ভবেন মন্ডল অনেকদিন বিদ্যালয়ে আসছে না। একাদশ শ্রেণীর ছাত্র। খোঁজ নিয়ে জানা গেলো ও ভিন রাজ্যে শ্রমিকের কাজ নিয়ে চলে গেছে। প্রসন্ন মাঝি, আকাশ মন্ডল দশম শ্রেণীতে উঠলেও এবছর মাধ্যমিক পরীক্ষাতে বসার জন্য ফর্ম পূরণ করেনি। প্রসন্ন আলমারি কারখানাতে কাজ নিয়েছে আর আকাশ গ্যারেজে কাজ নিয়েছে। প্রত্যেকের বাড়ি নদীয়ার শান্তিপুর ব্লকের বোয়ালিয়া গ্রামে। ওরা অঞ্জনগড় উচ্চতর বিদ্যালয়ের ছাত্র।
ওই বিদ্যালয়ে এবছরের শিক্ষাবর্ষে নতুন শ্রেণীতে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তির সময় একটি নতুন বৈশিষ্ট্য নজরে এসেছে। ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম শ্রেণীতে অন্য জেলা বা অন্য এলাকা থেকে অনেকে ভর্তি হওয়ার আবেদন করেছে। সাধারণভাবে এটাই চলে আসছে বিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় বসবাসকারী ছাত্র-ছাত্রীরাই ভর্তি হয়। কিন্তু এবার ভিন্ন চিত্র কেন? যারা ভর্তি হতে আসছে তাদের সঙ্গে বাবা বা মা আসেননি। দিদা বা দাদু এসেছে।
কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেল, অনেক দূরের জেলার বিদ্যালয়গুলি থেকে টি.সি নিয়ে যারা দাদু বা দিদার হাত ধরে ভর্তি হতে এসেছে তাদের মা,বাবা দুজনেই কাজে ভিন রাজ্যে চলে গেছে। তাই ছেলে বা মেয়েকে দাদু বা দিদার বাড়িতে রেখে পড়াতে চাইছে।
দেখা যাচ্ছে চতুর্থ ঘন্টার পর পঞ্চম, ষষ্ঠ শ্রেণীতে কিছু ছাত্র বিদ্যালয় থেকে পালিয়ে যাচ্ছে। সাধারণত: উচুঁ ক্লাসের কিছু ছাত্র-ছাত্রীর বিদ্যালয় থেকে পালাবার প্রবণতা থাকে। কিন্তু নীচু ক্লাসে এই প্রবণতা নতুন। সংশ্লিষ্ট ছাত্রদের অভিভাবকদের বিদ্যালয়ে ডাকা হল। যে তথ্য বেরিয়ে এল তাতে চোখ কপালে ওঠার অবস্থা। ঐ বাচ্চা বাচ্চা কিছু ছাত্রকে চতুর্থ ঘন্টার পর মাঝে মাঝে বিদ্যালয় থেকে পালিয়ে যেতে হয় কারণ, ওরা কীর্তনের দলে খোল বাজায়। সারা রাত জেগে এই কীর্তনে ওরা খোল বাজানোর বিনিময়ে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা রোজগার করে পরিবারের হাতে তুলে দেয়। একে শিশুশ্রম ছাড়া আর কী বলা যাবে?
কিছু দিন আগে একটি তথ্য জনসমক্ষে আসার পর অনেকেই চমকে উঠেছেন। এবারে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী কমেছে চার লক্ষ। মাধ্যমিকে ২ লক্ষ ছাত্রছাত্রী রেজিষ্ট্রেশন ফর্ম পূরণ করেও এনরোলমেন্ট ফর্ম পূরণ করেনি। মধ্যশিক্ষা পর্ষদ এর একটি কারণ হিসাবে বলেছে ,গত কয়েকটি বছরে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তির ক্ষেত্রে বয়সের কড়াকড়ি একটি কারণ। যা খুবই দুর্বল যুক্তি।
শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না। কেন এত বিপুল সংখ্যক পরীক্ষার্থী হ্রাস? আসলে একদিকে ক্রমবর্ধমান আর্থিক সংকট আর সরকারের শিক্ষা সংকোচনকারী দৃষ্টিভঙ্গি এর কারণ।
কোভিডের সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি অযৌক্তিক ভাবে দিনের পর দিন বন্ধ। আর কোভিড যে আর্থিক বিপর্যয় ডেকে এনেছে তার ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠাগুলিতে ছাত্র ড্রপ আউট বেড়েছে। আমাদের সরকার কোভিডের সময় মানুষের পাশে না দাঁড়িয়ে করর্পোরেটদের বেপরোয়া পুঁজি বৃদ্ধির ব্যবস্থা করেছে। ২০২০ সালের মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকেই আমাদের রাজ্য সহ গোটা দেশের বিদ্যালয় সহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয় কোভিডের প্রথম অভিঘাতে। ২০২১ সালের প্রথম দিকে উঁচু ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে কিছুদিন ক্লাস শুরু হলেও তা পুনরায় বন্ধ করে দেওয়া হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি টানা বন্ধ থাকে।
কোভিডকে ঢাল করে টানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার প্রভাব নিয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ জঁ দ্রেজ এর নেতৃত্বে এক সমীক্ষা করা হয়। সেই সমীক্ষা রিপোর্টে যে চিত্র বেরিয়ে এসেছে তা মোটেই সুখকর নয়। ভারতবর্ষের ১৫ টি রাজ্যের উপর ২০২১ সালে এই সমীক্ষাটি চালানো হয়। এই ১৫ টি রাজ্যের মধ্যে আমাদের রাজ্যও আছে। সমীক্ষা থেকে জানা গেছে, কোভিড পর্বে গ্রামীণ এলাকার ২৮℅ ছাত্র-ছাত্রী নিয়মিত পড়াশুনা করেছিল। আর ৩৭℅ ছাত্র-ছাত্রী সম্পূর্ণ পড়াশুনার বাইরে ছিল। ৫০℅ ছাত্র-ছাত্রী একটানা কয়েকটি শব্দ পড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে।
সরকার জানায়, অনলাইনে ক্লাস করিয়ে ঘাটতি মিটিয়ে দেবে। কিন্তু সমীক্ষা বলছে, মাত্র ৯℅ ছাত্র-ছাত্রীর স্মার্টফোন আছে। স্মার্টফোনের সমস্যা ছাড়াও ইন্টারনেট ডেটা প্যাক কেনার ক্ষমতা বড় অংশের ছিল না।
কোভিডের প্রভাব পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাক্ষেত্রে কেমন তা প্রকাশ পেয়েছে লার্নিং টুগেদার নামক একটি রিপোর্ট থেকে। রিপোর্টে পরিষ্কার ভাবেই বলা হয়েছিল, করোনার পরবর্তীতে স্কুল খোলার পরেও সমস্যা চলে যাবে না। বরং বিদ্যালয় খোলার পর সঙ্কটের চেহারাটা বোঝা যাবে। ঠিকই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার পর কঙ্কালসার চেহারাটা প্রকাশ হয়ে পড়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে অনেক ছাত্র-ছাত্রী ছিটকে গেছে।
কোভিডের পর উপার্জন কমে যাওয়ার কারণে স্কুলে ভর্তি কমে গেছে। বেসরকারি স্কুলে যেহেতু খরচ বেশি তাই ভর্তি কমছে। গ্রামাঞ্চলে গজিয়ে ওঠা বেশ কিছু কে জি স্কুলে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হওয়ার সংখ্যা কমেছে। 'বার্ষিক শিক্ষা ব্যবস্থা রিপোর্ট ২০২১' থেকে দেখা যাচ্ছে ৬-১৪ বছর পর্যন্ত শিশুদের বেসরকারি বিদ্যালয়ে ভর্তির হার ৮℅ কমেছে।২০১৮ সাল থেকেই বেসরকারি বিদ্যালয়গুলিতে ভর্তি কমছে। কারণ পরিবারের আয় কমছে।
অনলাইন শিক্ষার উপযোগিতা নিয়ে সরকার অনেক ঢাক-ঢোল পিটিয়েছিল। কিন্তু ২০২২ সালের ২৯ মে 'আনন্দবাজার পত্রিকা'য় প্রকাশিত রিপোর্ট বলছে ৩৮℅ পড়ুয়া অনলাইনে পড়াশুনা করতে গিয়ে সমস্যাতে পড়েছে, ৮০℅ পড়ুয়া জানিয়েছে স্কুলে গিয়ে যে কোনো বিষয় তারা ভালকরে শিখতে পারে। অর্থাৎ কোভিডের সময় অনলাইন শিক্ষা মোটেই ছাত্রদের কাজে আসেনি। 'শিক্ষা মেলা' করে কিছু চমক দেওয়া যায় কিন্তু সংকট চাপা দেবেন কী করে?
আর একটি প্রবণতার দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। শিক্ষায় লিঙ্গ অসাম্য। ছেলেদের সংখ্যা কি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কমছে? ছাত্রীদের ভর্তির হার বাড়লে সেটা আনন্দের। কিন্তু ছাত্রদের হার কি কমছে? করোনা আবহে একবছর মাধ্যমিক পরীক্ষা হয়নি।
সেবছর নথিভুক্ত পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ৬,১৩,৮৪৯ জন ছাত্রী আর ছাত্র ছিল ৪,৬৫,৮৫০ জন ছাত্র ছিল। অর্থাৎ ছাত্রী পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি ছিল।২০২২ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ছেলেদের থেকে মেয়েদের সংখ্যা প্রায় ৭১,০০০ বেশি ছিল। একই বছরে মাদ্রাসা বোর্ডে ৫৬০০০ পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৩৮,২২৪ জন ছাত্রী ছিল। যদিও জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষার পঞ্চম রাউন্ডে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী আমাদের রাজ্যে প্রতি এক হাজার জন পুরুষের সাপেক্ষে মহিলার সংখ্যা ৯৯২ জন। কিন্তু ছেলেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে হারিয়ে যাচ্ছে কেন? উপরের তথ্য থেকে এটা পরিষ্কার আমাদের রাজ্যে বিদ্যালয়ে যাওয়ার উপযোগী ছেলেদের একটা অংশ মাঝপথেই পড়াশুনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে - কারণ আর্থিক। শিশু শ্রমিক বাড়ছে।
কন্যাশ্রী প্রকল্প কি সফল? এর ফলে কি বিদ্যালয়ে ছাত্রীর সংখ্যা বাড়ছে? বাল্যবিবাহ কি কমেছে? কন্যাশ্রী প্রকল্পের সুবিধা নেওয়ার জন্য অনেকের নাম স্কুলের খাতায় লেখানো থাকে। আবার বিবাহের তথ্য গোপন করার জন্য স্থানীয় পঞ্চায়েত সার্টিফিকেট পর্যন্ত অনেক ক্ষেত্রেও দিয়ে দেয়।
যদি কন্যাশ্রী প্রকল্প সফল হয় কম বিবাহের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের চিত্র এত হতাশাব্যঞ্জক কেন? ২০-২৪ বছরের মহিলাদের মধ্যে ৪১.৬℅ এর ক্ষেত্রে ১৮ বছরের কমে বিয়ে হয়েছে এই রাজ্যে, যা সারা দেশের ২৩.৩℅এর দ্বিগুণ। এরাজ্যে নাবালিকাদের মধ্যে গর্ভধারণের হার ৮.১℅, সারা দেশে ৪.৩℅.। কন্যাশ্রীর হাল কী এই তথ্য থেকে বোঝা যায়। গোটা দেশে অল্প বয়সে বিয়ে হওয়া মেয়েদের হার পশ্চিমবঙ্গে সব থেকে বেশি।
এ প্রসঙ্গে রেজিষ্ট্রার জেনারেল ২০১৯ এর ' স্যাম্পল রেজিষ্ট্রেশন সিষ্টেম'এর দেওয়া পরিসংখ্যান বলছে ,জাতীয় স্তরে মেয়েদের গড় বিবাহের বয়স ২২.১ বছর।সেখানে পশ্চিমবঙ্গে মেয়েদের গড় বয়স ২১ বছর।সরকারি পরিসংখ্যান বলছে , পশ্চিমবঙ্গের ৪৫.৯℅ মেয়েদের ২১ বছরের আগেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।
এবছরের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী সংখ্যা কমা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি সঙ্কটের চিত্রকে সামনে কিছুটা তুলে আনল মাত্র।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন