দেশের বিভিন্ন বাজারে দরদাম করে জিনিস কেনার একটা চল আছে। যেখানে বিক্রেতারা জানেন ক্রেতারা দরদাম করবেন। আবার ক্রেতারাও জানেন বিক্রেতারা দাম বাড়িয়ে রেখে দরদাম করলেই দাম কিছুটা কমাবে। তাই বিক্রেতারা দাম বাড়িয়েই বলেন। ক্রেতা কমান। দামাদামি শেষে ক্রেতা কিছুটা কমে কিনতে পেরে খুশি। আর বিক্রেতা তো আগেই দাম বাড়িয়ে রেখেছিলেন। তাই তাঁর লাভের খুব একটা হেরফের হয়না। কলকাতার ধর্মতলা, গড়িয়াহাট, হাতিবাগানে এই দামাদামি রোজই চলে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় এই ধরণের বাজার আছে। সেখানেও দামাদামি করে জিনিস কেনা হয়।
বর্তমানে পেট্রোল ডিজেল থেকে সেন্ট্রাল এক্সাইজ ডিউটি কমানোটা অনেকটা সেরকমই প্রায়। গত কয়েক বছরে ধাপে ধাপে পেট্রোলে সেন্ট্রাল এক্সাইজ ডিউটি ৩৩ টাকা বাড়িয়ে দেওয়ালি উপহারের(!) নামে কমানো হল ৫ টাকা এবং ডিজেলে প্রায় ৩২ টাকা বাড়িয়ে কমানো হল ১০ টাকা। তবে সাধারণ মানুষ যত না একে দেওয়ালি উপহার বলেছেন তার থেকে বেশি বলেছে একশ্রেণির মিডিয়া। উল্লাস তাদেরই বেশি। আসুন একটু দেখে নি গল্পের আড়ালে থাকা গল্প।
গত বছরের ১ এপ্রিল দেশের চার মেট্রো শহরে পেট্রোলের দাম ছিলো ৭৫টাকা বা তার কম। ওইসময় মুম্বাইতে পেট্রোলের লিটার ছিলো ৭৫.২৮, দিল্লিতে ৬৯.৫৯, চেন্নাইতে ৭২.২৮ এবং কলকাতায় ৭২.২৭ টাকা। একই দিনে দেশের চার মহানগরী মুম্বাই, দিল্লি, চেন্নাই এবং কলকাতায় ডিজেলের দাম ছিলো ৬৫.১৯, ৬২.২৯, ৬৫.৭১ এবং ৬৪.৬০ টাকা।
এর ঠিক ১ বছর ২ মাস বাদে গত জুন মাসে দেশের চার মহানগরী মুম্বাই, দিল্লি, চেন্নাই এবং কলকাতায় পেট্রোল ও ডিজেলের দাম ছিলো যথাক্রমে ১০০.৭২, ৯৪.৪৯, ৯৫.৯৯ এবং ৯৪.৫০ টাকা। ডিজেলের দাম ছিলো ৯২.৬৯, ৮৫.৩৮, ৯০.১২ এবং ৮৮.২৩ টাকা।
এই বছরের জুন মাসে পেট্রোল ডিজেলের দাম বাড়ে ১৬ বার এবং ১ জুলাই দেশে পেট্রোল ডিজেলের দাম দাঁড়ায় ১০৪.৯০ (মুম্বাই), ৯৮.৮১ (দিল্লি), ৯৯.৮০ (চেন্নাই) এবং ৯৮.৬৪ টাকা (কলকাতা)। ডিজেলের ক্ষেত্রে ৯৬.৭২ (মুম্বাই), ৮৯.১৮ (দিল্লি), ৯৩.৭২ (চেন্নাই) এবং ৯২.০৩ টাকা (কলকাতা)।
অর্থাৎ শেষ ১৫ মাসে দেশে পেট্রোল ও ডিজেলের দাম বেড়েছিলো ২৯.৬২ (মুম্বাই), ২৯.২২ (দিল্লি), ২৭.৫২ (চেন্নাই) এবং ২৬.৩৭ (কলকাতা) এবং ডিজেলের ক্ষেত্রে ৩১.৫৩ (মুম্বাই), ২৬.৮৯ (দিল্লি), ২৮.০১ (চেন্নাই) এবং ২৭.৪৩ টাকা (কলকাতা)।
১লা জুলাই থেকে ৩১জুলাই-এর মধ্যে কলকাতায় পেট্রোলের দাম বাড়ে ৩.৩৭%। লিটারে বাড়ে ৩.৪৪ টাকা। আগস্টে সামান্য দাম কমার পর সেপ্টেম্বরে আবারও বেড়ে ৩০ সেপ্টেম্বর দাম দাঁড়ায় ১০২.১৭ টাকা। অর্থাৎ সেপ্টেম্বর মাসে দাম বৃদ্ধি হয় ৪৫ পয়সা। অক্টোবর মাসে মোট দাম বাড়ে ৬.৬৭%। ৩১ দিনে লিটারে পেট্রোলের দাম বাড়ে ৭.৩২ টাকা।
গত বছরের ১লা এপ্রিল থেকে এবছরের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত দেশে গড়ে পেট্রোলের দাম বেড়েছে প্রতি লিটারে (২৭.৪৩ + ৩.৪৪ + .৪৫ + ৭.৩২) ৩৮.৬৪ টাকা (কলকাতার হিসেব অনুসারে)।
২০২০-২১ আর্থিক বছরে কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যে সেন্ট্রাল এক্সাইজ ডিউটি বাবদ আদায় করেছে ৩.৪৪ লক্ষ কোটি টাকা। ২০১৭ সালে যে পেট্রোল এবং ডিজেলে লিটার পিছু সেন্ট্রাল এক্সাইজ ডিউটি ছিলো ১৯.৪৮ এবং ১৫.৩৩ টাকা, ধাপে ধাপে বেড়ে ফেব্রুয়ারি ২০২১ থেকে তা ছিলো ৩২.৯০ এবং ৩১.৮০। এর আগে ২০১৭ থেকে ২০২১-এর মধ্যে কেন্দ্রীয় এক্সাইজ ডিউটি বাড়ানো হয়েছে ৭ বার। গত ৩ তারিখ পেট্রোল ও ডিজেলে ৫ এবং ১০ টাকা কমানোর পর বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ২৭.৯০ এবং ২১.৮০।
২০১৭ থেকে ৪ বছরে ৭ দফায় মোট এক্সাইজ ডিউটি বেড়েছিলো – ১৩.৪২ এবং ডিজেলে ১৬.৪৭ টাকা। ২০১৮-১৯ সালে শুধুমাত্র পেট্রোলে কেন্দ্রীয় এক্সাইজ ডিউটি বাবদ আদায় ৬৮,৯২৯ কোটি টাকা, ২০১৯-২০তে ৬৬,২৭৯ কোটি টাকা এবং ২০২০-২১-এ ১,০১,৫৯৮ কোটি টাকা। ডিজেলে ২০১৮-১৯-এ ১,৪৪,৪৭১ কোটি টাকা, ২০১৯-২০ তে ১,১২,০৩২ কোটি টাকা এবং ২০২০-২১ এ ২,৩৩,২৯৬ কোটি টাকা।
এরকম ভেবে নেবার কোনো কারণ নেই যে পেট্রোল ডিজেলের দাম আর বাড়বে না। বাড়বে তো বটেই। কাল না হোক পরশু। সাম্প্রতিক বিধানসভা এবং লোকসভা উপনির্বাচনে বিজেপির প্রায় ভরাডুবি না হলে আচমকা এই তথাকথিত দেওয়ালি উপহার (!) মানুষ পেতেন কিনা সে প্রশ্ন থেকেই যায়। সেন্ট্রাল এক্সাইজ ডিউটি কম করার এই যে পদক্ষেপ তা কতটা মানুষের ওপর থেকে আর্থিক বোঝা কমানোর জন্য আর কতটা আগামী বছরের শুরুতে পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের দিকে লক্ষ্য রেখে সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন