চৌঠা এপ্রিল, বৃহস্পতিবার বেলা ১১ টা। সূর্যের তাপ মাথার চাঁদি গরম করছে। গরম পায়ের নীচের রাস্তাও। সেই গরমের মধ্যে মুর্শিদাবাদ জেলার ভারত বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া রানিনগর ২ ব্লকের গোধনপাড়া বাজারে হাঁটছে একটা মিছিল।
মিছিলে দু'রকমের ঝান্ডা, কংগ্রেসের আর সিপিআই(এম)’এর। এই মিছিলে দুটি জিনিস নতুন। এপ্রিলের এই মিছিল সম্ভব ছিল না ঠিক ১২ মাস আগেও। কারণ রানিনগর ২ ব্লকের গোধনপাড়া বাজারে নিষিদ্ধ ছিল সিপিআই(এম), কংগ্রেসের পতাকা।
এখানেই ছিল তৃণমূল নেতা শাহ আলম সরকারের রাজত্ব। তৃণমূলের বাহিনীর দখলে ছিল গোধনপাড়া বাজার, রানিনগর বাজার, শেখপাড়া। খাসজমি দখল করে বিক্রি করা, স্কুলের মাঠ দখল করা থেকে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে তোলাবাজি, রাহাজানি এমন কোন কাজ নেই যা তৃণমূলের বাহিনী করেনি। নেতাদের পাহারা দিয়েছে সরকারের পুলিশ।
গোধনপাড়া বাজারে তৃণমূল ছাড়া অন্য কোনও পতাকা ওড়া ছিল নিষেধ। পুলিশের পাহারাতেই চলত টানা সন্ত্রাস।
দ্বিতীয় নতুন বিষয় হল এই দুই দলের ঝান্ডা একসাথে নিয়ে সাধারণ মানুষের এইভাবে রাস্তায় নামা।
হ্যান্ড মাইকে তখন কংগ্রেসের নেতা জাহাঙ্গির ফকির বলছেন, “আমাদের পথে নামা অভিনব। তৃণমূলের শাসনের কালো দিন ঘুচতে চলেছে”।
মিছিলের সামনে রয়েছেন মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রে সিপিআই(এম) প্রার্থী মহম্মদ সেলিম। রয়েছেন সিপিআই(এম) জেলা নেতারা।
পঞ্চায়েত নির্বাচনে এক আশ্চর্য লড়াই দেখেছিল রানিনগর ২ ব্লকের মানুষ।
পঞ্চায়েত ভোটের আগে থেকেই ঘরছাড়া ছিলেন সিপিআই(এম) নেতা কর্মীরা। মাথায় ছিল গুচ্ছগুচ্ছ মিথ্যা মামলা। তার মাঝেই লড়া হয় ভোট।
সিপিআই(এম) এবং কংগ্রেস নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে লড়াই করে পঞ্চায়েত নির্বাচনে।
রানিনগর ২ ব্লকের পঞ্চায়েত সমিতিতে সভাপতি, সহ সভাপতি পদে নির্বাচিত হয়েছেন কংগ্রেস ও বামপন্থীরা। এই ব্লকের ৯ টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ৬ টিই তৃণমূলের হাতছাড়া হয়েছে। গঠিত হয়েছে মানুষের বোর্ড। পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি হয়েছেন কংগ্রেসের কুদ্দুস আলি। জেলা পরিষদ আসনে জিতেছেন সিপিআই(এম)’এর সালমা সুলতানা। তৃণমূলের বিরুদ্ধে এলাকায় লড়াইয়ে নেই বিজেপি।
পঞ্চায়েত সমিতির অধিকাংশ আসনে সিপিআই(এম) এবং কংগ্রেস জয়ী হওয়ার পরেও ঘুরপথে বারবার পঞ্চায়েত সমিতি দখলের চেষ্টা করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। জেলেও যেতে হয়েছে পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি কুদ্দুস আলিকে। সিপিআই(এম), আরএসপি, কংগ্রেসের টিকিটে জয়ীদের প্রতিদিন চাপ দেওয়া হয়েছে তৃণমূলে যোগ দেওয়ার। তবে সেই প্রক্রিয়া সফল হয়নি।
আসলে তৃণমূল কংগ্রেস এক সর্বগ্রাসী শক্তি। একে রুখতে হবে”। জুলফিকার আলি ভুট্টো যে পার্টি অফিস থেকে কাজ করেন সেই অফিস ছয় বছরে পাঁচবার ভাঙচুর করেছে তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা।
সিপিআই(এম) রানিনগর এরিয়া কমিটির সম্পাদক জুলফিকার আলি ভুট্টোর কথায়, “মানুষের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেষ্টাই এই বোঝাপড়াকে টিকিয়ে রেখেছে। আসলে তৃণমূল কংগ্রেস এক সর্বগ্রাসী শক্তি। একে রুখতে হবে”। জুলফিকার আলি ভুট্টো যে পার্টি অফিস থেকে কাজ করেন সেই অফিস ছয় বছরে পাঁচবার ভাঙচুর করেছে তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা।
রানিনগরে যে ঐক্যের ছবি তা উঠে এসেছে মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রে ডোমকল, জলঙ্গী, ভগবানগোলায় কংগ্রেস সমর্থিত সিপিআই(এম) প্রার্থী মহম্মদ সেলিমের প্রচারেও।
মুর্শিদাবাদ জেলার ৩ টি আসনের মধ্যে ২ আসনে ভোটে লড়ছেন কংগ্রেসের অধীর চৌধুরী ও মর্তুজা হোসেন। একটি আসনে লড়ছেন সিপিআই(এম)’এর মহম্মদ সেলিম।
অধীর চৌধুরীকে দেখা গিয়েছে কান্দিতে সিপিআই(এম) অফিসে বৈঠক করতে। জঙ্গিপুর কেন্দ্রেও সিপিআই(এম) নেতাদের সঙ্গে নিয়ে প্রতিদিন প্রচারে নামছেন কংগ্রেসের প্রার্থী।
এই সমঝোতার ছবিটা পঞ্চায়েত স্তর, বুথ স্তরে এবার আরও পরিষ্কার। কারণ দুই খুব কাছ থেকে দেখেছে, মুর্শিদাবাদ জেলায় তৃণমূল কংগ্রেসের উত্থান।
কংগ্রেস, সিপিআই(এম)-এর প্রতীকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের টাকার লোভ দেখিয়ে, পুলিশের চাপ দিয়ে তৃণমূল শিবিরে টেনেই জেলায় প্রতিষ্ঠা হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। যিনি এই কাজ করেছেন সেই শুভেন্দু অধিকারী এখন বিজেপি দলের নেতা।
মুর্শিদাবাদ জেলায় ২০১৬ সাল পরবর্তী কালে তৃণমূলের উত্থান। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনেও ২২ টি আসনের মধ্যে মাত্র ৪ টি আসনে জয়ী হয় তৃণমূল কংগ্রেস। তারপর জেলার দায়িত্ব নেন শুভেন্দু অধিকারী। কংগ্রেস, সিপিআই(এম)-এর প্রতীকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের টাকার লোভ দেখিয়ে, পুলিশের চাপ দিয়ে তৃণমূল শিবিরে টেনেই জেলায় প্রতিষ্ঠা হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। যিনি এই কাজ করেছেন সেই শুভেন্দু অধিকারী এখন বিজেপি দলের নেতা।
জেলায় তৃণমূল তৈরির কাজে পুলিশ প্রশাসনকে যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল সেটা গণতন্ত্রের পক্ষে বেশ উদ্বেগের। একই চেহারা নিয়ে ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনেও জেলা দখল করে তৃণমূল কংগ্রেস।
মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রে যিনি তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী সেই আবু তাহের খানও ২০১৮’র পঞ্চায়েত নির্বাচন প্রক্রিয়ায় তৃণমূলের হাতে আক্রান্ত হন। পরে তিনি কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে আসেন।
কাজেই মুর্শিদাবাদ জেলার মানুষ তৃণমূলকে কতোটা ভোট দিতে চাইবেন তা নিয়ে সংশয় আছেই।
নির্বাচন যে কঠিন হবে তা জানান দিয়েছে এই জেলায় পঞ্চায়েত নির্বাচনই। সিংহভাগ পঞ্চায়েত তৃণমূল দখল করলেও গ্রাম স্তরে যে কঠিন লড়াই’এর মুখোমুখি তৃণমূলকে হতে হয়েছে এবারের লোকসভা নির্বাচনে সেই লড়াইয়ের ঝাঁঝ আরও বাড়তে চলেছে।
নির্বাচন যে কঠিন হবে তা জানান দিয়েছে এই জেলায় পঞ্চায়েত নির্বাচনই। সিংহভাগ পঞ্চায়েত তৃণমূল দখল করলেও গ্রাম স্তরে যে কঠিন লড়াই’এর মুখোমুখি তৃণমূলকে হতে হয়েছে এবারের লোকসভা নির্বাচনে সেই লড়াইয়ের ঝাঁঝ আরও বাড়তে চলেছে। আসলে তৃণমূল কংগ্রেসের একাধিপত্যকে গণতন্ত্রের সংকট হিসেবেই দেখছেন অনেকে।
তৃণমূলের প্রচারে মূলত দুটি বিষয় ব্যবহার করা হচ্ছে। এক, সিএএ নিয়ে মানুষকে ভীতি প্রদর্শন দুই, রাজ্যের মানুষকে মুখ্যমন্ত্রী কতো কী দিয়েছেন তার বিবরণ।
সিএএ অবশ্যই ভয়ের কিন্তু যেখানে রাজ্যের শাসক দলের সাধারণ মানুষকে অভয় দেওয়ার কথা। সেখানেই অন্যরকম আতঙ্ক সৃষ্টির করতে চাইছে তৃণমূল কংগ্রেস। এছাড়াও রয়েছে ধর্মকে কেন্দ্রে করে রাজনীতি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখেও শোনা যাচ্ছে, দাঙ্গার আশঙ্কা ।
অন্যদিকে সরকারী স্কীমগুলিকে মুখ্যমন্ত্রীর করুণা হিসেবে প্রচার করতে চাইছে তৃণমূল। মানুষকে নাগরিক হিসেবে না দেখে “বেনিফিশিয়ারি” হিসেবে দেখার একটি দৃষ্টিভঙ্গি তৃণমূল তৈরী করেছে।
অন্যদিকে সরকারী স্কীমগুলিকে মুখ্যমন্ত্রীর করুণা হিসেবে প্রচার করতে চাইছে তৃণমূল। মানুষকে নাগরিক হিসেবে না দেখে “বেনিফিশিয়ারি” হিসেবে দেখার একটি দৃষ্টিভঙ্গি তৃণমূল তৈরী করেছে। যেখানে শাসক দল দাতা এবং সাধারণ মানুষ গ্রহীতা। সরকারি প্রকল্প যে মানুষের অধিকার, এই সহজ সত্যটা মানতে নারাজ তৃণমূল কংগ্রেস।
লোকসভা নির্বাচনের লড়াইয়ে তৃণমূলের বাড়তি পাওয়া রাজ্য সরকারের পুলিশ প্রশাসন। তবে ভোট যতো এগোচ্ছে এসব কিছু নিয়েও স্বস্তিতে থাকছে না তৃণমূল।
গলার কাঁটা, লোকসভার প্রচারে সিপিআই(এম), বামফ্রন্টের বিভিন্ন শরিকদল ও কংগ্রেসের ঐক্যবদ্ধভাবে রাস্তায় নামা।
*লেখক - বিশিষ্ট সাংবাদিক, *মতামত লেখকের ব্যক্তিগত
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন