'নুইসেন্স ভ্যালু' বলে একটা প্রপঞ্চ আছে। এই প্রপঞ্চটি ব্যবহার হয় কোনো ক্ষেত্রে জনদৃষ্টি ভিন্ন খাতে বেহুদা কথা-বার্তা আলোচনার দিকে ঠেলে দিতে দারুণ কার্যকর পন্থা। এই কাজটা রাজনীতিবিদরা প্রায়শই করেন। বাংলাদেশেও হরহামেশা এই ধরনের কাজ হয়।
সম্প্রতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে তেমন এক ‘নুইসেন্স ভ্যালু’ মার্কা বক্তব্য মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। জাতীয় সংসদে ক্ষমতাসীন দলের জোট সঙ্গী জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দরে (জাসদ-ইনু) সভাপতি সংসদ সদস্য হাসানুল হক ইনু কর্তৃক যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণের দ্বীপ সেন্টমার্টিন দাবি করে মর্মে যে বক্তব্য সেটা পলিটিক্যাল 'নুইসেন্স ভ্যালু' থেকেই দেয়া। এটা আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। এই দৃঢ় বিশ্বাসের পেছনের কিছু কথা তুলে ধরার প্রয়াস থেকেই এই লেখা।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২১ জুন এক সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন তুলেছেন, বিএনপি কী যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সেন্টমার্টিন দ্বীপ লিজ দিয়ে ক্ষমতায় আসতে চায়? প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের জুতসই জবাব দিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে নিরেট পলিটিক্যাল কৌশল বলেছেন। হ্যাঁ, এটা একদমই পলিটিক্যাল কৌশল আর এই কৌশলের নাম হচ্ছে 'নুইসেন্স ভ্যালু' বক্তব্য।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর রাজনৈতিক পাড়ায় বেশ হৈচৈ শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক দল, বুদ্ধিজীবী মহল ও সংবাদপত্রগুলো এই বক্তব্যের পিছনে ছুটছে। এমন এক বক্তব্য নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, যেটা নিরেট অবান্তর আলাপ ছাড়া বিশেষ কিছু না। এই বক্তব্য বাস্তব ভিত্তি শূন্য হলেও সাধারণ জনমনে এর প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব আছে। সেটা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ আমাদের দেশের গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চল লিজ দিতে চাচ্ছে না বলে যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান বাংলাদেশ সরকারকে ক্ষমতায় দেখতে চাচ্ছে না।
দেশপ্রেমের মারাত্মক প্রলেপ লেগেছে ভিত্তিহীন এই বক্তব্যে। ফলে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা, দেশপ্রেম ও আওয়ামী লীগ মিলেমিশে একাকার করে ফেলার মতো পরিস্থিতিও সৃষ্টি হয়েছে। গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মুক্তিযুদ্ধ, দেশপ্রেম, রাষ্ট্র, সরকার সবকিছুর মিশ্রণ ঘটিয়ে ফেলেছে। কেউ আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করে মানে সে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী মানুষ - এমনটাই প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে। সেন্টমার্টিন লিজ দেয়া নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ভিত্তিহীন বক্তব্য দেয়ার লক্ষ্যও একই। আর সরকারি প্রোপাগাণ্ডার মেশিনগুলো প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে অনেকদূর টেনে নিয়ে যাবে। এইটা হলো ভিত্তিহীন এই বক্তব্যের সুফল।
শেখ হাসিনার এই বক্তব্য যে ভিত্তিহীন তার স্বীকারোক্তি বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের বক্তব্য। গত ২৫ জুন ঢাকায় ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে কূটনৈতিক সংবাদদাতাদের সংগঠন ডিপ্লোম্যাটিক করেসপনডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (ডিক্যাব) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, ‘আমার জানা মতে কেউ চায়নি।’ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর এই বক্তব্য থেকে একেবারেই স্পষ্ট যে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ওদের
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র কী আসলেই সেন্টমার্টিন দ্বীপ লিজ চায়? এর জবাবও বাংলাদেশে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসের পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে। তারা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশের কাছে তারা এমন কোনো দাবি করেনি। মার্কিন দূতাবাসের এমন স্পষ্ট বক্তব্য সরকারি প্রোপাগাণ্ডা ভিত্তিকে আরো ভিত্তিহীন করেছে।
ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে আমেরিকা কর্তৃক সেন্টমার্টিন দ্বীপ লিজ চাওয়ার দাবি যে একেবারেই অসার তার একটু বুদ্ধি খাটালেও বুঝা যায়। প্রথম কথা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোনো দেশে ভূ-খণ্ড লিজ বা ঘাটি স্থাপনের জন্য দাবি করা হলে সেই দাবি নিয়ে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা হয়। আলোচনার বিষয়ও তারা অনেক সময় জনসম্মুখে প্রকাশ করে। এছাড়া এই ধরনের চুক্তি কোনো মৌখিক লেনদেন নয়। তাই সুনির্দিষ্ট শর্ত উল্লেখ করে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
সেন্টমার্টিন ইস্যুতে বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের এমন কোনো আলোচনায়ই হয়নি। এছাড়া আমেরিকা সেন্টমার্টিন দ্বীপ লিজ চায় বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এমন দাবি করা হলেও কবে কোন দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় এমন প্রস্তাব দিয়েছে তা বলছে না। তাহলে এই বক্তব্যের ভিত্তি কী? এমন প্রশ্নের কোনো সদুত্তর সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া হয়নি। ফলে তাদের কথাতেই প্রমাণ হয় যে এটা নিরেট রাজনৈতিক কৌশল ও ভিত্তিহীন আলোচনা মাঠে ছাড়া হয়েছে। তাই এই বক্তব্য সরকারি মিথ্যা প্রোপ্রাগাণ্ডা ছাড়া আর কিছু নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বা পরাশক্তি দেশগুলো কাছে সেন্টমার্টিন দ্বীপের কৌশলগত গুরুত্ব থাকতে পারে। গুরুত্ব আছেও বলতে হয়। কিন্তু লক্ষণীয় যে, এই দ্বীপটি যে কোনো সময় ডুবে যাওয়ার শঙ্কা করা হচ্ছে। ফলে ডুবে যাওয়ার শঙ্কাপূর্ণ একটি দ্বীপ লিজ নিয়ে তারা ঘাঁটি করতে যাবে কেনো? বলতে পারেন যারা কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে তারা চাইলে এই দ্বীপকে ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা করাও সম্ভব হতে পারে। বা এমনও হতে পারে যে দ্বীপ ডুবে গেলে তারা সেখানে সামরিক জাহাজ এনে ঘাঁটি করবে। দ্বীপ ডুবে যাওয়ার এই আলাপ একেবারেই ভূতাত্ত্বিক। আমি সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কেউ না। কিন্তু কমন সেন্স থেকে যা বুঝি তা হচ্ছে, তারা তো জাহাজ এনে বা নয়া দ্বীপ তৈরি করেও ঘাঁটি স্থাপনের মতো সামর্থ্য রাখে তাহলে জনবসতিপূর্ণ দ্বীপের লিজ দাবি না করে একটা সামরিক জাহাজ রাখার বা নয়া দ্বীপ সৃষ্টি করার বিষয়ে দাবি জানাতে পারতো না? সেটাই কি বেশি যৌক্তিক হওয়ার কথা নয়?
আসল ঘটনা হচ্ছে এসব কিছুই না। প্রথমেই বলেছি এসব ভিত্তিহীন আলোচনা রাজনৈতিক কৌশলে মাঠে ছাড়া হয়েছে। যার ফলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিক থেকে নজর সরিয়ে দেয়া সম্ভব হয়েছে। সরকার এই কাজটিই করেছে।
অন্যদিকে এই আলাপ তুলে বিএনপির দিকে সরকার আঙ্গুল তুলতে পারছে যে, বিএনপি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সেন্টমার্টিন দ্বীপ লিজ দেয়ার চুক্তি করে ক্ষমতায় আসতে চাচ্ছে। তাই যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান সরকারকে নানা কৌশলে চাপে রাখছে। এই আলাপের মেরিট হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ইস্যুতে যে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সেটাকেও স্বার্থের প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়া সম্ভব হচ্ছে। হ্যাঁ, বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ অবশ্যই আছে। যেমন স্বার্থ আছে চীন-রাশিয়া-ভারতের। যুক্তরাষ্ট্রেরও তেমন স্বার্থ আছে।
আমাদের মনে রাখতে হবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী একক কর্তৃত্ব করেছে। গত প্রায় তিন দশক ধরে বিশ্ব-রাজনীতি এককেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছিল। চীনের উত্থান, রাশিয়ায় পুতিনের উত্থান, তুরস্কে এরদোয়ানের উত্থান এবং এসব দেশের শাসকগোষ্ঠীর মাঝে যুক্তরাষ্ট্র কেন্দ্রীক মাতুব্বরী বিশ্ব ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একাত্মতার ফলে বর্তমানে মাল্টিপোলার (বহু মেরুকেন্দ্রীক বিশ্ব ব্যবস্থা) রুলের সময় শুরু হয়েছে। তাই কোন দেশে কার অবস্থান থাকবে তা নিয়ে প্রতিযোগিতা চলছে। বাংলাদেশের মতো দেশগুলো সেই প্রতিযোগিতার গুটিতে পরিণত হয়েছে। এই মুর্হুতে শক্ত পররাষ্ট্রনীতি ছাড়া বৈশ্বিক মেরুকরণ থেকে নিজেদের নিরাপদ রাখা সম্ভব নয়।
মেরুকরণের এই রাজনীতি থেকে নিজ দেশকে মুক্ত রাখতে হলে দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষের মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। দেশের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক ভিত্তি মজবুত করতে হবে। দেশের মানুষের মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে চলছে একদলীয় কর্তৃত্ববাদী শাসন। দেশে কার্যত্ব গণতন্ত্র ও মানবাধিকার অনুপস্থিত।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এই যে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতির নাজুক দশা সেটারই সুযোগ নিচ্ছে পশ্চিমাসহ বিশ্বের আধিপত্যবাদী দেশগুলো। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয় ইউনিয়ন, চীন, রাশিয়াসহ যে দেশগুলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ক্রীড়ানর হয়ে উঠছে এবং সরাসরি হস্তাক্ষেপ করার মতো কাজ করছে তার সুযোগ বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগই করে দিয়েছে।
ফলে আধিপত্যবাদী দেশগুলো তাদের স্বার্থ হাসিল করতে বাংলাদেশে বিদ্যমান গণতান্ত্রিক পরিস্থিতির উন্নতি এবং মানবাধিকার নিশ্চিত করতে চাপ দিচ্ছে। এই চাপ থেকেই দেশের মানুষের দৃষ্টি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে সরকারের পক্ষ থেকে সেন্টমার্টিন লিজের ভিত্তিহীন বক্তব্য মাঠে ছাড়া হয়েছে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এমন ভিত্তিহীন বক্তব্য আগামীতে আরো ছাড়বে।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন