সোমবারের দুপুরে কোন সংখ্যা ভালো ? শেষে নয় না শেষে সাত ?
বছর চব্বিশের মাসুদ আলি মনে করেন, বিজোড়ই ভালো।
বছর পঞ্চাশের পলাশ মন্ডল যদিও আগের সাত দিনের নম্বর মিলিয়ে নেওয়ায় বিশ্বাসী।
রাজ্যে যখন লোকসভা নির্বাচন নিয়ে চলছে মাতামাতি, কোন দল কতো আসন পাবে সেই নিয়ে চায়ের দোকান থেকে ট্রেনে বাসে জোর চর্চা, সেই সময় আপনার মনে হতেই পারে, কথা হচ্ছে কে কতো আসন পাবে সেটা নিয়ে।
কিন্তু রাজনৈতিক দলের নয়। এ এক অন্যরকম “ভাগ্য পরীক্ষা”।
যে “পরীক্ষা”য় মুর্শিদাবাদের ভগবানগোলা ২ নম্বর ব্লকের বাসিন্দা পলাশ মণ্ডল দু’বার ভাবছেন। কারণ, তিন মাসে এক টাকাও পান নি। আবার পকেট থেকে একশো টাকার নোট বের করার লোভও সামলাতে পারছেন না। সামনে কোটি কোটির হাতছানি। এই হাতছানিই মাজা ভাঙছে গ্রাম বাঙলার অর্থনীতির।
লটারি। আরও স্পষ্ট ভাবে, ডিয়ার লটারি যে কারও প্রিয়জন নয় সেটা মুর্শিদাবাদের রানীতলা বাজার থেকে জলঙ্গী, জঙ্গিপুর বাজার থেকে মালদার বৈষ্ণবনগর ঘুরলেই স্পষ্ট হয়ে যায়।
“পাঁচ সেম, কুড়ি সেম”-এর চক্করে ঘুণ ধরছে ভেঙে পড়া অর্থনীতিতে। ভাঙছে সাংসার, যাচ্ছে প্রাণ। তবে কমছে না লটারির টেবিল ঘিরে সুদিনের স্বপ্ন দেখা মানুষের সংখ্যাও।
লটারির ভয়ঙ্কর চক্রের সাক্ষী মুর্শিদাবাদের ডোমকলের শীতলনগর গ্রাম। এই গ্রামের বাসিন্দা কার্তিক শীল পেশায় ছিলেন ক্ষৌরকার। ডোমকলে কুপিলা হাটে ছোট্ট একটি সেলুন রয়েছে তার।
কাজের ফাঁকে আড্ডা দিতেন কুপিলা বাজারে। আর লটারি কাটতেন । খেলতেন “কোয়েল”।
লটারির কালো জালের আড়ালেই চলে এই কোয়েলের ব্যবসা। লটারিতে প্রথম পুরষ্কার জেতা সংখ্যার শেষ নম্বর নিয়ে চলে এই জুয়া। কোয়েল বেআইনি হলেও। পুলিশের সাথে বোঝাপড়া করেই চলে এই ধান্ধা।
এই লটারি আর কোয়েলের চক্করেই সর্বস্বান্ত হয়েছেন কার্তিক শীল। টাকা ধার করাও শুরু করেন। স্ত্রী পিঙ্কি সাহা বারবার জানতে চেয়েছেন, কোথায় যাচ্ছে টাকা ? কেন এই অবস্থা ? তাকে লুকিয়ে প্রতিদিন লটারি আর কোয়েলের নেশায় জড়িয়ে পড়েছেন কার্তিক শীল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই হাটেরই এক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, লটারির টেবিলে প্রতিদিন চলে জুয়ার আসর । পুলিশ সব জানে। জানিয়েছেন, প্রতিদিন দেড়শো থেকে দুশো টাকার লটারি কাটতেন কার্তিক। যেদিন রোজগার হতো না । সেদিন ধার করেও লটারি কাটতেন। টিকিটের সংখ্যায় বাজি ধরতেন।
এই মাসের পাঁচ তারিখ বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে চাষের জমিতে গিয়ে কীট নাশক পান করেন তিনি। তাঁকে ডোমকল মহকুমা হাসপাতাল হয়ে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল নিয়ে গেলেও বাঁচানো যায় নি। রাতেই মৃত্যু হয় কার্তিকের।
এই নেশার বলি হয়েছেন জলঙ্গীর আকসার আলিও। ঈদে বাড়ি ফেরেন নি আকসার। কিন্তু কেন ? লটারি। ফোনে জানিয়েছেন আকসার।
কৃষক পরিবারের আকসার পরিবার সূত্রেই পেয়েছিল বেশ কয়েক বিঘা জমি। বিয়ের পর চুটিয়ে করছিলেন সংসারও। কিন্তু এর মাঝেই পরেন লটারির চক্করে। শুরু করেন জমি বিক্রি করে দেওয়া।
লটারির ফাঁকে পাঁচ বছরের মধ্যে পথে বসেছেন তিনি। ভেঙেছে বিয়েও। জমি বিক্রি করে এখন কেরালায় নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করছেন আকসার।
কিন্তু কেন এই নেশায় জড়ালেন ?
আকসারের সপাট জবাব, খবরের কাগজ দেখে। ফেসবুকে খবর দেখে।
কীভাবে ?
আকসার মনে করিয়ে দিয়েছেন, কীভাবে লটারিতে কোটি কোটি টাকা জিতছেন তৃণমূল নেতারা সেই খবরের কথা। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম থেকে মূলধারর খবরের কাগজে মাঝেমাঝেই প্রকাশিত হয়েছে যে গ্রামের মানুষ লটারিতে কোটি পতি হচ্ছেন।
তবে আরেকটি কারণের কথাও বলেছেন তিনি। সেটা হল, রোজগারের আশা। যে আশার ফাঁদে প্রতিদিন টাকা ঢালছে গ্রামের যুবক থেকে বয়স্করা।
রাজ্যে তৈরি হচ্ছে না নতুন কোনও শিল্প। মুর্শিদাবাদের মতো জেলায় নেই কারখানা, কাজের সুযোগ। কৃষি প্রতিদিন অলাভজনক হচ্ছে। ছোট শিল্পের সর্বনাশ করেছে কেন্দ্র ও রাজ্যের সরকার। এই সময় রাজ্যের মানুষের কাছে বিকল্প কিই বা থাকতে পারে লটারির টেবিলে ভাগ্য পরীক্ষা ছাড়া ?
ডোমকলের লটারি বিক্রিতা সাবির আলি দেখেছেন যে গ্রামের বাজার হাট সব ডিয়ার লটারির কাউন্টারে ছেয়ে গিয়েছে। সাবির বলছেন, "আপনি একটা প্রত্যন্ত গ্রামে যান। সেখানেও একটা ডিয়ার লটারির টেবিল দেখতে পাবেন”।
কিন্তু কেমন হল ?
গ্রামে কাজের অভাবকেই এর কারণ হিসেবে দেখতে চাইছেন অনেকে। ঠিক যে কারণে বাড়ছে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা। আর একটি কারণও স্পষ্ট, সেটি হল ডিয়ার লটারিকে দেওয়া সরকারি মদত।
শাসক দলের প্রশ্রয়েই হাট, বাজার ছেয়ে গিয়েছে ডিয়ার লটারির ছাতায়। কেন এমন করল তৃণমূল ?
উত্তর উঠে এসেছে সম্প্রতি প্রকাশিত ইলেক্টোরাল বণ্ডের তথ্যে। সামনে এসেছে ডিয়ার লটারির নাম।
ডিয়ার লটারির ‘সোল ডিস্ট্রিবিউটার’সংস্থা ফিউচার গেমিং অ্যান্ড হোটেল সার্ভিসেস প্রাইভেট লিমিটেড। এই সংস্থার মালিক স্যান্টিয়াগো মার্টিন। ফিউচার গেমিং অ্যান্ড হোটেল সার্ভিসেস প্রাইভেট লিমিটেড দেশে সব চেয়ে বেশি টাকার নির্বাচনী বণ্ড কিনেছে। ১৩৬৮ কোটি টাকার বণ্ড। সেই টাকার মধ্যে ৫৪২ কোটি টাকা পেয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল। তৃণমূল পেয়েছে মোট বন্ডের ৩৯.৬ শতাংশ। এই কোম্পানি বিজেপিকে বন্ডের মাধ্যমে দিয়েছে ১০০ কোটি টাকা ।
এই বিনিয়মের মাধ্যমেই রাজ্যের গ্রাম শহরে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে লটারির নিবিড় জাল। সবটাই কেয়ার অফ তৃণমূল কংগ্রেস।
নির্বাচনী বণ্ডে মোটা টাকার বিনিময়ে রাজ্যের মানুষের ভবিষৎ’কে কার্যত অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে রাজ্যের শাসক দল।
লোকসভার নির্বাচনে ইস্যু হিসেবে কতোটা উঠে আসবে লটারির এই করাল গ্রাস ? নাকি ভোট আটকে রাখা হবে ঠান্ডা করে বসে বানানো বাইনারিতে ? সেটাই এখন দেখার।
*লেখক - বিশিষ্ট সাংবাদিক, *মতামত লেখকের ব্যক্তিগত
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন