‘Lesser Evil’-এই শব্দবন্ধের সঙ্গে ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের প্রেক্ষিতে ঘনিষ্ঠ পরিচয় আছে পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দাদের। আশ্চর্যজনক ভাবে, সুদূর ইউরোপে ২০২২ সালের সাম্প্রতিক ফরাসী নির্বাচনেও উঠে এল একই শব্দবন্ধ – ‘Lesser Evil’ বা ফরাসী ভাষায় ‘le moindre mal’। নির্বাচনী বিশেষজ্ঞদের মতে, গত ২৪ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ফরাসী রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের দ্বিতীয় রাউন্ডে নব্য-উদারপন্থী রাষ্ট্রপতি এমানুয়েল মাক্রোঁ এবং অতি-দক্ষিণপন্থী মারিন ল্য পেন, এই দুইজনকে পছন্দ করে ভোট দিয়েছেন এমন নির্বাচকের সংখ্যা হাতে গোনা। তাঁদের প্রাপ্ত অধিকাংশ ভোটই আদতে তাঁদের প্রতিপক্ষর বিরুদ্ধে প্রদত্ত ভোট। এর ওপর ২৮% নির্বাচক বিরত থেকেছেন ভোটদান থেকেই।
নির্বাচনে এত স্বল্প সংখ্যক লোক এর পূর্বে একবারই অংশগ্রহণ করেছিল, ১৯৬৯ সালের নির্বাচনে, ফ্রান্সের একদা প্রবল শক্তিশালী কমিউনিস্ট পার্টি নির্বাচন বয়কট করার ফলে। মাক্রোঁর এই বিজয়ে এবং ল্য পেনের পরাজয়ে উদারপন্থীদের উল্লাস ছিল দেখার মতো। কিন্তু আদতে এটি একটি ফাঁপা বিজয়। অর্থনৈতিক নীতির ক্ষেত্রে মাক্রোঁ এবং ল্য পেনের মধ্যে খুবই সামান্য তফাৎ।
২০১৭ সালে ‘প্রগতিশীল’ হিসেবে পরিচয় দিয়ে নির্বাচনে জয় লাভ করলেও গত কয়েক বছরে ভোট লাভের আশায় মাক্রোঁ সামাজিক নীতির ক্ষেত্রে সরেছেন দক্ষিণ থেকে আরও দক্ষিণে। প্রমাণ করেছেন, সামাজিক নীতির ক্ষেত্রে নিজেকে উদারপন্থী বলে দাবী করলেও, আদতে তাঁর কোনো আন্তরিক দায়বদ্ধতা নেই। ফরাসী রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া থেকে বামপন্থী ও প্রগতিশীলদের জন্য ইতিবাচক যদি কিছু থাকে, তবে তার সন্ধান করতে হবে ২৪-শে এপ্রিলের দুই ‘ইভিল’-এর সংঘাত এবং ‘লেসার ইভিল’ নির্বাচনের মধ্যে নয়, গত ১০-ই এপ্রিলের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রথম রাউন্ডের মধ্যে।
গত দুই বছরে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে এমন একটি ভাষ্য গড়ে তোলা হয়েছিল, যে ফ্রান্সে রাষ্ট্রপতি পদের জন্য মূল প্রতিযোগিতা রাষ্ট্রপতি মাক্রোঁ এবং তাঁর অতি-দক্ষিণপন্থী প্রতিদ্বন্দ্বী মারিনের মধ্যেই। এর বাইরে আর কোনো প্রার্থীর দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়ার সম্ভবনা যে থাকতে পারে, এই কথাই মূল ধারার মিডিয়া তুলে ধরতে রাজি ছিল না। যে সব মিডিয়া এর বাইরে আর কোনো প্রার্থীর দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়ার সম্ভবনা উড়িয়ে দেয় নি, তাঁরাও বাজি রেখেছিলেন সদ্য প্রতিষ্ঠিত আরেকটি উগ্র দক্ষিণপন্থী, জাতি বিদ্বেষী দল Reconquête এবং তার নেতা এরিক জেমুরের উপর। কোনো বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব না হলেও এবং কোনোপ্রকার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা না থাকলেও, জেমুর তাই মুফতেই পেয়ে গেলেন বিরাট প্রচার।
এই মিডিয়া লাইমলাইটকে তিনি কাজে লাগালেন তাঁর ফ্যাসিবাদী ভাষ্যর প্রচারে। কমিউনিস্ট সহ ফরাসী র্যাডিক্যাল বামপন্থীদের বক্তব্য ছিল, জেমুরকে আসলে মারিনের মতো অতি দক্ষিণপন্থীরাই উস্কে দাঁড় করিয়েছে, যাতে প্রকাশ্য ফ্যাসিস্ট জেমুরের পাশে ক্রিপ্টো-ফ্যাসিস্ট মারিনকে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হয় এবং আদতে মিডিয়া যেরকম দেখাচ্ছে, জেমুরের সেইরকম জনসমর্থনই নেই। কিছু মিডিয়ার কভারেজে বেসরকারী ভাবে প্রায় ফরাসী রাষ্ট্রপতি ঘোষিত হয়ে যাওয়া এহেন জেমুর প্রথম রাউন্ডের নির্বাচনে মাত্র ৭% ভোট লাভ করে বামপন্থীদের অভিযোগকেই সঠিক প্রমাণ করেছেন।
বাস্তব হল, মিডিয়া যেমন তুলে ধরেছিল, সেইরকম ডান, অতি ডান এবং অতি অতি ডানের মধ্যে ফরাসী রাষ্ট্রপতি নির্বাচন সীমাবদ্ধ থাকেনি। প্রথম রাউন্ডে সর্বোচ্চ ভোট প্রাপক দুই প্রার্থী দ্বিতীয় রাউন্ডের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। ২৭.৮৫% ভোট লাভ করে মাক্রোঁ প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন ছক মাফিকই। মারিনের দ্বিতীয় স্থান অধিকার করার কথা ছিল স্বচ্ছন্দে। তিনি দ্বিতীয় স্থান নাও পেতে পারেন, এমন সম্ভবনার কথা যেসব সংবাদমাধ্যম প্রচার করেছিল তারাও দ্বিতীয় স্থানে মারিন না পেলেও জেমুর পাবেন এই বিষয়ে ছিল প্রায় নিশ্চিত।
বাস্তবে দেখা গেল মারিন পেয়েছেন ২৩.১৫% ভোট এবং দ্বিতীয় স্থানের প্রতিযোগিতায় তাঁর ঘাড়ের কাছেই নিশ্বাস ফেলছেন ২১.৯৫% ভোট পেয়ে র্যাডিক্যাল বাম প্রার্থী জঁ-লুক মেলশোঁ। মারিন দ্বিতীয় রাউন্ডে দুই ইভিলের এক ইভিল হওয়ার সুযোগ পেলেন বটে, কিন্তু সেই প্রাপ্তি এল হাসতে হাসতে নয়, কান ঘেঁসে। যে বামপন্থীদের মিডিয়া ধর্তব্যেই রাখেনি, তারাই আরেকটু হলে পেয়ে যাচ্ছিল দ্বিতীয় স্থান।
মিডিয়ার এই একচোখামি এবং মেলেশোঁর এই অসাধারণ ভালো ফল সত্ত্বেও স্বীকার করা উচিৎ, দ্বিতীয় রাউন্ডে র্যাডিক্যাল বাম প্রার্থীর না যেতে পারার ব্যর্থতা, ব্যর্থতাই। মেলশোঁ যে মাত্র ১.২০% ভোটের জন্য ফরাসী রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের দ্বিতীয় রাউন্ডে যেতে পারলেন না, এ প্রকৃত পক্ষে একটি ঐতিহাসিক সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাওয়া। মাক্রোঁ এবং মারিনের মতো তিনি ব্যক্তিত্বের ভিত্তি লড়াই করতে নামেন নি। সমাজনীতি হোক কি অর্থনীতি, মেলেশোঁ একটি বৈপ্লবিক কর্মসূচীকে সামনে রেখে নির্বাচনে লড়ছিলেন, তাঁর লড়াই ছিল নীতির লড়াই, তাঁর বিকল্প ছিল সত্যিকারের বিকল্প।
অতি-ডান মারিনকে ঠেকাতে বাম ভোটারদের যে একটা অংশ ‘লেসার ইভিল’ মাক্রোঁকে ভোট দিলেন (মেলেশোঁ মাক্রোঁর পক্ষে ভোট দিতে না বললেও দ্বিতীয় রাউন্ডে নিজের সমর্থকদের মারিনকে ভোটদান না করতে অনুরোধ করেছিলেন) আর যে অংশ নির্বাচনে অংশই নিলেন না, তাঁরাও বঞ্চিত হলেন নিজের আদর্শের ভিত্তিতে ভোটদান করার সুযোগ থেকে। ফরাসী কমিউনিস্ট পার্টি সহ অন্যান্য বামপন্থী দলগুলি মিলিত ভাবে আরও ৮% ভোট লাভ করেছে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রথম রাউন্ডে। তাঁরা যদি মেলশোঁর দল ‘La France Insoumise’ (বিদ্রোহী ফ্রান্স) বা LFI-এর সঙ্গে বোঝাপড়ায় আসতেন, বিশেষ করে কমিউনিস্ট পার্টি, যারা পূর্বের দুই নির্বাচনে মেলশোঁকে তাঁদের প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করেছিলেন তাঁরা যদি এবারও তাই করতেন, তাহলে একটি অন্যরকম দ্বিতীয় রাউন্ড প্রায় নিশ্চিত ছিল। তাঁদের এই অনৈক্য এবং ব্যক্তি সংঘাতই দ্বিতীয় রাউন্ডকে দক্ষিণ বনাম অতি-দক্ষিণের লড়াই-এ পরিণত করেছে।
আশার কথা, আসন্ন জুন মাসের আইনসভা নির্বাচনে এই ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে র্যাডিকাল বামপন্থীরা একত্রে লড়াই করার কথা ভাবছেন। এই নির্বাচনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল, যে দুই রাজনৈতিক দল এতদিন ফ্রান্সের শাসন ভার পালা করে গ্রহণ করেছিল, তাদের প্রায় বিলুপ্তি। একদা দোর্দন্ডপ্রতাপ রক্ষণশীল ‘Les Républicains’-এর প্রার্থী মাত্র ৪%-এর কিছু অধিক ভোট পেয়েছেন। অপরদিকে মধ্য বাম সমাজগণতন্ত্রী ‘Parti Socialiste’এর প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট ১%-এর কিছু অধিক, একদা তাঁদের সরকারের ছোটো শরিক কমিউনিস্টদের থেকেও কম।
অর্থনীতিবিদ ব্রুনো অ্যামাবেল একটি সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গীতে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে, ফরাসী জনকল্যাণ রাষ্ট্রের সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর থেকে ক্রমাগত ধ্বংসসাধন ফরাসী সমাজের শ্রেণী বিভাজনকে আরও তীক্ষ্ণ করেছে। এর পূর্বে রিপাব্লিকান এবং সোশ্যালিস্টরা ছিল একই ফরাসী বুর্জোয়া শ্রেণীর এই পিঠ এবং ওই পিঠ। কিন্তু বর্তমানে এই দুই শ্রেণীই সম্পূর্ণ সমর্থন প্রদান করেছে মাক্রোঁ এবং তাঁর প্রকাশ্য, নির্ভেজাল নব্য-উদারনৈতিক অ্যাজেন্ডাকে। একে অ্যামাবেল বলছেন নিও রাইট ব্লক। এর ফলে পূর্বে মধ্য বাম ও মধ্য ডানের যে সমর্থন ছিল, তা সম্পূর্ণ ধ্বসে গেছে।
অপরদিকে মারিন ল্য পেনের সমর্থন মূলতঃ গ্রামীণ, ধর্মপ্রাণ ফ্রান্স এবং অসংগঠিত শ্রমিক শ্রেণীর একাংশ থেকে। ট্র্যাডিশানাল বুর্জোয়া শ্রেণীর একাংশও তাঁকে সমর্থন করে বটে, কিন্তু তাঁদের প্রথম পছন্দ এখনো মাক্রোঁই। মেলশোঁ যে প্রায় ২২% ভোট পেয়েছেন এই ভোট হল মূলতঃ শহর কেন্দ্রিক শ্রমিক শ্রেণীর ভোট। বামপন্থীদের যদি ভোট আরও বাড়াতে হয়, তাহলে তাঁদের ছড়িয়ে যেতে হবে গ্রাম ও মফস্বলের ফ্রান্সে এবং এর পাশাপাশি তাঁদের সংগঠিত করতে হবে অসংগঠিত শ্রমিকদেরও।
অ্যামাবেল মনে করেন, একমাত্র এইরকম একটি পপুলার ব্লক, যা বিকল্প আর্থ-সামাজিক মডেল গড়ে তুলতে সক্ষম, তারাই একমাত্র এই মাক্রোঁর নিও রাইট ব্লকের দক্ষিণপন্থীদের এবং ল্য পেনের অতি দক্ষিণপন্থীদের বাধা দিতে সক্ষম হবে। ভবিষ্যতে নিজেদের মধ্যে বিভেদ ভুলে ফ্রান্সের র্যাডিকাল বামপন্থীরা এইরকম একটি ব্লক নির্মাণ করতে পারেন কিনা, তার উপরেই নির্ভর করছে ফ্রান্স সত্যিকারের একটি বিকল্প পাবে, নাকি তাকে বারবার বেছে নিতে হবে ‘le moindre mal’-এর মধ্যে একটিকে।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন