শুরু হয়ে গিয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের নির্বাচনী মহোৎসব। অনেকের মতেই, ২০২৪ সালের ভারতীয় লোকসভা নির্বাচনে সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি কে জিতবে বা কে হারবে নয়। বরং যদি আবারও বিজেপি জয়ী হয়, তাহলে একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া হিসাবে নির্বাচন আদৌ কতখানি অর্থপূর্ণ থাকবে সেটিই আসল প্রশ্ন।
স্বাধীন ভারতের ১৮তম সাধারণ নির্বাচনের গোটা প্রচারপর্বের পরতে পরতে থাকছে দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোর প্রতি একটির পর একটি মারাত্মক উপহাস। বেনামি কর্পোরেট অনুদান হিসাবে রাজনৈতিক দলগুলির হাতে পৌঁছে যাওয়া হাজার হাজার কোটি টাকা, বিরোধী দলগুলিকে বিপাকে ফেলার জন্য সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাগুলির যথেচ্ছ ব্যবহার, এমনকি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের কারাগারে নিক্ষেপ করা এবং আরো অসংখ্য কূটকৌশল এই নির্বাচনকে অন্য মাত্রা দিয়েছে।
জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট বা ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স (এনডিএ)-এর নেতৃত্বে থাকা বিজেপি ২০১৪ এবং ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে লোকসভায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল। ২০২৪-এর নির্বাচনে এনডিএ জিতলে একটানা তৃতীয় বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হবেন নরেন্দ্র মোদী। উল্টোদিকে বৃহত্তম বিরোধী দল হিসেবে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস চলতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য আরও দুটি জাতীয় দল এবং প্রায় ৩৯টি রাজ্যস্তরের দলের সঙ্গে একত্রে ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স (INDIA) গঠন করেছে। অন্য কয়েকটি রাজ্যস্তরের দল কোনো জোটের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত না করেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস প্রথমে ইন্ডিয়া মঞ্চে থাকলেও পরে এককভাবেই লড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সংখ্যাগরিষ্ঠ মূলধারার গণমাধ্যম ইতিমধ্যেই নরেন্দ্র মোদীর হ্যাট্রিকের বিষয়ে প্রায় নিশ্চিত। তবে বিজেপি নিজে কিন্তু বিরোধীদের বাধাদানের প্রচেষ্টায় নিরলস। কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতাসীন দলের দ্বারা রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রায় সম্পূর্ণ দখল হয়ে যাওয়ার বিষয়টি দিনকে দিন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
বিজেপি সরকারের পুরো মেয়াদ জুড়েই ভারতের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (সিবিআই) এবং আর্থিক বিষয়ে অনুসন্ধান ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে একটির পর একটি অভিযান করেছে। এখনও করেই চলেছে। এই সংস্থাগুলি বিশেষত সেই রাজ্যগুলিতেই বেশি সক্রিয়, যেখানে বিজেপি বিধানসভায় ক্ষমতায় নেই। নির্বাচনের আগের মাসগুলিতে তো বটেই, নির্বাচন চলাকালীনও এরকম অভিযান আরও ঘন ঘন, প্রায় নিয়মিত হয়ে উঠেছে।
দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন জামিন অযোগ্য অভিযোগে কারাগারে রয়েছেন। উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনার মুম্বাইয়ের প্রার্থী তার প্রার্থীপদ ঘোষণার এক ঘণ্টার মধ্যে তিন বছরের পুরনো একটি মামলায় ইডি নোটিশ পেয়েছেন। অথচ আজ পর্যন্ত বিজেপির একজন সদস্যের বিরুদ্ধেও কোনো ধরনের দুর্নীতির তদন্ত হয়নি। ইডি বা সিবিআই যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা বা তদন্ত করেছে তাঁরা সকলেই বিরোধী জোটের কোনও না কোনও দলের সদস্য। অধিকন্তু, তাদের বিরুদ্ধে কুখ্যাত প্রিভেনশন অফ মানি-লন্ডারিং অ্যাক্ট (২০০২) এর অধীনে মামলা করা হচ্ছে যা অভিযুক্তের উপরেই তার নির্দোষিতা প্রমাণের বোঝা চাপিয়ে দেয়। ফলে জামিন পাওয়ার প্রক্রিয়াটি আরও জটিল হয়ে ওঠে।
সম্প্রতি, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) নির্বাচনী বন্ডের বিরুদ্ধে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে একটি পিটিশন দাখিল করে। এর পরে ভারতের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক কেলেঙ্কারিটি প্রকাশ্যে এসেছে। নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে যেকোনো ব্যক্তি বা সংস্থা তাদের পরিচয় ঘোষণা না করেই তাদের পছন্দের রাজনৈতিক দলগুলিকে অনুদান দিতে পারত। এই বন্ডগুলিকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীকালে সুপ্রিম কোর্টের তরফে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়াকে দাতাদের বিবরণ এবং অনুদানের পরিমাণ জনসাধারণের জ্ঞাতার্থে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। তাতে জানা যায়, এই নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে অনুদানের সবচেয়ে বড় প্রাপকও বিজেপি। তদুপরি, উল্লিখিত তথ্য প্রকাশের পরে এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে বেশ কয়েকটি বিতর্কিত এবং রীতিমতো ঝুঁকিপূর্ণ প্রকল্প সরকারী অনুমোদন পেয়েছে সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলি নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে অনুদান দেওয়ার পরে। কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলির তদন্তের পরও অনুদান দিতে দেখা গেছে অনেক প্রতিষ্ঠানকে। এই ধরনের বিষয়গুলি স্পষ্টতই ইঙ্গিত দেয় যে বৃহৎ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলি থেকে রাজনৈতিক দলগুলিতে জোরপূর্বক তোলা আদায়ের একটি উপায় হিসাবেই কাজ করেছে নির্বাচনী বন্ড ৷
নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে প্রায় ৬০৬০ কোটি টাকা লুটের পাশাপাশি বিরোধীদের নির্বাচনী তহবিলের ব্যবহারে বাধা দিতেও পিছপা হয়নি বিজেপি। জাতীয় কংগ্রেসের উপর এক বিশাল আয়কর জরিমানা আরোপ করা হয়েছে। তাদের পার্টির অ্যাকাউন্টও আটকে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে কংগ্রেসের নির্বাচনী প্রচারে ব্যাপক বাধার সৃষ্টি হয়েছে। ভারতের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে এমন ঘটনা নজিরবিহীন। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) এবং ভোটার ভেরিফাইড পেপার অডিট ট্রেল (ভিভিপিএটি) ব্যবহার করা থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন পর্যন্ত বিভিন্ন কাজকর্মের কারণে নির্বাচন কমিশন নিজেই জনগণের চোখে সন্দেহের কারণ হচ্ছে।
নির্বাচনের কিছুদিন আগে নির্বাচন কমিশনার আকস্মিকভাবে পদত্যাগ করলে তড়িঘড়ি নতুন দুই কমিশনারকে নিয়োগ করা হয়। তা নিয়েও ভ্রু কুঞ্চনের অবকাশ আছে। বিরোধী দল এবং একাধিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বারবার ইভিএমের স্বচ্ছতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও, নির্বাচন কমিশন বিষয়টিতে কান দিতে অস্বীকার করেছে। নির্বাচন কমিশন কর্তৃক বাধ্যতামূলক আদর্শ আচরণবিধিও বেছে বেছে কেবল বিরোধী দলগুলির জন্যই প্রযোজ্য বলে দেখা যাচ্ছে। নির্বাচনের প্রথম দফায় দেখা গিয়েছে যে সুরাটের বিজেপি প্রার্থী সম্পূর্ণ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচন শুরুর পরে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক মন্তব্য করেছেন। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি সুবিধার নয়।
ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ইলেক্টোরাল অ্যাসিসট্যান্স (আইআইডিইএ) ১৭৩টি দেশকে তাদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের মানের উপর ভিত্তি করে সূচকে স্থান দিয়েছে। গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্বে ভারতের নম্বর ২০১৪ সালে ৭১% থেকে কমে ২০২২ সালে ৬০%-এ নেমে এসেছে। গত মাসে, সুইডিশ সংস্থা ভ্যারাইটিজ অফ ডেমোক্রেসি (ভি-ডেম) তাদের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যেখানে ভারতকে 'নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্র' হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রতিবেদনটি ভারতকে স্বৈরতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হওয়া বিশ্বের শীর্ষ দশটি দেশের মধ্যেও স্থান দিয়েছে। ২০২৩ সালের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচক ভারতকে ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৬১ নম্বরে স্থান দিয়েছিল। এছাড়া, ভারতের সম্পদ বৈষম্য ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
মোট ৪৪ দিন ধরে সাত দফায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নির্বাচন হবে। দেশের ১৪০ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় ৯৭ কোটি বর্তমান নির্বাচনে ভোট দিতে সক্ষম। তবে, ১৯ এপ্রিল অনুষ্ঠিত নির্বাচনের প্রথম দফায় ভোটারদের উপস্থিতি প্রত্যাশার চেয়ে কম ছিল। দ্বিতীয় দফাতেও তাই। জনগণের রায় এবং ভারতীয় গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কী তা জানার জন্য অবশ্য ৪ঠা জুন অবধি অপেক্ষা করতেই হবে। একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ভারতে আদৌ গণতন্ত্র বাঁচবে কি না তা অনেকাংশেই নির্ভর করছে এই নির্বাচনের ফলাফলের উপর।
*অর্ক ভাদুড়ি, বিশিষ্ট সাংবাদিক। *মতামত লেখকের ব্যক্তিগত
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন