France: আইনসভার নির্বাচনে মাক্রোঁ-ল্য পেন বাইনারি চূর্ণ করে বামপন্থীরা উঠে এল ২য় স্থানে

প্রথম রাউন্ডে রাষ্ট্রপতি মাক্রোঁর ‘অঁসম্বলঁ’ বা ‘Ensemble’ জোট ২৫.৭৫% ভোট পেয়ে প্রথম হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ২৫.৬৬% ভোট পেয়ে তার ঘাড়ের কাছেই নিশ্বাস ফেলছে বাম জোট NUPES।
র‍্যাডিকাল বামপ্রার্থী জঁ-লুক মেলশোঁ
র‍্যাডিকাল বামপ্রার্থী জঁ-লুক মেলশোঁগ্রাফিক্স - সুমিত্রা নন্দন
Published on

রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সবাইকে চমকে দিয়ে প্রথম রাউন্ডে তিন নম্বর স্থানে উঠে এসেছিলেন র‍্যাডিকাল বামপ্রার্থী জঁ-লুক মেলশোঁ। সামান্য ব্যবধানের জন্য দ্বিতীয় রাউন্ডে প্রেসিডেন্ট মাক্রোঁর সঙ্গে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেননি তিনি। প্রায় ৮%-এর কাছে ভোট, যা ফরাসী কমিউনিস্ট পার্টি সহ অন্যান্য বামদলগুলি পেয়েছিল, তা মেলেশোঁর পক্ষে আসলে ফ্রান্সে র‍্যাডিকাল বামেদের সামনে আসত একটি ঐতিহাসিক সুযোগ। এক হয়ে লড়তে না পারায় সেই সুযোগ হয়েছিল হাতছাড়া।

এই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েই ফ্রান্সের আইনসভা নির্বাচনে একজোট হয়ে লড়াই করল বামেরা। এই জোট গড়া কিন্তু মোটেই সহজ ছিল না। কমিউনিস্ট পার্টিকে নিজের পক্ষে নিয়ে আসতে বেগ পেতে হয়নি মেলেশোঁকে। এর আগেও মেলশোঁর দল ‘La France Insoumise’ (বিদ্রোহী ফ্রান্স) বা LFI-এর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নির্বাচনে লড়েছে ফ্রান্সের কমিউনিস্ট পার্টি। দুই দলের মধ্যে বিবাদ প্রকৃতপক্ষে নেতাদের ব্যক্তিগত মনমালিন্যের ফল, আদর্শগত বা নীতিগত বিরোধ নয়। সেই মনমালিন্য মিটিয়ে নিতে অসুবিধা না হলেও সমস্যা ছিল একদা ফ্রান্সের দোর্দণ্ডপ্রতাপ কিন্তু বর্তমানে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া ফরাসী সমাজতন্ত্রী দল বা ‘Parti Socialiste’ এবং পরিবেশবাদী গ্রিন পার্টি, যার পোশাকি নাম ‘Europe Écologie Les Verts’ কে নিয়ে। মধ্যবাম এই দুটি দলের কোনোটাই মেলেশোঁর মতো র‍্যাডিকাল বাম নেতার অধীনে নির্বাচনে লড়তে খুব একটা উৎসাহী ছিল না। গ্রিন পার্টির নেতা ইয়ানিক জাদু বিগত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে যে ভাষায় আক্রমণাত্মক ভাবে মেলেশোঁকে আক্রমণ করেছিলেন, তা দক্ষিণপন্থীরাও করেনি। তাই সংশয় ছিল এতকাল যে কোনো বামজোটে র‍্যাডিকাল বামদের লেজুড় হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত এই দলগুলি র‍্যাডিকাল বামদের নেতৃত্বাধীন জোটে কার্যত ছোটো শরিক হয়ে যোগদান আদৌ করবে কিনা। মেলেশোঁর নেতৃত্ব ও ধৈর্য সেই বাধা অতিক্রম করতে বহুলাংশে সক্ষম হয়েছে।

২০২২ সালের ১-লা মে, মে দিবসে, মেলেশোঁ ঘোষণা করলেন ফ্রান্সের চারটি প্রধান র‍্যাডিকাল ও মধ্য বাম দল ও আরও কতগুলি ক্ষুদ্র বাম দল একত্রিত হয়ে একটি নতুন জোট গঠন করেছে, জোটের নাম ‘Nouvelle Union populaire écologique et sociale’ বা ‘নয়া পরিবেশ ও সামাজিক গণ ইউনিয়ন’ বা সংক্ষেপে NUPES। ফ্রান্সের রাজনীতিতে NUPES-এর জন্ম একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই জোট গঠনের মধ্যে দিয়ে সাম্প্রতিক কালের মধ্যে এই প্রথম সব সময় বিবাদে লিপ্ত ফ্রান্সের প্রধান বাম শক্তিগুলিকে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে । বিগত শতকের তিরিশের দশকের পপুলার ফ্রন্টের পরে এইরকম বাম ঐক্য ফ্রান্স আর দেখেনি। কদিন আগেও যে ফ্রান্সে মাক্রোঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে অতি-দক্ষিণপন্থী মারিন ল্য পেন বা উগ্র দক্ষিণপন্থী ও জাতি বিদ্বেষী এরিক জেমুরের বাইরে আর কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না, সেই ফ্রান্সেই মেলেশোঁর নেতৃত্বে বামেরা জনমানসে এক ধাক্কায় এই জোট গঠনের পর উঠে এল প্রধান বিরোধী হিসেবে।

ফ্রান্সের আইনসভার নির্বাচন হয় দুই রাউন্ডে। প্রথম রাউন্ডে সরাসরি জিততে হলে কোনো দলের প্রার্থীকে পেতে হবে প্রদত্ত ভোটের ৫০%-এর বেশি ভোট। শুধু তাই নয়, এই প্রাপ্ত ভোটকে হতে হবে ঐ কেন্দ্রের মোট বৈধ ভোটারের অন্ততঃ ২৫%-এর অধিক। বলাই বাহুল্য, এই ভাবে প্রথম রাউন্ডেই সরাসরি নির্বাচন জেতা সব দলের পক্ষেই কঠিন। তাই প্রথম রাউন্ডের পর আয়োজন করা হয় দ্বিতীয় রাউন্ডের। এই রাউন্ডে মোট বৈধ ভোটারের ১২.৫% বা তার অধিক ভোটারের সমর্থন পেয়েছে এমন প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। এমন কোনো প্রার্থী যদি না থাকে, তাহলে সর্বোচ্চ এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছে এমন দুই প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এর মধ্যে যিনি সর্বাধিক ভোট পান, তিনিই জয় লাভ করেন। অত্যন্ত জটিল ব্যবস্থা, সন্দেহ নেই। কিন্তু যেখানে অনেকগুলি দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে, সেখানে আমাদের দেশের ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোল-এর থেকে এই ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে উন্নত।

এইবারের নির্বাচনে NUPES-এর সামনে প্রতিবন্ধকতা নেহাত কম ছিল না। বহু আসনেই চুক্তি ভঙ্গ করে সোশ্যালিস্ট পার্টির অনেক প্রার্থী জোট মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। এতে আশঙ্কা ছিল বাম ভোট ভাগ হবে। এদিকে ল্য পেনের নেতৃত্বে অতি-দক্ষিণপন্থীরা তো বটেই, তার পাশাপাশি মধ্য-দক্ষিণ রিপাবলিকানরাও আক্রমণের প্রধান নিশানা করে রাষ্ট্রপতি মাক্রোঁকে নয়, NUPES-কেই। রোবসপিয়ার থেকে লেনিন, কারোর সঙ্গেই মেলেশোঁকে তুলনা করে নিন্দা করতে বাকি রাখা হয়নি। NUPES-এর নেতা হাবেভাবে অবশ্য বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি এই নিন্দাকে প্রশংসা হিসেবেই নিচ্ছেন। বিপদ যে ল্য পেনের থেকে নয়, বামেদের দিক থেকে আসবে তা উপলব্ধি করে প্রধান প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি উজাড় করে দিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি মাক্রোঁও।

কিন্তু গত ১৩-ই জুন জাতীয় আইনসভা নির্বাচনের প্রথম রাউন্ডের ফলাফল প্রকাশ হতে দেখা গেল NUPES-এর বিজয় রথ রুখতে সবার চেষ্টাই বৃথা গেছে। ১৫০০ ইউরো ন্যূনতম মজুরি, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম বেঁধে দেওয়া, অবসরের বয়স পুনরায় ৬০ বছর করা এবং সর্বোপরি নতুন সংবিধান সহ ফ্রান্সে বর্তমান পঞ্চম প্রজাতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে এক ষষ্ঠ প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার মতো র‍্যাডিক্যাল প্রস্তাবেই বিপুল সংখ্যক ফ্রান্সের মানুষ ভরসা রেখেছেন। প্রথম রাউন্ডে রাষ্ট্রপতি মাক্রোঁর ‘অঁসম্বলঁ’ বা ‘Ensemble’ জোট ২৫.৭৫% ভোট পেয়ে প্রথম হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ২৫.৬৬% ভোট পেয়ে তার ঘাড়ের কাছেই নিশ্বাস ফেলছে NUPES।

জাতীয় আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা রাখতে গেলে মাক্রোঁর প্রয়োজন ৫৭৭-টি আসনের মধ্যে ২৮৯-টি। বর্তমান যা পরিস্থিতি, তাতে দ্বিতীয় রাউন্ডে একমাত্র যদি ‘অঁসম্বলঁ’ ভীষণ ভালো ফল করে, তবেই ২৯০-এর কাছে আসন পাওয়া সম্ভব। NUPES ১৫০ থেকে ১৯০-এর কাছে আসন লাভ করবেই, অর্থাৎ নিজেরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ না করলেও রাষ্ট্রপতির পার্টিকে আইনসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করা থেকে ঠেকাতে সক্ষম হবে তারা। এই পরিস্থিতিতে সরকার চালাতে গেলে মাক্রোঁ নিশ্চিত ভাবে দক্ষিণপন্থী অথবা অতি-দক্ষিণপন্থীদের সমর্থন নিতে বাধ্য হবে। এতে নিজেকে দক্ষিণপন্থী বা অতি-দক্ষিণপন্থীদের চুড়ান্ত বিরোধী একজন উদারপন্থী বা মধ্যপন্থী হিসেবে মাক্রোঁ এতদিন যে দাবী করে আসছেন, যে দাবী মেলেশোঁর তরফ থেকে বারবার আক্রমণের মুখে পড়েছে, তা ভ্রান্ত প্রমাণ হবে।

একই সঙ্গে নড়বড়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে মাক্রোঁর পক্ষে সরকার চালানোও হবে কঠিন। আইনসভায় শক্তিশালী বাম জোটের উপস্থিতি তাঁকে নব্যউদারপন্থী মডেলের নিয়ন্ত্রণহীন অনুসরণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে নিঃসন্দেহে। এদিকে দক্ষিণ এবং অতি-দক্ষিণপন্থীরাও নির্বাচনে আশানুরূপ ফল করতে ব্যর্থ হয়েছে। দ্বিতীয় রাউন্ডে খুব ভালো ফল করলেও মিলিত ভাবে তারা ৭০ থেকে ১১৫-এর অধিক আসন পাবে না। ল্য পেন নিজের দুর্গে সরাসরি জিততে পারেননি প্রথম রাউন্ডে, আর যাকে মিডিয়া রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রচার চলাকালীন কার্যত মাক্রোঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে তুলে ধরেছিল, সেই এরিক জেমুর দ্বিতীয় রাউন্ডেই যেতে পারেননি।

ভালো ফল বামেরা এই জাতীয় আইনসভার নির্বাচনে করতে চলেছে, এই নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশই নেই। কিন্তু সেই ফল গত শতকের মধ্যভাগে ফরাসী কমিউনিস্ট পার্টির রমরমার দিনের পর ফ্রান্সে র‍্যাডিকাল বামেদের সবথেকে ভালো নির্বাচনী ফল হতে চলেছে কিনা, তার উত্তর লুকিয়ে আছে আগামী রবিবার, ১৯-শে জুনের দ্বিতীয় রাউন্ডের নির্বাচনে। বিগত কয়েক বছরে ফরাসী রাজনীতি একদিকে নব্যউদারপন্থী মাক্রোঁ অন্যদিকে অতি-দক্ষিণপন্থী ল্য পেন-এর বাইনারির জালে জড়িয়ে গেছিল। সেই বাইনারির জাল ছিঁড়ে দেশের রাজনৈতিক ভাষ্যকে বাঁ দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে মেলেশোঁ ও NUPES দেখিয়ে দিয়েছে এই ডান আর আরও ডান, এই দুই পক্ষের বাইরেও বেছে নেওয়ার মতো বিকল্প আরেকটা পক্ষ আছে। শুধু এই জন্যই তাঁদের অশেষ সাধুবাদ প্রাপ্য।

র‍্যাডিকাল বামপ্রার্থী জঁ-লুক মেলশোঁ
Colombia: রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বাম জোটের চমক, ৪০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে শীর্ষে গুস্তাভো পেত্রো

স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in