মাইলের পর মাইল অসংখ্য ট্র্যাক্টর লাইন দিয়ে দাঁড় করানো। তার ফাঁকে ফাঁকে কোথাও তাঁবু, কোথাও মঞ্চ, কোথাও রান্না হচ্ছে, কোথাও খাবার বিতরণ চলছে। আর এর মধ্যে দিয়েই চলাফেরা করছেন অসংখ্য মানুষ। চতুর্দিকে তাকালেই পতাকা, পোস্টার, ব্যানারের ছড়াছড়ি। তার মধ্যে একটা পোস্টার চোখ টানে – “হম কিসান হ্যায় আতঙ্কবাদী নহী, We are FARMERS Not TERRORISTS” ।
চলতে চলতে মনে হচ্ছিল “সত্য সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ”। এখানে অন্নদাতা কৃষককে ঘোষণা করতে হয় যে সে কৃষক, দেশের অন্নদাতা, আতঙ্কবাদী নয়। সেই সুবিশাল জনসমুদ্রে চলতে চলতে আমরা ভাবছিলাম - সম্ভব হবে কি? একদিকে একটা ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক দল পরিচালিত সরকার আর তার পেছনে সম্মিলিত কর্পোরেট শক্তি, আর অপর দিকে সাধারণ কৃষকের দল যার মধ্যে বড়, মাঝারী, কৃষক ছাড়াও বহু ক্ষুদ্র কৃষক, গরীব খেতমজুর, ভাগচাষী আছে। একদিকে অর্থ ও পেশী শক্তির হুঙ্কার আর অন্যদিকে খেটে খাওয়া মানুষের চোয়ালচাপা অঙ্গীকার। এই অসম লড়াই কতদিন চলতে পারে? এই প্রশ্ন করেই ফেললাম সুখবিন্দর সিংজীকে “আপনারা কতদিন এইরকম বসে থাকবেন? সরকার যদি না মানে?” সুখবিন্দর সিংজীর সোজাসাপটা জবাব – “যতদিন না কালা কানুন প্রত্যাহার হয়। প্রয়োজন হলে দু বছর আমরা এইভাবেই দিল্লীর রাস্তায় বসে থাকব”। মনে সন্দেহ নিয়েই সেদিন বাড়ি ফিরেছিলাম। কিন্তু আজ, ১১ মাস পরে বলতে কোন দ্বিধা নেই যে মানুষ যখন সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে তার অধিকার রক্ষায় রুখে দাঁড়ায়, তখন প্রবল প্রতাপশালী শাসকেরও পরাজয় ঘটা শুধু সময়ের অপেক্ষা।
২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে দেশের আইনসভা যে তিনটি কৃষি আইন চালু করে, কৃষকরা তার প্রতিবাদে সাথে সাথেই পথে নেমে আসেন। ৩রা নভেম্বর, ২০২০ সারা দেশ জুড়ে রাস্তা রোকো প্রতিবাদ আন্দোলনের পর ২৫শে নভেম্বর ২০২০ পাঞ্জাব ও হরিয়ানার কৃষকরা দিল্লী চলো ডাক দেন। দিল্লী পুলিশ তাঁদের দিল্লী প্রবেশের অনুমতি না দিলে তাঁরা সেই জাতীয় সড়কেই বসে পড়েন। এখানেই গড়ে ওঠে তাঁদের অস্থায়ী আস্তানা, আর তাকে ঘিরে প্রতিবাদ কর্মসূচী। ক্রমশঃ তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও আরও অন্যান্য রাজ্যের অসংখ্য কৃষক।
দিল্লী প্রবেশের মুখে বিভিন্ন জাতীয় সড়কগুলিতে তাঁরা কাতারে কাতারে এসে অসংখ্য জমায়েত তৈরী করেন। সিংঘু বর্ডার, টিকরী বর্ডার, গাজিপুর বর্ডার – এইভাবে চিহ্নিত হয় তাঁদের জমায়েতগুলি। যেন দেশের মধ্যেই দেশের রাজধানী ঘিরে তৈরী হল অনেকগুলি সীমানা – যে সীমানা পেরনোর অধিকার নেই সাধারণ কৃষকের। তাই সীমানায় বসেই শাসকের চোখ রাঙানী উপেক্ষা করে তাঁরা অবস্থান চালিয়ে যান তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবী নিয়ে। কৃষক নেতারা এর মধ্যে বহুবার সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন, কিন্তু সবসময়েই তাঁদের ফিরতে হয়েছে শূন্য হাতে। ২৬শে জানুয়ারী প্রতিবাদী কৃষকরা এক যোগে দিল্লী প্রবেশ করলে পুলিশের সঙ্গে তাঁদের সংঘর্ষ বাঁধে এবং আবার তাঁদের সন্ত্রাসবাদী হিসাবে দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলে।
এর মধ্যে শীত এসেছে, শীত চলে গেছে। গ্রীষ্মের প্রখর রোদ, বর্ষার আঝোর বর্ষণ কৃষকদের ক্লান্ত করতে পারেনি। আন্দোলনের অভিমুখ বদলায় নি। মৃত্যু ছিনিয়ে নিয়ে গেছে বহু সহযোদ্ধাকে। কখনো দীর্ঘ আন্দোলন চালিয়ে যেতে যেতে হৃদয়ের ওঠাপড়া স্তব্ধ হয়েছে কোন বয়স্ক আন্দোলনকারীর। কখনো পুলিশি অত্যাচারে আঘাতপ্রাপ্ত কৃষক শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর পথে ঢলে পড়েছেন। মাত্র কিছুদিন আগে লখিমপুর খেরিতে কৃষক হত্যার ঘটনা শুধু দেশের ভেতরে নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও আলোড়ন তুলেছে। কৃষক নেতৃত্ব বলছেন গত ১১ মাসে প্রায় ৭৫০ জন কৃষক জীবন হারিয়েছেন এই আন্দোলন চালাতে গিয়ে। তবু চোখের পলক পড়েনি কৃষক সমাজের। সত্যি বলতে কি আমাদের জীবনকালে এইরকম সংগঠিত, নির্ভীক এবং পিছু না হঠা আন্দোলন কেউ দেখেছেন বলে মনে হয় না।
কৃষকদের এই জেদের কাছে শেষ পর্যন্ত হার মানতে, পিছু হঠতে বাধ্য হল সরকার নিজেই। অন্তত আজ প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ থেকে সেইরকমই মনে করা যেতে পারে। যদিও যতক্ষণ না আইনসভা এই বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করছে ততক্ষণ আমরা নিশ্চিন্ত হতে পারছিনা। সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার নেতৃত্বে থাকা কৃষক নেতারাও এই বিষয়ে এখনো নিশ্চিন্ত নন। আগামী দিনগুলিতে তাই অপেক্ষায় থাকা সরকারীভাবে এই তিন আইন প্রত্যাহারের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের।
তবে এই আন্দোলন শিক্ষা দিল যে মানুষের সম্মিলিত প্রতিবাদী শক্তিই আসলে ইতিহাস রচনা করে। বাকিটা তো শুধু রাজা-রাজড়ার গল্প।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন