Lok Sabha Polls 24: নওশাদ কাদের হতাশ করলেন?

People's Reporter: নওশাদ হতাশ করলেন তাঁর কর্মী সমর্থকদের। হতাশ করলেন বামপন্থীদের। তার চেয়েও বড় কথা, তিনি হতাশ করলেন বাংলার দলিত-মুসলিম সমাজকে, যারা তাঁর মধ্যে পেয়েছিল সাহসী, সম্ভাবনাময় এক তরুণ নেতাকে।
ছবি প্রতীকী
ছবি প্রতীকীগ্রাফিক্স - আকাশ
Published on

২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টের উল্কাসদৃশ উত্থান বাংলার রাজনৈতিক পরিসরে বেশ কিছু সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছে। এমন কিছু সম্ভাবনা, যাদের কেবলমাত্র নির্বাচনী পাটিগণিতের ভিত্তিতে বিচার করা যায় না। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে সেই প্রথম বাংলার রাজনীতিতে এমন একটি রাজনৈতিক দলের উত্থান হল, যে দলিত, মুসলিম-সহ নিপীড়িত মানুষের ঐক্যের কথা বলল। সেই উচ্চারণ বামপন্থীদের শ্রেণি রাজনীতির বয়ানের তুলনায় ঈষৎ ভিন্নসুরের। যে আব্বাস সিদ্দিকি ধর্মীয় জলসায় তীব্র নারীবিদ্বেষী বক্তব্য রেখেছিলেন, তিনিই ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে আইডেন্টিটি পলিটিক্সের ভিত্তিতেই এমন এক 'ইনক্লুসিভ' রাজনীতির কথা বলতে শুরু করলেন, যা এই রাজ্যের রাজনীতিতে খুব পরিচিত নয়। শুধু আব্বাস বা তাঁর ভাই নওশাদের অনুগামী মুসলিমরাই তো নন, আইএসএফ-এর পতাকাতলে জড়ো হলেন বিভিন্ন দলিত এবং আদিবাসী সংগঠনের সদস্য, সংগঠকরাও। নিঃসন্দেহে এটি ছিল বাংলার রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। প্রান্তিক জনতার কথা যে তাঁরা নিজেরাই বলতে পারেন, কোনও 'অগ্রগামী বাহিনী'র প্রয়োজন হয় না, এমন উপলদ্ধির প্রয়োজন ছিল এই রাজ্যের রাজনৈতিক পরিসরে। ভাঙড়ে আইএসএফ-এর জয় গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ তার রাজনীতি। কলকাতানির্ভর অভিজাত রাজনৈতিক পরিসরের কাছে প্রথম থেকেই আইএসএফ ছিল খানিকটা প্রহেলিকার মতো। সাড়ে ৭ দশকের বাম, ডান রাজনীতির চেনা বয়ানে তাকে ঠিক ধরা যায় না। কোথায় যেন উঁকি দিয়ে যান শেরে বাংলা ফজলুল হক বা 'লাল মওলানা' ভাসানী।

বাম, কংগ্রেসের ভরাডুবির মধ্যেও আইএসএফ-এর ভাঙড় জয় নওশাদকে সংযুক্ত মোর্চার শিবরাত্রির সলতেয় পরিণত করেছিল। কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ছিল নির্বাচন পরবর্তী সময়ে আইএসএফের মরিয়া লড়াই। ভাঙড়ে রাজনৈতিক আধিপত্য ধরে রাখতে আইএসএফ-এর কর্মীরা বুক টান করে লড়াই করেছেন তৃণমূলের বিরুদ্ধে। মার খেয়েছেন যেমন, তেমনই মেরেছেনও বটে। নওশাদকে কলকাতার রাজপথ থেকে টানতে টানতে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। সহকর্মীদের সঙ্গে দীর্ঘদিন জেলে থেকেছেন তিনি। সব মিলিয়ে লড়াই, সাহস এবং আইএসএফ যেন হয়ে উঠেছিল সমার্থক শব্দ। বামপন্থী ছিলেন আইএসএফ-এর স্বাভাবিক মিত্র। উল্টোটাও একই রকম সত্যি। একইসঙ্গে আইএসএফ বোধহয় খানিকটা আয়নার ভূমিকাও পালন করছিল। এমন এক দর্পণ, যে বামপন্থীদের খামতিগুলিকে দেখতে সাহায্য করে। সংশোধনে প্রাণিত করে তাঁদের।

লোকসভা নির্বাচনে বামপন্থীদের সঙ্গে আইএসএফ-এর জোট না হওয়া নিঃসন্দেহে দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি দুর্ভাগ্যজনক ডায়মন্ড হারবার আসন থেকে নওশাদের পলায়ন। একুশের বিধানসভা নির্বাচনের পরবর্তীকালে যিনি নিজেকে প্রকৃত অর্থেই 'বাঘের বাচ্চা' হিসাবে প্রমাণ করেছিলেন, তাঁর এই পলায়ন এই রাজ্যের রাজনীতির জন্য খুব সুখকর দৃশ্য নয়। যে নওশাদ নির্ভয়ে ভাঙড়ের নির্যাতিত জনতার পাশে দাঁড়িয়েছেন, অত্যাচারিত হয়েছেন, পীরজাদা স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন প্রত্যাখ্যান করে জেল খেটেছেন, তিনি নির্বাচনে বড় ব্যবধানে হারার ভয় পেলেন? সত্যি বলতে, 'ভয়' এবং 'পলায়ন' শব্দদুটি লিখতে অস্বস্তিই হচ্ছে। কিন্তু না লিখে উপায় নেই৷ নওশাদই সেই উপায় রাখেননি।

রাহুল দ্রাবিড়কে আইপিএল-এ ব্যাট করতে দেখতে খুব অসুবিধা হত। অনভ্যস্ত ফরম্যাটে অধিকাংশ সময়ই মানিয়ে নিতে পারতেন না দ্রাবিড়। এলোপাথাড়ি ব্যাট চালাতেন। অসহায় লাগত তাঁকে। ডায়মন্ড হারবারে রণে ভঙ্গ দেওয়ার পর নওশাদকে দেখেও ঠিক তেমনই লাগছে। এমন কিছু যুক্তি তিনি খাড়া করার চেষ্টা করছেন, যাদের পায়ে কোনও জোর নেই। তারা দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। নওশাদ বলেছেন, তাঁর দল তাঁকে ডায়মন্ড হারবারে লড়ার অনুমতি দেয়নি। তাহলে কি বিশ্বাস করতে হবে নওশাদ তাঁর দলকে স্বমতে আনতে ব্যর্থ হয়েছেন? তিনি বলেছেন, ভাঙড় বিধানসভা থেকে পদত্যাগ করলে বিধানসভায় তৃণমূল ও বিজেপি বিরোধী কোনও বিধায়ক থাকতেন না। অদ্ভুত যুক্তি। নওশাদ কি তাহলে নিজের দুর্গ ভাঙড়ের উপনির্বাচনে আইএসএফের জয়ের বিষয়ে নিশ্চিত নন! সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক, নওশাদ বুঝিয়ে দিলেন, গত কয়েকমাসে তিনি আসলে হাওয়া গরম করছিলেন৷ তাঁর বাগাড়ম্বর যে আসলে ফাঁকা বুলি ছিল, তিনি নিজেই তা প্রমাণ করলেন।

বামপন্থীদের সঙ্গে জোট করা বা না করা আইএসএফ-এর নিজস্ব সিদ্ধান্ত। তাঁরা যদি মনে করেন ২০২৪ সালের মহাগুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে একা লড়লেই তাঁদের সাংগঠনিক লাভ, তাহলে তাঁদের সেই অধিকার আছে। কিন্তু ডায়মন্ড হারবার থেকে পালিয়ে গিয়ে নওশাদ তাঁর রাজনৈতিক 'ইন্টিগ্রিটি'কে ক্ষতিগ্রস্ত করলেন। এই ক্ষতি দীর্ঘমেয়াদি। শুধু নওশাদ বা আইএসএফ-এর নয়, এই ক্ষতি বাংলার রাজনীতির। কেন বলছি এমন কথা? কারণ, এমন এক তরুণ রাজনীতিবিদ এ-কাজ করলেন, যাঁর নাতিদীর্ঘ অতীত লড়াই-আন্দোলন এবং সাহসী পদক্ষেপে সাজানো। তাঁর প্রতি বাংলার নিপীড়িত মানুষের যে প্রত্যাশা ও ভরসা তৈরি হয়েছিল, তিনি তাকেই আঘাত করলেন।

রাজনীতি সম্ভাবনার শিল্প। হয়তো পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনেই বাম ও আইএসএফ-এর জোট হবে। কিন্তু নওশাদের রাজনৈতিক ইমেজের যে ক্ষতি হল, তা পূরণ হওয়া কঠিন। নওশাদ হতাশ করলেন তাঁর কর্মী সমর্থকদের। হতাশ করলেন বামপন্থীদের। তার চেয়েও বড় কথা, তিনি হতাশ করলেন বাংলার দলিত ও মুসলিম সমাজের সেই অংশকে, যাঁরা তাঁর মধ্যে পেয়েছিল সাহসী, সম্ভাবনাময় এক তরুণ নেতাকে। তাঁর ভীরুতা সংক্রামক, তাঁর সাহসের মতোই।

ছবি প্রতীকী
Lok Sabha Polls 24: খরা কাটিয়ে লোকসভায় বামপন্থীদের পাঠাতে চলেছে বিহার, ঝাড়খণ্ড? 

স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in