এর চেয়ে খারাপ সময় স্বাধীন ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে কখনও এসেছে কি? এতখানি চ্যালেঞ্জের মুখে আগে কখনও পড়েছে ভারতীয় গণতন্ত্র? সম্ভবত নয়। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী তথা আম আদমি পার্টির শীর্ষনেতা অরবিন্দ কেজরিওয়ালের গ্রেফতারির পর নিঃসন্দেহে বলা যায়, মোদী ২.০ জমানার অঘোষিত জরুরি অবস্থা সবদিক থেকেই টক্কর দিচ্ছে ইন্দিরা গান্ধীর জমানায় জারি করা জরুরি অবস্থাকে।
পরিস্থিতি বরং এখন আরও বেশি খারাপ। কারণ ১৯৭৭ সালের লোকসভা নির্বাচন হয়েছিল জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারের পর। আর এই ২০২৪ সালের গোটা নির্বাচনপর্বেই জারি থাকবে অঘোষিত জরুরি অবস্থা। নির্বাচনের পরেও হয়তো আরও অনেকদিন ভারতীয় গণতন্ত্রের বুকের উপর বসে থাকবে সে। শ্বাসরোধ করে রাখবে গণতন্ত্রের।
১৯৭৭ সালের লোকসভা নির্বাচন হয়েছিল জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারের পর। আর এই ২০২৪ সালের গোটা নির্বাচনপর্বেই জারি থাকবে অঘোষিত জরুরি অবস্থা।
কেজরিওয়ালের গ্রেফতারির পর খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা বলেছেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী৷ বাংলা তর্জমা করলে যার অর্থ দাঁড়ায়, 'এক আতঙ্কিত স্বৈরশাসক জন্ম দিতে চাইছেন মৃত গণতন্ত্রের।' নরেন্দ্র মোদী আতঙ্কিত না আত্মবিশ্বাসী, তা এখনই বলা সম্ভব নয়৷ তবে তিনি যে ভারতীয় গণতন্ত্রের প্রাণসত্তাটিকে মেরে ফেলতে সচেষ্ট তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই৷ বিরোধীহীন ফাঁকা ময়দানে গমগম করছে স্বৈরতন্ত্রের স্বর : 'আব কি বার/ চারশো পার'।
তথাকথিত হিন্দু হৃদয়সম্রাটের এই রণধ্বনিকে সত্যে পরিণত করতে অতিসক্রিয় যাবতীয় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। এ এক আশ্চর্য গণতন্ত্র, যেখানে একজন নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীও নিরাপদ নন। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন সংক্রান্ত অভিযোগের কথা ছেড়েই দিলাম। এই পরিস্থিতিতে কি আদৌ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব? বিশিষ্ট সাংবাদিক রবীশ কুমার তাই যথার্থই বলেছেন, এই পরিস্থিতিতে আর সমীক্ষা, ওপিনিয়ন পোল এসবের প্রয়োজন কী? মাত্র ৪০০টি আসনে থেমে থাকারও তো প্রয়োজন নেই, ৫৪৩টি আসনেই বিজেপিকে জিতিয়ে দেওয়া হোক। গণতন্ত্রই যেখানে মৃতপ্রায়, সেখানে নির্বাচন তো প্রহসন ছাড়া কিছু নয়।
এ এক আশ্চর্য গণতন্ত্র, যেখানে একজন নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীও নিরাপদ নন। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন সংক্রান্ত অভিযোগের কথা ছেড়েই দিলাম।
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর বিরোধীদের দমন করতে অতিসক্রিয় হয়ে উঠেছে ইডি, সিবিআই-এর মতো কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলি। ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে তারা ব্যবস্থা নিয়েছে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের বিরুদ্ধে। অথচ ইউপিএ জমানায় ছবিটা ছিল একদম আলাদা৷ কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলি শাসক শিবিরের নেতাদের বিরুদ্ধেই সক্রিয় থাকত বেশি।
ইডি, সিবিআই-এর মতো সংস্থাগুলিকে নরেন্দ্র মোদীর সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশে ব্যবহার করার ফলে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা আর্ন্তজাতিক মহলে রীতিমতো প্রশ্নের মুখে পড়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ভারতীয় শাখার প্রতিনিধি আকর পটেল আল জাজিরাকে জানিয়েছেন, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বিরোধীদের দমন করার জন্য দেশের আইন এবং কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলিকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছে৷ এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ভারতীয় জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার।
ইডি, সিবিআই-এর মতো সংস্থাগুলিকে নরেন্দ্র মোদীর সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশে ব্যবহার করার ফলে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা আর্ন্তজাতিক মহলে রীতিমতো প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
হেমন্ত সরেনের পর অরবিন্দ কেজরিওয়ালের গ্রেফতারি প্রমাণ করল বিজেপি ফাঁকা মাঠে গোল দিতে চাইছে। দিল্লির ক্ষেত্রে পরিস্থিতি রীতিমতো হাস্যকর৷ আম আদমি পার্টির সর্বোচ্চ নেতৃত্বের প্রায় সকলকেই জেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। কেজরিওয়াল ছাড়াও জেলে আছেন প্রাক্তন উপ মুখ্যমন্ত্রী মনীশ শিশোদিয়া, প্রাক্তন মন্ত্রী সত্যেন্দর জৈন, গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন সঞ্জয় সিং। আপ নেতা এবং দিল্লির স্বাস্থ্যমন্ত্রী সৌরভ ভরদ্বাজ আশংকা প্রকাশ করেছেন, হেমন্ত এবং অরবিন্দের পর আরও কয়েকজন বিরোধী মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেফতার করা হতে পারে। সত্যি বলতে কি, এই আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
প্রশ্ন হল, নরেন্দ্র মোদী তথা বিজেপি নেতৃত্ব এতখানি মরিয়া কেন? কংগ্রেস হীনবল। উত্তরপ্রদেশের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে সমাজবাদী পার্টিরও বেহাল দশা। গোটা হিন্দি বলয়ে বিজেপি কার্যত অপ্রতিরোধ্য। গত ২২ জানুয়ারি রামমন্দির উদ্বোধন হয়েছে। বিভাজনের রাজনীতির বাজারদর তুঙ্গে। ইন্ডিয়া জোট থেকে নীতিশ কুমার বেরিয়ে গিয়েছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও জানিয়েছেন একাই লড়বেন৷ সবমিলিয়েই বিজেপির অনেকখানি নিশ্চিন্ত থাকার কথা। অথচ বাস্তবে বিরোধীদের দমন করতে সর্বাত্মক চেষ্টা করছে বিজেপি। এর কারণ কী?
আসলে '..চারশো পার' স্লোগানটির তাৎপর্য অনেক গভীর। একে কেবল নির্বাচনী পাটিগণিতে দেখার সুযোগ নেই।
আসলে '..চারশো পার' স্লোগানটির তাৎপর্য অনেক গভীর। একে কেবল নির্বাচনী পাটিগণিতে দেখার সুযোগ নেই। প্রায় এক শতাব্দী আগে, ১৯২৫ সালে খুব কাছাকাছি সময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দুটি সংগঠন- ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ। দীর্ঘ ১০০ বছর ধরে আরএসএস কাজ করে চলেছে হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। গত কয়েক বছরে সেই অভিযানের গতি আরও তীব্র হয়েছে। অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দিয়ে তৈরি হয়েছে রাম মন্দির। কাশ্মীরে বিলোপ হয়েছে ৩৭০ ধারা। ভারতীয় গণতন্ত্র এবং সংবিধানের উপর হিন্দু রাষ্ট্রের ছায়া ক্রমশ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। এক শতাব্দী ধরে চলতে থাকা এই অভিযাত্রার নির্ণায়ক পদক্ষেপটি হতে পারে লোকসভায় ৪০০টি আসন জেতা।
সংসদের দুই কক্ষ মিলিয়ে তাঁরা এমন সংখ্যায় পৌঁছতে চান, যাতে সংবিধানে 'প্রয়োজনীয় পরিবর্তন' করা যায়, বদলে ফেলা যায় 'হিন্দুবিরোধী' আইন। ইঙ্গিতটি বুঝতে খুব অসুবিধা হয় কি?
কর্ণাটকের বিজেপি সাংসদ অনন্ত কুমার হেগড়ে খুব স্পষ্ট করেই জানিয়েছেন তাঁরা ঠিক কী চান। তিনি বলেছেন, আপাতত সংসদে তাঁদের দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে্। কিন্তু রাজ্যসভায় পর্যাপ্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। সংসদের দুই কক্ষ মিলিয়ে তাঁরা এমন সংখ্যায় পৌঁছতে চান, যাতে সংবিধানে 'প্রয়োজনীয় পরিবর্তন' করা যায়, বদলে ফেলা যায় 'হিন্দুবিরোধী' আইন। ইঙ্গিতটি বুঝতে খুব অসুবিধা হয় কি?
বিজেপি অবশ্য জানিয়েছে, এই বক্তব্য সাংসদের ব্যক্তিগত। দলীয় অবস্থান নয়৷ কিন্তু সেই মামুলি বিবৃতি ভারতীয় গণতন্ত্র ও সংবিধানের উপর যে গভীর ছায়া সৃষ্টি হয়েছে, তাকে একটুও হালকা করতে পারছে না। গণতন্ত্রের গভীরতম অসুখ এখন৷ নিরাময়ের আশু সম্ভাবনা নেই।
*অর্ক ভাদুড়ি, বিশিষ্ট সাংবাদিক। *মতামত লেখকের ব্যক্তিগত
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন