাল নোট উদ্ধার হয়েছিলো ২,৮৭,৪০৪টি। যার মূল্য ২৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ মাত্র ১ বছরের মধ্যে জাল নোট উদ্ধার বেড়েছে ১৯০.৫ শতাংশ। উল্লেখযোগ্যভাবে মহামারীর সময় জাল নোটের ব্যবহার বেড়েছে। ২০২০ সালে জাল নোট সংক্রান্ত ৩৮৫ টি মামলা দায়ের হয়েছে। মোট অভিযুক্ত ৬৩৩ জন।
আরবিআই-এর তথ্য অনুসারে, ২০২০ সালে দেশে যত জাল নোট উদ্ধার হয়েছে তার মধ্যে ২,৪৪,৮৩৪টি ২০০০ টাকার নোট, ২,০৯,৬৮৫টি নতুন ৫০০ টাকার নোট, ৮৫৯৯টি ৫০ টাকার নতুন নোট। এইসময়েই বেশ কিছু পুরোনো হাজার টাকার জাল নোট উদ্ধার হয়েছে। অর্থাৎ, নতুন কারেন্সি নোট সহজে জাল করা যাবেনা – কেন্দ্রের এই দাবিও ধোপে টেকেনা।
আরবিআই-এর তথ্য অনুসারে, ২০২০ সালে দেশে যত জাল নোট উদ্ধার হয়েছে তার মধ্যে ২,৪৪,৮৩৪টি ২০০০ টাকার নোট, ২,০৯,৬৮৫টি নতুন ৫০০ টাকার নোট, ৮৫৯৯টি ৫০ টাকার নতুন নোট।
পাঁচ বছর আগের নোটবাতিলের সময় কেন্দ্রের পক্ষ থেকে যা যা দাবি করা হয়েছিলো, তার একটাও যে কার্যকরী হয়নি তা বিগত পাঁচ বছরে স্পষ্ট হয়ে গেছে। যদিও এই নোটবাতিলের ফলে দেশের অর্থনীতি যে অনেকটাই পিছিয়ে গেছে তা বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে উঠে এসেছে।
দেশের বাজার থেকে আচমকা প্রায় ৮৫ শতাংশ কারেন্সি নোট বাতিল করে দেওয়া এবং সময়মত সেই নগদ টাকার যোগান না থাকার কারণে চরম ক্ষতির মুখে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। বিশেষ করে দেশের অসংগঠিত ক্ষেত্র। যেখানে দেশের মোট কর্মীবাহিনীর প্রায় ৯৪ শতাংশ যুক্ত। শুধুমাত্র সরকারি পরিসংখ্যান দিয়ে যে ক্ষতির মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। কারণ, অধিকাংশ অসংগঠিত ক্ষেত্রের হিসাবনিকাশই সরকারি খাতায় নথিভুক্ত হয়না। নগদ টাকার যোগানে ঘাটতির কারণে এই ধরণের বহু ছোটো সংস্থা ঝাঁপ বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। ফলে কর্মহীন হয়েছেন বহু মানুষ।
আরবিআই-এর প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন জানিয়েছিলেন, তিনি কখনই নোটবাতিল সমর্থন করেননি। এই প্রসঙ্গিত এক আরটিআই-এর উত্তর থেকে জানা গেছে আরবিআই বোর্ড কালো টাকা আটকাতে নোটবাতিলের পদক্ষেপকে সমর্থন করেনি।
আরবিআই-এর প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন জানিয়েছিলেন, তিনি কখনই নোটবাতিল সমর্থন করেননি। এই প্রসঙ্গিত এক আরটিআই-এর উত্তর থেকে জানা গেছে আরবিআই বোর্ড কালো টাকা আটকাতে নোটবাতিলের পদক্ষেপকে সমর্থন করেনি। নিজেদের ৫৬১তম অধিবেশনে বোর্ড জানিয়েছিলো, অধিকাংশ কালো টাকাই কারেন্সি নোট-এ থাকেনা। যা আসলে লুকিয়ে থাকে সোনা, রিয়েল এস্টেট জাতীয় বিভিন্ন সম্পদের মধ্যে। তাই এই পদক্ষেপে কালো টাকা উদ্ধার করা সম্ভব হবেনা।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন