লক্ষ্য ছিল বিজেপি বিরোধী ভোট ভাগাভাগি আটকানো। সেই লক্ষ্যেই ইন্ডিয়া মঞ্চের জন্ম। যদিও পশ্চিমবঙ্গে ইন্ডিয়া মঞ্চের ভবিষ্যৎ কী, তা নিয়েই এখন ঘোর সংশয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টা যে বেশ জটিল আকার ধারণ করছে সন্দেহ নেই। লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে রাজ্যের রাজনৈতিক মহলে এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এটাই।
বিজেপি বিরোধী ভোট আটকাতে রাজ্যে যুযুধান তৃণমূল কংগ্রেস, সিপিআইএম তথা বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস, একই মঞ্চের তথাকথিত শরিক হলেও নির্বাচনী আসন সমঝোতার ক্ষেত্রে এই তিন দলের অবস্থানগত বিরোধ মেটানো সহজ কাজ নয়। মিটবে না কোনোভাবেই। এক্ষেত্রে বামেদের পক্ষে স্পষ্ট অবস্থান নেওয়া খুব একটা কঠিন না হলেও কংগ্রেস যে স্পষ্টতই দোটানায় তা গত কয়েকদিনের রাজনৈতিক ঘটনাবলীতে পরিষ্কার। আরও কয়েকটা দিন না গেলে যদিও এই ছবি স্পষ্ট হবেনা।
রাজ্যস্তরের এবং কেন্দ্রীয় স্তরের বাম নেতৃত্ব, মহম্মদ সেলিম থেকে সীতারাম ইয়েচুরি বারবারই জানিয়েছেন ইন্ডিয়া মঞ্চে তৃণমূল থাকলেও রাজ্যে নির্বাচনী আসন সমঝোতার ক্ষেত্রে কোনোভাবেই তৃণমূলের সঙ্গে কোনও সমঝোতা হবেনা। কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতা হতে পারে। যদি তা না হয় সেক্ষেত্রে বামেরা একলাই লড়াই করবে অথবা আইএসএফ-কে সঙ্গে নেবে। (আইএসএফ যেহেতু ইন্ডিয়া মঞ্চে নেই তাই আইএসএফ প্রসঙ্গে এখানে আনা হচ্ছে না।) বাম শরিক ফরওয়ার্ড ব্লক আগেভাগেই জানিয়ে দিয়েছে কংগ্রেসের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতায় তাদের আপত্তি আছে।
বাম অথবা তৃণমূল - দ্বিধাগ্রস্ত কংগ্রেস কোন দিকে যাবে? এক্ষেত্রে কংগ্রেসের রাজ্য নেতৃত্ব এবং কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মধ্যে প্রবল মতপার্থক্য আছে। রাজ্যের বাস্তব পরিস্থিতি এবং কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের সিদ্ধান্ত – দুই-এর মাঝে আটকে কংগ্রেসের রাজ্য নেতৃত্ব। সীতারাম ইয়েচুরিকে পাশে নিয়ে রাহুল গান্ধী ইন্ডিয়া মঞ্চের বৈঠকে বসলেও এখনও পর্যন্ত যতদূর জানা গেছে কংগ্রেস হাইকম্যান্ড আগামী নির্বাচনে সরল পাটিগণিতের অঙ্কে রাহুল গান্ধীর অন্যপাশে বসা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূলের সঙ্গে যেতেই আগ্রহী। তাছাড়া পাঁচ রাজ্যের সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে তিন রাজ্যে পর্যুদস্ত হয়ে দর কষাকষির ক্ষমতা অনেকটাই হারিয়েছে কংগ্রেস।
তৃণমূলের সঙ্গে সমঝোতা হলে এই রাজ্য থেকে কংগ্রেসের কিছু আসন বাড়লেও বাড়তে পারে। কংগ্রেসের দাবি কমপক্ষে ৭ আসন। মূলত মালদা ও মুর্শিদাবাদ-এর কিছু আসন, দার্জিলিং এবং রায়গঞ্জ আসনেই সেই দাবি সীমাবদ্ধ। যদিও আসন সমঝোতায় তৃণমূল কত আসন কংগ্রেসকে ছাড়বে তা এখনও স্পষ্ট নয়। প্রাথমিক সূত্র অনুসারে তৃণমূল মুর্শিদাবাদ এবং মালদার ২ আসনের বেশি কংগ্রেসকে ছাড়তে রাজী নয়। অবশ্য রফাসূত্রে তৃণমূল সামান্য একটু নমনীয়তা দেখিয়ে আরও গোটা দুয়েক আসন ছেড়ে দিলেই আগামী লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস তৃণমূল জোট হবে। কারণ নির্বাচন পরবর্তী পরিস্থিতিতে সেটাই কংগ্রেসের পক্ষে লাভজনক হবে বলেই মনে করছে হাইকম্যান্ড।
কংগ্রেস হাইকম্যান্ড আরও মনে করে বিজেপি বিরোধিতায় রাজ্যের নিরিখে এখন বামেদের চেয়ে তৃণমূলের হাত ধরাই শ্রেয়। কারণ ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে বাম কংগ্রেস আইএসএফ একসাথে লড়াই করেও কোনও লাভ হয়নি। তাছাড়াও কেরালায় বাম কংগ্রেসকে মুখোমুখি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে। তাই এ রাজ্যেও বাম কংগ্রেস প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে থেকে গেলে দুই রাজ্যেই কর্মী সমর্থকদের কাছে মানরক্ষা হবে। এ রাজ্যেও গোঁড়া কংগ্রেস কর্মীরা বামেদের সঙ্গে সমঝোতা না হলে খুশি হবে।
কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের এই ভাবনার সঙ্গে রাজ্য কংগ্রেস নেতৃত্বের ভাবনার পার্থক্য আছে। রাজ্য কংগ্রেস নেতৃত্বের একটা বড়ো অংশই তৃণমূল বিরোধিতায় সরাসরি বামেদের সঙ্গে নিয়ে নির্বাচনে যাবার পক্ষপাতী। যদিও এই প্রবণতাকে কংগ্রেস হাইকম্যান্ড কিছু রাজ্য নেতৃত্বের ব্যক্তিগত ক্ষোভের বিষয় হিসেবেই ভাবছেন। নির্বাচনী লাভের অঙ্কে তাদের কাছে তৃণমূল অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য।
বিগত তিন লোকসভা নির্বাচনের হিসেব ধরলে আসন সংখ্যার নিরিখে বামেরা বর্তমানে শূন্য। ২০০৯-এ ১৫ আসন এবং ২০১৪ তে ২টি আসন থাকলেও ২০১৯-এ রাজ্য বামেদের শূন্য হাতে ফিরিয়েছে। কংগ্রেসের আসন ৭ থেকে ৪ হয়ে শেষ লোকসভা নির্বাচনে ২-এ দাঁড়ায়। যদিও শেষ লোকসভা নির্বাচনে বাম কংগ্রেস সমঝোতা ছিল। অন্যদিকে তৃণমূল ২০০৯-এ প্রাপ্ত ১৯ আসন থেকে ২০১৪ তে আসন সংখ্যা অনেকটাই বাড়িয়ে ৩৪-এ পৌঁছে যায়। ২০১৯-এ ফের যা ২২ আসনে নেমে আসে।
তবে বামেরা শূন্য হলেও এখনও রাজ্যের প্রায় প্রতিটি কেন্দ্রেই বামেদের পকেট ভোট আছে। সংখ্যায় তা কম বেশি হতে পারে। বামেদের এই নির্দিষ্ট ভোটারদের একটা বড়ো অংশই আবার কংগ্রেসের সঙ্গে বা আইএসএফ-এর সঙ্গে কোনওরকম সমঝোতার বিরোধী। এঁদের অনেকেই একলা চলো নীতির পক্ষপাতী। কারণ বাম সমর্থকদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ, কংগ্রেসের সঙ্গে জোট হলে বাম কর্মীরা কংগ্রেসের জন্য লড়াইতে সহায়ক ভূমিকা পালন করলেও কংগ্রেস কর্মী সমর্থকদের বড়ো অংশই বামেদের ভোট দেননা।
যদিও এই মুহূর্তে রাজ্যের ৪২টি আসনের মধ্যে একটিতেও এককভাবে জেতার অবস্থায় বামেরা আছে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। বিশেষ করে উত্তরের কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং-এ বাম ভোটের ক্ষয় এখনও রোধ করা যায়নি। নামে বামফ্রন্ট হলেও বাম শরিক আরএসপি, সিপিআই বা ফরওয়ার্ড ব্লক এখন শক্তিহীন। বামফ্রন্টগত বাধ্যবাধকতায় এই তিন দলকে কিছু আসন ছাড়তে হলেও ৪২টি আসনের কোনোটাতেই এই তিন দলের এককভাবে লড়াই করবার ক্ষমতা নেই। ফলে রাজ্যের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই তিন দলের হয়ে ভোট করানোর দায়িত্বও বড়ো শরিক সিপিআইএম-কেই নিতে হবে।
বাম কংগ্রেস সমঝোতা করে ২০১৯-এ বামেরা শূন্য হয়ে গেলেও কংগ্রেস কিন্তু দুটি পকেট আসন ধরে রেখেছিল। এবারেও বাম কংগ্রেস আসন সমঝোতা হলে কংগ্রেস লাভবান হলেও বামেরা যে কংগ্রেসের সহায়তায় মালদা বা মুর্শিদাবাদ ছাড়া অন্য কোথাও কোনও আসন জিততে পারবে সে সম্ভাবনা খুব কম। কারণ এই রাজ্যে কংগ্রেসেরও ওই দুই জেলা ছাড়া এখন বলার মত সেরকম কোনও শক্তি নেই।
যে দল যে দিকেই থাকুক না কেন, আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে এই রাজ্যে ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতাই হবে। একদিকে বিজেপি, অন্যদিকে তৃণমূল কংগ্রেস-কংগ্রেস এবং বাম। অথবা বিজেপি, তৃণমূল কংগ্রেস এবং বাম কংগ্রেস। ত্রিমুখী এই প্রতিদ্বন্দ্বিতাতে দুই ক্ষেত্রেই বিজেপি যে বেশ কিছুটা লাভবান হবে তা বলাই বাহুল্য।
তবে বাম যুব সংগঠন ডিওয়াইএফআই-র ইনসাফ যাত্রা যেভাবে সাড়া ফেলেছে রাজ্য জুড়ে, তাতে সিঁদুরে মেঘ দেখছে তৃণমূল বিজেপি দুই পক্ষই। শুরুতে ইনসাফ যাত্রাকে কোনও রাজনৈতিক দলই ততটা গুরুত্ব না দিলেও শেষ পঞ্চাশ দিনে রাজ্যের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত চষে ফেলে মানুষের মধ্যে সাড়া জাগিয়েছে মীনাক্ষী মুখার্জি ও তাঁর দলবল। এর প্রভাব ইভিএম-এ পড়বেই একথা ততটা জোর দিয়ে এখনই না বলা গেলেও এই ইনসাফ যাত্রা বামেদের নতুন অক্সিজেন যুগিয়েছে তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। সেই বলে বলীয়ান হয়ে বামেরা একলা চলো নীতি নিলে কতটা লাভবান হবে তা বলা যাবে একমাত্র ভোটের পরেই।
- মতামত লেখকের ব্যক্তিগত
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন