কর্ণাটক বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির পরাজয়ের পর দলীয় স্তরে হারের ময়নাতদন্ত চলবে। কর্ণাটকে বিজেপির পরাজয়ের পেছনে একাধিক কারণ থাকলেও সবথেকে বড়ো কারণ সম্ভবত ছিল প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা, দুর্নীতি এবং ভেদাভেদের রাজনীতির বিরোধিতায় সাধারণ মানুষের এককাট্টা হওয়া। এছাড়াও বর্ষীয়ান বিজেপি নেতা বি এস ইয়েদুরিয়াপ্পাকে মুখ্যমন্ত্রীত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া, লক্ষণ সাবাদি, জগদীশ শেট্টারকে মনোনয়ন না দেওয়ায় লিঙ্গায়েত ভোটের বড় অংশ বিজেপির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
কংগ্রেস তথা রাহুল গান্ধীর কৃতিত্বকে কোনোরকমভাবে ছোটো না করেও বলা যায়, শুধুমাত্র ভারত জোড়ো যাত্রা বা কংগ্রেসের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়ার কারণে এই ফল ভেবে নেওয়াটা খুবই সরলীকরণ হয়ে যাবে। তীব্র প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা এবং মেরুকরণের রাজনীতির বিরোধিতার কারণেই কিন্তু এবার রাজ্যের ২৪ জন মন্ত্রীর মধ্যে ১২ জনই পরাজিত হয়েছেন।
কর্ণাটকের সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনে মানুষের ভোটদানের গতিপ্রকৃতি থেকে এটা স্পষ্ট, মানুষ কোনোভাবেই বিজেপিকে ক্ষমতায় চায়নি। এমনকি জেডিএস-কেও ততটা গুরুত্ব দেয়নি। গতবারের কংগ্রেস জেডিএস জোট সরকারকে যেভাবে অপারেশন লোটাসের মাধ্যমে ফেলে দেওয়া হয়েছিল তাও সাধারণ যে মানুষ ভালোভাবে নেয়নি, তা এবারের ফলাফল থেকেই স্পষ্ট। সে কারণেই ২০১৮ বিধানসভা নির্বাচনের ১০৪ থেকে এবার বিজেপির ৬৬ তে নেমে যাওয়া। অর্থাৎ বিজেপির আসন কমেছে ৩৮টি। অন্যদিকে গতবারের নির্বাচনে কংগ্রেস জয়ী হয়েছিল ৮০টি আসনে। যা এবার বেড়ে হয়েছে ১৩৫। অর্থাৎ অতিরিক্ত ৫৫টি আসন লাভ। একইভাবে গতবারের ৩৭ আসন থেকে একধাক্কায় ১৮ আসন কমে ১৯-এ নেমে আসা জেডিএস-এর ওপরেও যে মানুষ ভরসা রাখেনি এই ফলাফলই তার প্রমাণ।
নির্বাচন কমিশনের হিসেব অনুসারে এবারের নির্বাচনে কংগ্রেস পেয়েছে ৪২.৮৮ (১,৬৭,৮৯,২৭২ ভোট) শতাংশ ভোট এবং বিজেপি পেয়েছে ৩৬ (১,৪০,৯৬,৫২৯ ভোট) শতাংশ ভোট। জেডিএস-এর ঝুলিতে ১৩.২৯ (৫২,০৫,৪৮৯ ভোট) শতাংশ ভোট। ২০১৮ বিধানসভা নির্বাচনের সঙ্গে তুলনা করলে বিজেপির ভোট কমেছে মাত্র .৩৫ শতাংশ। অর্থাৎ ক্ষমতা হারালেও বিজেপি কিন্তু নিজেদের ভোট ব্যাঙ্ক কার্যত অটুট রেখেছে।
অন্যদিকে কংগ্রেসের ভোট বেড়েছে ৪.৭ শতাংশ। জেডিএস-এর ভোট কমেছে ৫.০১ শতাংশ। নিতান্ত সরল পাটিগণিত অনুসারে বিজেপির ভোট কমেছে খুবই সামান্য বা কমেইনি বলা যেতে পারে। অন্যদিকে শতাংশের বিচারে জেডিএস-এর কমে যাওয়া ভোটের প্রায় পুরো অংশটাই ঢুকেছে কংগ্রেসের ঝুলিতে। তাৎপর্যপূর্ণভাবে ২০১৮ কর্ণাটক বিধানসভা নির্বাচনে নোটায় ভোট পড়েছিল ০.৯ শতাংশ বা ৩,২২,৮৪১। যা এবারে কমে হয়েছে ০.৬ শতাংশ বা ২,৬৯,৭৬৩। নোটায় ভোট কমা থেকেও এটা স্পষ্ট যে মানুষ পক্ষ অবলম্বন না করে ভোট নষ্ট করতে চাননি।
কর্ণাটকে এবারের ক্ষমতা বদলে তাৎপর্যপূর্ণভাবে ৩১টি জেলার আসন প্রাপ্তিতে অনেকটাই হেরফের ঘটলেও ব্যতিক্রম হিসেবে রয়ে গেছে উদুপি জেলা। যে জেলার ৫টি আসনের মধ্যে সবকটিতেই গতবারের মত এবারও জয়ী হয়েছে বিজেপি। রাজ্য জুড়ে বিজেপি বিরোধী ঝড়ের মধ্যেও একমাত্র উদুপি পুরোপুরি সাথ দিয়েছে বিজেপিকে। এছাড়াও বেঙ্গালুরু শহরাঞ্চলের ভোটাররা কংগ্রেসের তুলনায় বিজেপির প্রতি বেশি আস্থা রেখেছেন। এই জেলার ২৮টি আসনের মধ্যে এবার বিজেপি জয়ী হয়েছে ১৬ আসনে এবং কংগ্রেস ১২টিতে। ২০১৮ নির্বাচনের ফলাফলে বিজেপি পেয়েছিল ১৫টি এবং কংগ্রেস ১১টি। ২ আসনে জয়ী হয়েছিল জেডিএস।
দক্ষিণ কান্নাডার ৮ আসনের মধ্যে এবারও বিজেপি পেয়েছে ৬টি আসন। কংগ্রেস ২। যা গতবারে ছিল ৭ এবং ১। অন্যদিকে বিদর-এ গতবার ৬ আসনের মধ্যে কংগ্রেস ৪ আসনে জয়ী হলেও এবার সেই আসন কমে হয়েছে ২। বিজেপি ১ থেকে বেড়ে হয়েছে ৪। গতবার বেশ কয়েকটি জেলায় ভালো সংখ্যায় আসন পেলেও এবার একমাত্র হাসান ছাড়া আর কোথাওই জেডিএস-এর ফল ভালো হয়নি। এই জেলায় ৭ আসনের মধ্যে ৪টিতে জয়ী হয়েছে জেডিএস। এছাড়া মান্ডয়া, মাইসুরু, রামনগর – সব জেলাতেই জমি হারিয়েছে জেডিএস।
এবারের নির্বাচনে মাইসুরু কর্ণাটক-এর ৫৭ আসনের মধ্যে কংগ্রেস পেয়েছে ৩৬, বিজেপি ৫ এবং জেডিএস ১৪। কিট্টুরু কর্ণাটক-এর ৫০ আসনের মধ্যে কংগ্রেস ৩৩, বিজেপি ১৬ এবং জেডিএস ১। কল্যাণ কর্ণাটক-এর ৪১ আসনের মধ্যে কংগ্রেস ২৬, বিজেপি ১০ এবং জেডিএস ৩। মধ্য কর্ণাটক-এর ২৫ আসনের মধ্যে কংগ্রেস ১৯, বিজেপি ৫ এবং জেডিএস ১। এছাড়া যে দুটি অঞ্চল বাকি পড়ে থাকে সেই কারাবল্লী কর্ণাটক-এর ১৯ আসনের মধ্যে কংগ্রেস ৬ ও বিজেপি ১৩ এবং গ্রেটার বেঙ্গালুরুর ৩২ আসনের মধ্যে কংগ্রেস ১৫ এবং বিজেপি ১৭ আসনে জয়ী হয়েছে। এই দুই অঞ্চলে জেডিএস কোনো আসন পায়নি।
কর্ণাটক বিধানসভা নির্বাচনের বিজেপির পর্যুদস্ত হবার পর আগামী ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে ফলাফল কী হবে তা এখনই বলা সম্ভব নয়। বলা সম্ভব নয় নভেম্বর ডিসেম্বরে মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তিশগড়, তেলঙ্গানা নির্বাচনের ফলাফল কী হবে। তবে দেশে বিজেপি বিরোধী রাজনীতির ক্ষেত্রে, প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার ক্ষেত্রে এই জয় নিঃসন্দেহে বিরোধী শিবিরকে নতুন অক্সিজেন দেবে তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। সেক্ষেত্রে কংগ্রেস তথা সমগ্র বিরোধী শিবিরের কাছে কর্ণাটকের জয়ের ধারা দেশজুড়ে ধরে রাখা নিঃসন্দেহে এক বড়ো চ্যালেঞ্জ হতে চলেছে।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন