বাচ্চাটা হওয়ার আগে শিখা, তন্ময়ের স্ত্রী, গোটা কয়েক টিউশন পড়াত। অল্প হলেও কিছু টাকা তো রোজগার হত বেশি। তিন বছর আগে মেয়ে হয়েছে, তারপর থেকে শিখাকেও বন্ধ করতে হয়েছে কাজ। আয় যেমন কমেছে, তেমনই উল্টোদিকে গত তিন বছরে সংসার-খরচও তো বেড়েছে অনেকখানি। বাধ্য হয়েই অফিসে আসার আগে দু’ ঘন্টা আর অফিস থেকে ফেরার পর প্রায় ঘন্টা তিনেক ওলা এবং উবের-এ বাইক চালাতে হয় তন্ময়কে। মানে অফিসে আট ঘন্টা আর এই অতিরিক্ত কাজে আরও প্রায় পাঁচ ঘন্টা। স্বামী, স্ত্রী, তিন বছরের বাচ্চা মেয়ের সংসার চালাতে দিনে অন্তত তেরো ঘন্টা গতর খাটাতে হয়। তাতেও অভাব মেটে না দুর্মূল্যের বাজারে।
অভাব মেটে না জয়েরও। তন্ময় যেমন গত ১৫ বছর ধরে এক অফিসের ঠিকাশ্রমিক, জয়ের তেমন কোনও কাজ নেই। এই বাইক চালানোই তার একমাত্র পেশা। দিনে গড়ে তেরো থেকে চোদ্দ ঘন্টা বাইক চালাতে হয়। বছর খানেক আগে গলব্লাডারে পাথর ধরা পড়েছিল, সরকারি হাসপাতালে এই ছোট অপরেশনের সুযোগও মেলেনি। প্রাইভেটে করাতে হয়েছে। খরচা হয়েছে প্রায় লাখ টাকা। সেই যে দেনায় ডুবেছে জয়, এখনও সারা মাসে যা আয় হয় তার অর্ধেকের বেশি চলে যায় সুদ গুনতেই। প্রতি মাসে আরও গুনতে হয় বাইকের ইএমআই। এর উপরে আছে বৃদ্ধ মায়ের ওষুধের খরচা। নুন আনতে পান্তা ফুরোয় ঘরে।
তন্ময় আর জয়; এই দুই যুবকেরই বাড়ি কলকাতায়। নূর বর্ধমানের ছেলে। মেমারির কাছে কুসুমগ্রামে তার বাড়ি। জামাকাপড়ের ছোট দোকান ছিল পারিবারিক। লকডাউনে সে ব্যবসা লাটে উঠেছে। পরিচিত একজনের সূত্রে খোঁজ পেয়েছিল কলকাতায় এসি মেশিন সারানোর একটা কাজের। বাঘাযতীনের কাছে অফিস, একটা ছোট কোম্পানি। ট্রেনিং পিরিয়ডে নূর পায় মাসে আড়াই হাজার। এখানে মেসে থাকতে, খেতেই খরচ হয় তারচেয়ে বেশি। বাড়িতেও পাঠাতে তো হবে কিছু। ফলে বাড়তি রোজগারের আশায় বাইক চালায় রাপিডোতে। সেও দিনে ছয় থেকে আট ঘন্টা, একেকদিন একেক রকম।
শহরের আনাচে কানাচে ঘাড় ঘোরালেই আলাপ হবে এমন আরও অনেকের সাথেই। বেশির ভাগই একটা কাজ করেন, তাতে চলে না। বাড়তি আয়ের আশায় বাইকে সওয়ারি তোলেন। কেউ খাবার বা অন্য পন্য ডেলিভারির কাজে। সংখ্যায় কম হলেও এমনও কয়েকজন আছেন, যাঁদের একমাত্র আয়ের উৎস এটাই।
ঘটনা হ’ল, এমন কাজ যাঁরা করেন তাঁদের কাউকেই শ্রমিক হিসেবে কোনও স্বীকৃতিই দেওয়া হয় না। ওলা, উবের, রাপিডো, ইনড্রাইভ-এ দু’চাকা বা চার চাকা গাড়ি যাঁরা চালান, এইসব কোম্পানি তাঁদের ‘রাইডার’ বলে ডাকে। আর সুইগী, জোমাটো, অ্যামাজন, ফ্লিপকার্ট, ব্লিংকিট-এর মতন কোম্পানিগুলো তাঁদের কর্মীদের ডাকে ‘ডেলিভারি পার্টনার’ নামে। পার্টনার, তবে মুনাফার নয়।
পুঁজিবাদের গোড়া থেকেই শ্রমিকদের লড়তে হয়েছে নিজের শ্রমশক্তির নায্য দাম আদায়ের জন্যে। অধিকারের জন্যে। আজকের পুঁজিবাদ এমন শ্রমিকদের জন্ম দিয়েছে যাঁদের শুরুতে লড়তে হয় নিজেদের ‘শ্রমিক’ স্বীকৃতিটার জন্যেই। শ্রমিকের স্বীকৃতিটুকুই যদি না মেলে তাহলে শ্রমিকের অধিকারই বা মিলবে কীকরে? এটাই পুঁজিবাদের নতুন প্যাঁচ, যেখানে শ্রমসম্পর্ককে এতটাই দুমড়ে মুচড়ে নেওয়া হয়েছে, এতটাই নমনীয় করে নেওয়া হয়েছে যে প্রথাগত শ্রমিক-মালিক সম্পর্কটাই আর নেই।
ওলা বা উবেরের সাথে তন্ময়ের সম্পর্কটা কেমন তাহলে? প্রথাগত পুঁজিবাদে দেখি, কারখানা, কারখানার যন্ত্রপাতি, কাঁচামালের জন্য পুঁজির যোগান দেয় মালিক। শ্রমিক তাঁর শ্রমশক্তি বিক্রি করেন মজুরির বিনময়ে। কিন্তু গিগ অর্থনীতির এই পর্যায়ে বাইক, বাইকের তেল মোবিল, মোবাইল এসবের জন্য ওলা বা উবের কোম্পানির মালিককে এক পয়সাও ইনভেস্ট করতে হয় না। মেহনতও তন্ময়ের, এসবের খরচাও তন্ময়েরই। কোম্পানি মাঝখান থেকে প্রতি টিপ পিছু একটা মুনাফা খেয়ে নেয় ফোকটেই।
পুঁজিবাদের এই স্তরে মালিক সম্পূর্ণ ঝাড়া হাত-পা। যেহেতু শ্রমিককে সে শ্রমিকের স্বীকৃতিই দেয় না ফলে শ্রমিকের আইনানুগ নায্য যে অধিকার (ন্যূনতম মজুরি, সামাজিক সুরক্ষা, দুর্ঘটনা বীমা ইত্যাদি) সেসবের কিছুই দিতে হয় না তাকে। এমনকি মে দিবসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত সর্বোচ্চ আট ঘন্টা কাজের আন্তর্জাতিক অধিকারও দিতে হয় না। যতক্ষণ খুশি নিংড়ে নাও শ্রমশক্তি। যত কম খুশি দাম দাও শ্রমশক্তির। মালিককে নিয়ন্ত্রণ করার বা বলার মতনও কেউ নেই। অনিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদের এই স্তরে শ্রমিকের অবস্থা কহতব্য নয়।
জীবীকার কোনও নিরাপত্তা তো নেইই, জীবনের নিরাপত্তাও নেই। রোজ একাধিক দুর্ঘটনা ঘটে, প্রায় কোনোক্ষেত্রেই ক্ষতিপূরণ মেলে না। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে যে ভয়াবহ দাবদাহ চলছে , তার কথাই ধরুন। তীব্র গরম, হিট ওয়েভ, রাস্তায় আগুনের হলকা বেরোচ্ছে। এর মধ্যে ডেলিভারির কাজ করতে গিয়ে বা বাইক চালাতে গিয়ে এই কলকাতা শহরেই রোজই অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন গত কয়েক দিনে। কোনও কোম্পানি কোনও অসুস্থ শ্রমিকের চিকিৎসার কোনও দায় তো নেয়নি। উলটে এই কোম্পানগুলো কাজের শর্ত, নিয়ম যখন খুশি বদলায় নিজের স্বার্থে। শ্রমিকদের সাথে আলোচনার গল্প তো নেইই, এমনকি সরকারেরও কোনোই নিয়ন্ত্রণ নেই।
দেশের সরকারের দেওয়া হিসেবে আজ দেশে এই ধরণের শ্রমিকের সংখ্যা ৭৭ লক্ষের বেশি। যা গত কয়েক বছরে গুনিতক হারে বেড়েছে, এবং আগামী কয়েক বছরে আরোই বাড়বে। পুঁজিবাদ মুনাফাকে সর্বোচ্চ করার লক্ষ্যে শ্রমশক্তির প্রায় পুরোটাকেই প্রথাগত শ্রমিক-মালিক সম্পর্কের বাইরে নিয়ে যেতে চাইবে। এটাই স্বাভাবিক।
গত শতাব্দীর নয়ের দশকে আমাদের দেশে নয়াউদার অর্থনীতি আমদানির সময় থেকেই ‘সংস্কার’-এর নামে শ্রম সম্পর্ককে নমনীয় করার প্র্য়াস শুরু হয়েছে। ‘কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস’-এর নামে এটাই ছিল সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের দাওয়াই। পুঁজির মালিককে লাগামহীন শোষণের রাস্তা করে দিতে রাষ্ট্রীয় সমস্ত নিয়ন্ত্রণ কমিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু সেই থেকে। দেশে ঠিকা ও চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক নিয়োগের রমরমা শুরু। আজ শুধু আর বেসরকারি ক্ষেত্রে নয়, সমস্ত সরকারি ক্ষেত্রেও শ্রমশক্তির প্রায় ৭০-৮০ শতাংশই অস্থায়ী চুক্তিভিত্তিক বা ঠিকাদারের অধীন।
গত দশ বছরে মোদি-জমানায় কর্পোরেট-কম্যুনাল দাপুটে কম্বিনেশনের আগ্রাসী ইনিংসে এই প্রবণতা বেড়েছে বহুগুনে। ব্যাপক কর্মচ্যুতি, স্বাধীনতার পরের সর্বোচ্চ বেকারি দেশের বিপুল শ্রমশক্তিকে বাধ্য করেছে যেমন-তেমন একটা কাজে ঢুকে যেতে। একসাথে একটার বেশি পেশায় ভিড়তে। জীবন, জীবীকার কোনও সুরক্ষা ছাড়া, নিরাপত্তা ছাড়া কার্যত খুঁটে খেতে বাধ্য করেছে শ্রমজীবী জগগনকে। ঠিকা ও চুক্তি শ্রমিকদের থেকেও বেশি অনিশ্চিত এবং ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে দাঁড়িয়ে ঘাম বিক্রি করতে বাধ্য করেছে গিগ শ্রমিকদের। শ্রমের বাজারের বিপুল অংশকে টেনে হিচড়ে প্রথগত শ্রমিক-মালিক সম্পর্কের বাইরে নিয়ে গেছে এই সরকার। আর বহুজাতিক সব বড় বড় কর্পোরেট কোম্পানিগুলোকে দিয়েছে বেলাগাম লুঠের সুযোগ।
এই মুহূর্তে তাই পুঁজির মালিকের উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রন এবং শ্রমশক্তিকে নিরাপত্তা দানে রাষ্ট্রের ভূমিকার প্রশ্নদু’টি সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হিসেবে উপস্থিত হয়েছে। শ্রম-পুঁজির চিরাচরিত দ্বন্দ্বে আজ এটাই ফোকাল পয়েন্ট। এবারের মে দিবস শ্রমিকশ্রেণির সামনে এই দুই প্রশ্নে সংগ্রাম জোরালো করার ডাক দিচ্ছে। বিশ্বের বহু দেশের মতো আমাদের দেশেও বহু রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে অর্জিত শ্রমিকশ্রেণি শ্রম আইনের অধিকারগুলিকে কেড়ে মোদি-সরকার যে চারটে শ্রম-কোড বানিয়েছে, সেগুলি প্রত্যাহার করানোর জন্য নির্নায়ক ভূমিকা পালনের ঐতিহাসিক কর্তব্য স্থির করেছে।
দেশের অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। এই রাজনৈতিক সংগ্রামের ফলাফলে বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নেরই ফয়সলা হবে। আগামী দিনে সুইগী, জোমাটো, ওলা, উবেরের মতো কোম্পানীগুলোকে নিয়ন্ত্রণের জন্যে মালিক, শ্রমিক ও সরকারপক্ষের প্রতিনিধিদের নিয়ে ‘গিগ কর্মী কল্যান পর্ষদ’-এর মতো কোনও সংস্থা তৈরির উদ্যোগ নেবে কিনা দেশের সংসদ, তা ঠিক হবে সংসদে বামপন্থীদের শক্তি কতটা বাড়ছে তার উপরে। শ্রমিক বিরোধী শ্রমকোডগুলি লাগু হবে নাকি বাতিল হবে তা ঠিক হবে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটকে ক্ষমতাচ্যুত করা যাচ্ছে কিনা তার উপরে। ঠিকা ও চুক্তিভিত্তিক শ্রমিকদের স্থায়ীকরণ এবং স্থায়ীকরণ সাপেক্ষে সমকাজে সমমজুরি চালু হবে কিনা তা ঠিক হবে দেশের পার্লামেন্টে শ্রেণি শক্তির ভারসাম্যের পরিবর্তনের উপর। স্বাভাবিক কারণেই কর্পোরেটের চ্যানেলে উগ্র সাম্প্রদায়িকতার প্রচারকে বানচাল করে জয়, তন্ময়, নূর-এর দায়িত্ব, ঐক্যবদ্ধভাবে এই নীতিঅভিমুখ বদলের লড়াইতে সামিল হওয়া।
বিজেপিকে ক্ষমতাচ্যুত করা এবং সংসদে বামপন্থীদের শক্তিবৃদ্ধি করার রাজনৈতিক দায়িত্ব পালনে শ্রমিকশ্রেণিকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। এটা সময়ের দাবি।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন