আর ঠিক ১৪ দিনের মাথায় কর্ণাটক বিধানসভা নির্বাচন। ২২৪ আসন বিশিষ্ট এই বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজন ১১৩ আসন। আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে কর্ণাটকে কারা ক্ষমতায় আসবে তা জানার জন্য অপেক্ষা করতে হবে ১৩ মে, শনিবার পর্যন্ত। ভোটের আগে যতই হিসেবনিকেশ হোক না কেন, চূড়ান্ত ফলাফলের দিনেই একমাত্র জানা যাবে কংগ্রেস অথবা বিজেপি – আগামী পাঁচ বছরের জন্য কে হবে শাসক, আর কেই বা হবে বিরোধী।
কর্ণাটকের বিগত কয়েকটা নির্বাচনের দিকে চোখ রাখলে দেখা যাবে প্রায় প্রতি পাঁচ বছরেই ক্ষমতার বদল হয়েছে। ২০১৮-ও ব্যতিক্রম নয়। যদিও মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই জেডি(এস) কংগ্রেস জোট সরকারকে ক্ষমতা থেকে হঠাতে মাঠে নামে নামে অপারেশান লোটাস বাহিনী। দল ভাঙাভাঙির খেলায় রাতারাতি ক্ষমতা হারাতে হয় জোট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী এইচ ডি কুমারস্বামীকে।
অবশ্য এর আগে এইচ ডি কুমারস্বামীও একইভাবে দল ভাঙিয়ে বিজেপির সহায়তায় কংগ্রেসের সঙ্গে চলা জোট সরকার ভেঙে মুখ্যমন্ত্রী হন। সেটা ২০০৬ সাল। ২০০৪-এর কর্ণাটক বিধানসভা নির্বাচনে ২২৪ আসনের মধ্যে কংগ্রেস পায় ৬৫ আসন। বিজেপি পায় ৭৯ আসন এবং ৫৮ আসন পায় জেডিএস। কংগ্রেস জেডিএস জোট সরকার ক্ষমতায় বসে। মুখ্যমন্ত্রী হন কংগ্রেসের ধরম সিং। যদিও ২০০৬ সালের শুরুতেই সমর্থন প্রত্যাহার করে জেডিএস এবং বিজেপির সঙ্গে জোট বেঁধে মুখ্যমন্ত্রী হন এইচ ডি কুমারস্বামী। রফা হয় ২০ মাস তিনি মুখ্যমন্ত্রী থাকবেন এবং ২০ মাস মুখ্যমন্ত্রী হবেন বিজেপির ইয়েদুরিয়াপ্পা। যদিও নির্ধারিত ২০ মাস শেষে ক্ষমতা ছাড়তে অস্বীকার করেন কুমারস্বামী। যার জেরে সরকার পড়ে যায় এবং রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয়।
২০০৮-এর নির্বাচনে ৩৩.৮৬ শতাংশ ভোট পেয়ে ১১০ আসন পায় বিজেপি। ৩৪.৭৬ শতাংশ ভোট পেয়েও মাত্র ৮০টি আসনে জয়লাভ করে কংগ্রেস। জেডিএস জয়ী হয় ২৮টি আসনে। যদিও এই পাঁচ বছরের শাসনে তিন বার মুখ্যমন্ত্রী বদল করতে হয় বিজেপিকে। জমি কেলেঙ্কারিতে নাম জড়ানোয় জুলাই ২০১১ তে ইস্তফা দিতে বাধ্য হন বি এস ইয়েদুরিয়াপ্পা। তাঁর জায়গায় মুখ্যমন্ত্রী হন ইয়েদুরিয়াপ্পা ঘনিষ্ঠ ডি ভি সদানন্দ গৌড়া। এর মাত্র ১১ মাস পরেই গোষ্ঠীকোন্দলের জেরে পদত্যাগ করতে হয় গৌড়াকে এবং মুখ্যমন্ত্রী হন জগদীশ শেট্টার।
২০১৩ সালের নির্বাচনে আবার পালাবদল। এবার ৩৬.৬ শতাংশ ভোট পেয়ে ১২২ আসনে জয়ী হয় কংগ্রেস। ১৯.৯ শতাংশ ভোট পেয়ে ৪০ আসন পায় বিজেপি এবং ২০.২ শতাংশ ভোট পেয়ে ৪০ আসনে জয়ী হয় জেডিএস।
২০১৮ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি ৩৬.৩৫ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হয় ১০৪ আসনে। ৩৮.১৪ শতাংশ ভোট পেয়ে কংগ্রেস জয়ী হয় ৮০ আসনে এবং ১৮.৭ শতাংশ ভোট পেয়ে জেডিএস জয়ী হয় ৩৭ আসনে। কংগ্রেস জেডিএস জোট সরকার ক্ষমতাসীন হয়। যদিও ২০১৯-এর জুলাই মাসে এই সরকার পড়ে যায় এবং অপারেশান লোটাসের পর ক্ষমতাসীন হয় বিজেপি।
তাৎপর্যপূর্ণভাবে কর্ণাটক বিধানসভার শেষ গোটা পাঁচেক নির্বাচনে মাত্র দু’বার ছাড়া কোনো দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। নির্বাচন পরবর্তী সময়ে হয় জোট সরকার হয়েছে নয়তো দল ভাঙিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ১৯৯৯ এবং ২০১৩ সালে কংগ্রেস এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। এছাড়া যে দুবার কংগ্রেস জোট করে সরকার গঠনের চেষ্টা করে (২০০৪ এবং ২০১৮) দু’বারই কংগ্রেস পাঁচ বছর ক্ষমতায় টিকতে পারেনি। কিছুদিনের মধ্যেই সরকার ভেঙে যায়।
কর্ণাটকের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে ফলাফল কী হতে পারে তা নিয়ে ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি জনমত সমীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। আবার বিবিসির নামে ভুয়ো সমীক্ষা রিপোর্টও বেরিয়েছে। যে সমীক্ষার ফলাফলে দাবি করা হয়েছিল বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে এবং পরে যে সমীক্ষা আদৌ হয়নি বলে জানা গেছে।
কর্ণাটক নির্বাচন প্রসঙ্গে সর্বশেষ যে জনমত সমীক্ষার ফলাফল জানা গেছে তা প্রকাশ করেছে টিভি৯-সি ভোটার। যে সমীক্ষা অনুসারে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে প্রায় ৪০ শতাংশ ভোট পেয়ে কংগ্রেস পেতে পারে ১০৬ থেকে ১১৬ আসন। ৩৩.৯ শতাংশ ভোট পেয়ে বিজেপি পেতে পারে ৭৯ থেকে ৮৯ আসন এবং ১৮.৮ শতাংশ ভোট পেয়ে জেডিএস পেতে পারে ২৪ থেকে ৩৪ আসন। অন্যান্যরা ৭.৩ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হতে পারে ০ থেকে ৫টি আসনে।
লোক পোল-এর করা সমীক্ষার ফলাফল অনুসারে ৩৯ থেকে ৪২ শতাংশ ভোট পেয়ে কংগ্রেস পেতে পারে ১২৮ থেকে ১৩১ আসন, ৩৩ থেকে ৩৬ শতাংশ ভোট পেয়ে বিজেপি পেতে পারে ৬৬ থেকে ৬৯ আসন এবং ১৫ থেকে ১৮ শতাংশ ভোট পেয়ে জেডিএস পেতে পারে ২১ থেকে ২৫ আসন।
কর্ণাটক নির্বাচন নিয়ে সমীক্ষা করেছে এশিয়ানেট সুবর্ণ নিউজ। এই সংস্থার করা জন কী বাত সমীক্ষা অনুসারে বিজেপি পেতে পারে ৯৮ থেকে ১০৯ আসন এবং কংগ্রেস পেতে পারে ৮৯-৯৭ আসন। জেডিএস পেতে পারে ২৫-২৯ আসন।
এডিনার করা ভোট পূর্ববর্তী সমীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে, এই নির্বাচনে প্রধান ইস্যু হিসেবে ৬৮ শতাংশ ভোটার বিবেচনা করছেন দুর্নীতিকে। মূল্যবৃদ্ধিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন ৪৭ শতাংশ, বেকারিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন ৩৪ শতাংশ, মহিলাদের নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন ১৩ শতাংশ, পানীয় জল এবং বিদ্যুতের সমস্যাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন ১৩ শতাংশ, স্বাস্থ্য এবং শিক্ষাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন ১২ শতাংশ এবং ১০ শতাংশর কাছে গুরুত্বপূর্ণ অপরাধ, হিংসা ইত্যাদি। উল্লেখ্যযোগ্যভাবে এবারের কর্ণাটক বিধানসভা নির্বাচনের আগে যেভাবে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার ঝড় উঠেছে তা বিগত কয়েক বছরে দেখা যায়নি। সেইদিক থেকে বিচার করলে এবারের নির্বাচনে বিজেপির পক্ষে ক্ষমতায় ফেরা কিছুটা অসম্ভব।
এডিনার-ই করা অন্য এক সমীক্ষার ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, কর্ণাটকের ভোটারদের ৬৭ শতাংশ বাসবরাজ বোম্মাই সরকারকে আর সুযোগ দিতে রাজী নন। এমনকি বিজেপি সমর্থকদের একটা বড়ো অংশ বোম্মাইকে আর মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে চাইছেন না।
কোন সরকার সবথেকে দুর্নীতিগ্রস্ত এই প্রশ্নের উত্তরে ৩৩ শতাংশ জানিয়েছেন বাসবরাজ বোম্মাইয়ের না, ১৪ শতাংশ জানিয়েছেন বি এস ইয়েদুরিয়াপ্পার নাম, ১২ শতাংশ বলেছেন সিদ্দারামাইয়ার নাম, ৮ শতাংশ বলেছেন এইচ ডি কুমারস্বামীর নাম এবং ৭ শতাংশ বলেছেন জানিনা। অন্যদিকে ৮ শতাংশ বলেছেন সকলেই দুর্নীতিগ্রস্ত এবং ১৮ শতাংশ বলেছেন কেউ দুর্নীতিগ্রস্ত নয়।
এবারের কর্ণাটক বিধানসভা নির্বাচনে দুর্নীতিকেই মূল ইস্যু হিসেবে তুলে ধরেছে কংগ্রেস। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা। ২০১৯ সালের অপারেশান লোটাস করে কংগ্রেস জেডিএস সরকার ফেলে দেওয়াকে এবং বিধায়ক কেনা বেচাকে অনেকেই ভালোভাবে নেননি। অন্যদিকে দলীয় গোষ্ঠীকোন্দল, একাধিক হেভিওয়েট নেতার নামের সঙ্গে দুর্নীতির যোগ, ইয়েদুরিয়াপ্পাকে মুখ্যমন্ত্রীত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া এবং বেশ কিছু প্রভাবশালীর মনোনয়ন না পাওয়া বিজেপিকে এবারের নির্বাচনে ভালোরকম বেগ দেবে।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন