অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনের মধ্যেই এসেছে এবারের মেদিবস। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতন্ত্র ভারতের কেন্দ্রে সরকার গড়ার নির্বাচনের দুটি পর্যায় ইতিমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে। আরও পাঁচটি পর্যায় বাকি। প্রায় ৯৬ কোটি ৮৮ লক্ষ ভোটার এই সরকার গড়ার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করবেন। এই ভোটারদের মধ্যে ৪০ কোটির বেশি হচ্ছে শ্রমিক।
“কাজের ঘণ্টা কমাবার আন্দোলনের সঙ্গে মে দিবসের জন্ম-কাহিনি অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে” - মহান আমেরিকান কমিউনিস্ট আলেকজান্ডার ট্রাকটেনবার্গ তাঁর বিখ্যাত ‘মে দিবসের ইতিহাস' পুস্তকটি লেখা শুরু করেছিলেন এই বাক্যটি দিয়ে। বাস্তবিকই দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের সীমার জন্য দেশে দেশে লড়াই-ই মে দিবসের ইতিহাসের অক্ষরমালা তৈরি করেছিল। সম্ভবত দৈনিক শ্রমদিন আটঘণ্টার আইনি স্বীকৃতিই পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রমিকদের লড়াইয়ে অর্জিত প্রথম শ্রমআইন।
**
আমাদের দেশে স্বাধীনতার আগে আটঘণ্টার আইন সেভাবে কার্যকর ছিল না। স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেক স্বপ্ন সাকার না-পেলেও বহু শ্রমআইন স্বাধীন ভারতে শিল্প-বাণিজ্য ক্ষেত্রে কার্যকর করতে বাধ্য হয়েছিল মালিকপক্ষ। শ্রমিকদের ধারাবাহিক আন্দোলনের মধ্যদিয়ে এটা সম্ভব হলেও দেশের সরকারের যে একটা সদিচ্ছা ছিল সেটা অস্বীকার করা যাবে না। বিশেষকরে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের প্রসার শ্রমআইন মান্যতা দেওয়ার একটা শক্তিশালী ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল, এবং দেশের তুলনায় সামান্য হলেও তা হাজার হাজার শ্রমিকের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটিয়েছিল। ন্যূনতম মজুরি, ভবিষ্যনিধি প্রকল্প, পেনশন সহ অন্যান্য সামাজিক সুরক্ষার বিষয়গুলিকে আলোচনার অ্যাজেন্ডায় রাখতে কার্যত বাধ্য হয়েছিল দেশের সরকার এবং শিল্প-বাণিজ্য মহল। একটা রাষ্ট্রীয় নজরদারি ব্যবস্থাও তৈরি করা হয়েছিল। শ্রমিক আন্দোলনের ওপর বিভিন্নভাবে রাষ্ট্রীয় দমনপীড়ন থাকলেও শ্রমিকদের সংগঠন করার এবং যৌথদরকষাকষির অধিকারও শক্তিশালীভাবেই স্বীকৃত ছিল। এটাও সত্য যে, লক্ষ লক্ষ শ্রমিক শ্রমআইনের বাইরে থেকেই সেসময়ে তাঁদের কর্মজীবন শেষ করতেন। এই সমস্ত নেতিবাচক ইতিবাচক বিষয়ের সামগ্রিক বিচারে স্বাধীন ভারতে শ্রমক্ষেত্রে যতটা অগ্রসর হওয়া গিয়েছিল তার উলাটপুরাণ শুরু হয় ১৯৯১ সালে দেশে উদারঅর্থনীতির যুগ শুরু হওয়ার পর থেকেই। যে নীতির অন্যতম প্রধান বিষয় ছিল— শিল্পবাণিজ্য ও পরিষেবা ক্ষেত্র থেকে সরকারের নিয়ন্ত্রণ, মালিকানা উঠিয়ে নাও; বিশ্ববাজারে ব্যাবসাবাণিজ্যকে আরও প্রতিযোগিতামূলক করতে শ্রমআইন শিথিল করো এবং সমস্ত সামাজিক ক্ষেত্র থেকে সরকারের দায়িত্ব আস্তে আস্তে কমাও।
**
গত ৩২-৩৩ বছরে ভারতের আর্থ-সামাজিক জীবন এই আর্থিক নীতির প্রবাহের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গেছে। এই সময়-পর্বে সাত-সাতটা লোকসভার নির্বাচন হয়েছে, নটা সরকার দেশের মানুষ পেয়েছেন। এই নীতিপ্রবাহ কখনও গতি পেয়েছে, কখন আবার মন্থর হয়েছে। কোনো শাসকদল, কোনো সরকারই এই পরিমণ্ডল থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেনি। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিও এর থেকে বেরিয়ে আসার অনুকূল অবস্থা তৈরি করতে পারেনি। যদিও দেশের এই রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের মধ্যে দাঁড়িয়ে এই নীতি পরিবর্তনকে তাদের লড়াই-আন্দোলনের মূল অ্যাজেন্ডা করেছে কমিউনিস্ট এবং বামপন্থী দলগুলি। রাজনৈতিক দিকদিয়ে ক্ষুদ্র শক্তি হলেও এরা এই নীতি-পরিকাঠামোর মধ্যেই একটা বিকল্প হাজির করার চেষ্টা করেছে। কমিউনিস্ট ও বামদলগুলির এই লড়াই-আন্দোলন এবং যেখানে সুযোগ মিলেছে কার্যক্ষেত্রে বিকল্পের অনুশীলন উদারনীতির রথের রসিকে কিছুটা লাগাম টেনেছিল। কমিউনিস্ট এবং বামপন্থীদের এই ভূমিকা ভারতের ক্ষেত্রে আশীর্বাদ না অভিশাপ তা-নিয়ে বিতর্ক অবশ্যই থাকতে পারে। কিন্তু একথা-তো অস্বীকার করা যাবে না, তাঁদের এই ভূমিকাই ২০০৮ সালে বিশ্বজুড়ে আর্থিক ক্ষেত্রে যে মন্দা দেখা গিয়েছিল, একেরপর এক আর্থিক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়েছিল — তা ভারতকে স্পর্শ করতে পারেনি। বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদরাও এই কৃতিত্ব সেসময়ে দেশের কমিউনিস্ট এবং বামপন্থীদেরই দিয়েছিলেন। দেশে এখনও যেটুকু রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র অবশিষ্ট আছে, তা সম্ভব হয়েছে কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের নেতৃত্বে ধারাবাহিক ঐক্যবদ্ধ শ্রমিক আন্দোলনের ফলেই। গত তিন দশকে উদারনীতির সবচেয়ে বড় শিকার দেশের কৃষিক্ষেত্র। ফসলের দাম না-পেয়ে, ঋণের বোঝায় তিন লক্ষেরও বেশি কৃষক -খেতমজুর আত্মহত্যা করেছে। মানবতার প্রতি এরথেকে বড় অবমাননা স্বাধীন ভারতে আর কিছু হয়নি। দেশের শ্রমজীবী মানুযের সবচেয়ে বড় অংশ হলো গরিব-প্রান্তিক কৃষক এবং খেতমজুররা। দেশের কৃষিক্ষেত্র যে এখনো করপোরেটদের হাতে চলে যায়নি, তা শুধুমাত্র সম্ভব হয়েছে বামপন্থীদের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ কৃষক আন্দোলনের জন্যই।
**
২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচন থেকেই সংসদে কমিউনিস্ট এবং বামপন্থীদের শক্তি ক্রমান্বয়ে কমেছে, বর্তমানে স্বাধীন ভারতে তা সর্বনিম্ন অবস্থায় পৌঁছেছে। তবে এটাও বাস্তব, সংসদে শক্তি কমলেও গত পাঁচ-ছয় বছরে সংসদের বাইরে কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের নেতৃত্বে কৃষক এবং শ্রমিক আন্দোলনের জোর অনেকটাই বেড়েছে। সংসদে কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের শক্তি হ্রাস যেমন রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদের বেসরকারিকরণের গতিকে তীব্রতা দিয়েছে, ঠিক একইভাবে যে শ্রমক্ষেত্রে এতদিন শাসকশ্রেণি হাত দিতে পারেনি তার সংস্কারে উদ্যোগী হয়েছে দ্বিতীয় মোদি সরকার। ব্যবসাবাণিজ্যকে আরও সহজ করার কথা বলে দেশে চালু ২৯টা শ্রমআইনকে চারটি শ্রমবিধির আওতায় নিয়ে এসেছে মোদি সরকার। এই শ্রমবিধির ফলে ন্যূনতম মজুরি, শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা, স্থায়ী চাকরি এবং বিশেষকরে আট ঘণ্টার শ্রমদিনের মতো বিষয়গুলির আর কোনো গুরুত্ব থাকবে না। এই শ্রমবিধি-বলে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের যা-খুশি মজুরি দিতে পারবে, কোনো সামজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা তাদের করতে হবে না; কর্মক্ষেত্রে কোনো নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করলেও তা দেখার নজরদারির পরিকাঠামো থাকবে না এবং সর্বোপরি শ্রমিকদের দৈনিক ১০-১২ ঘণ্টা কাজ-করানোর ছাড়পত্র মিলবে। আর স্থায়ী চাকরির কোনো বালাই থাকবে না। ঠিকাদারি প্রথা বাধাহীনভাবে চলবে। বলা যায়, এই শ্রমবিধি কার্যকর হওয়া শুরু হলে দেশের শ্রমক্ষেত্রে মধ্যযুগীয় বর্বরতা নেমে আসবে।
**
সিপিআই(এম)’র নির্বাচনী ইশতেহার ছাড়া অন্য কোনো জাতীয় দলের ইশতেহারে শ্রমবিষয়ক এই ইস্যুগুলি স্থান পায়নি। সিপিআই(এম) ইশতেহারে চার শ্রমবিধি বাতিল, ২৬,০০০ টাকা ন্যূনতম মাসিক মজুরি, পেনশন বৃদ্ধি, ঠিকাদরিপ্রথা বাতিল প্রভৃতি বিষয়গুলি আলোচনা করেছে। এটাই স্বাভাবিক, কেননা, শ্রেণিগত দিকদিয়ে এই ইস্যুগুলি তাদের অন্যতম বুনিয়াদি দাবি। বর্তমানে এমজিএন রেগা প্রকল্পে দেশের সবচেয়ে বেশি শ্রমশক্তি নিযুক্ত। কংগ্রেস রেগায় বরাদ্দ বৃদ্ধির কথা শুধু উল্লেখ করেছে তাদের ইশতেহারে। সিপিআই(এম) এক্ষেত্রেও একটা উল্লেখযোগ্য সংযোজন ঘটিয়েছে। তারা এ প্রকল্পে বছরে ২০০ দিন এবং মজুরি বাড়িয়ে দৈনিক ৬০০ টাকা করার কথা বলেছে।
**
২০১৯ সালের তুলনায় দেশে ৮% ভোটার বেড়েছে। কিন্তু গত পাঁচ বছরে দেশে শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা প্রায় এক জায়গায় রয়ে গেছে, সিএমআইই-র হিসাব অনুযায়ী সংখ্যাটা ৪০ কোটির আসেপাশে। এই তথ্য দেশের অর্থনীতির এক নেতিবাচক দিককেই ইঙ্গিত করছে। কেন্দ্রীয় সরকারের নিজের তথ্য বলছে, রেগায় কাজ করতে ইচ্ছুক ১৪% কর্মপ্রার্থী কাজের আবেদন করেও কাজ পায়নি। এতো অদক্ষ শ্রমজীবী অংশের ছবি। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা এবং দি ইনস্টিটিউট অব হিউম্যান ডেভেলপমেন্টের রিপোর্ট বলছে, দেশে ২০২২ সালে ৬৫.৭% স্নাতক কর্মহীন।
দেশে গত পাঁচ বছরে উন্নয়নের যে ঢাকই মোদি সরকার পেটাক না কেন তা নতুন কাজ তৈরি করতে যে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে তা এখন দিনের আলোর মতো পরিষ্কার।
নতুন কাজ তৈরি, শ্রমসম্পর্কিত বিষয়গুলির সম্মানজনক সমাধানই দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। এগুলিই দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াবে, দেশের বাজারকে সম্প্রসারিত করবে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার জীবনীশক্তিও এর মধ্যেই নিহিত। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে দেশের বুর্জোয়া দলগুলির নির্বাচনী অ্যাজেন্ডায় বিষয়গুলি স্থান পাচ্ছেনা। কমিউনিস্ট এবং বামদলগুলি তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী নির্বাচনী প্রচারে বিষয়গুলি তুলে ধরছে, যদিও তা দেশজুড়ে মানুষের ভাবনাজগতে প্রভাব সৃষ্টি করার জন্য যথেষ্ট নয়।
নির্বাচনে যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, দেশের শ্রমিকদের বড় অংশের ভোট তাদের পেতে হবে। কিন্তু নির্বাচনী প্রচারে তাদের ইস্যুগুলিই উপেক্ষিত হচ্ছে বেশি। আরএসএস-বিজেপি নির্বাচনী বৈতরণী পেরতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, মন্দির-মসজিদ প্রসঙ্গকে ক্রমশ বেশিবেশি করে আঁকড়ে ধরছে। যা তাদের ফ্যাসিস্ত রাজনীতির ভীতকেই মজবুত করতে সাহায্য করবে। যদি নির্বাচনী প্রচারে দেশজুড়ে জোরের সাথে শ্রমজীবী মানুষের এই ইস্যুগুলিকে তুলে ধরা যেত তা সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে পরাস্ত করতে বিশেষ সহায়ক হতো। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শক্তিশালী হতো।কেন না তাঁরাই ভোটারদের মধ্যে সর্ববৃহৎ অংশ। এটা যে দরকার অনুযায়ী করা যাচ্ছে না, তা আমরা সবাই অনুভব করছি। ভারতের ক্ষেত্রে এবারের মেদিবসে এটাই মনে হয় সবচেয়ে বড় আক্ষেপের বিষয়।
(লেখক দেশহিতৈষী পত্রিকার বিশিষ্ট সাংবাদিক। মতামত লেখকের ব্যক্তিগত।)
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন