দু'দিনের রঙের উৎসব শেষ। রাস্তায় এখনও রঙ মিলান্তির ছাপ। লোকসভা ভোটের মরশুমে এই ছাপ রাজনীতিতেও। ২০২৪’এর লোকসভা নির্বাচন নামে সাধারণ হলেও আসলে সব অর্থেই অসাধারণ। বলা যায়, স্বাধীনতার পর থেকে দেশের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন এই ভোট।
দেশে নতুন সংসদ ভবন তৈরী হয়েছে। সেই ভবনে আদৌ মানুষের কথা শোনা যাবে কিনা ? আদৌ দেশের গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র রক্ষা পাবে কিনা, “রোটি-কাপড়া-মকান”-এর স্লোগানের অস্তিত্ব থাকবে কিনা সবই ঠিক হবে এই নির্বাচনে। রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা এই নির্বাচনকে, ভারতীয় গণতন্ত্রের অগ্নিপরীক্ষা হিসেবেই দেখছে।
পশ্চিমবঙ্গেও এই নির্বাচনের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। ২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় তৃণমূল কংগ্রেস ফের মসনদে বসেছে। একুশের আবহে বিজেপির নেতৃত্বও গিয়েছে তৃণমূলের দখলে। তৃণমূল ছেড়ে আসা শুভেন্দু অধিকারী এই রাজ্যে বিজেপি মাথায়।
এরপর এসেছে পঞ্চায়েত নির্বাচন। ২০১৮ সালে তৃণমূল কংগ্রেস যে কায়দায় পঞ্চায়েত দখল করেছিল, সেই কাজ এবার অনেকটাই বাধা প্রাপ্ত হয়েছে। পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়েছে রক্তক্ষয়ী। মালদা, মুর্শিদাবাদের মতো জেলায় পঞ্চায়েতে রাস্তায় তৃণমূলের সাথে লড়েছেন সিপিআই(এম), কংগ্রেসের কর্মীরা। এইসব পেরিয়ে এবার ২০২৪ সালে লোকসভা নির্বাচন।
নির্বাচন শুরু আগের একটা বড় সময় ধরে “ইন্ডিয়া” নিয়ে বিস্তর জলঘোলা হয়েছে। এক সময় গিয়ে রাহুল গান্ধীকেও নিশানা করেছেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা ব্যানার্জি।
ব্রিগেডে মেগা সমাবেশ করে ৪২ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। সেই প্রার্থী তালিকায় রয়েছে ইউসুফ পাঠানের মতো চমক। তবে তৃণমূলের ৪২ জনের মধ্যে ৩ জন আবার বিজেপি’র টিকিটে ২০২১ সালের নির্বাচনে জিতে বিধায়ক হয়েছেন। এই ৩ জন হলেন, রায়গঞ্জের বিধায়ক কৃষ্ণ কল্যাণী, বনগাঁর বিজেপি বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস, রাণাঘাট দক্ষিণের বিধায়ক মুকুটমণি অধিকারী। এই ৩ জনই বিধানসভা নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক প্রচার চালিয়েছেন। বিজেপির রাজনীতি মানুষের মধ্যে ছড়িয়েছিলেন। অন্যদিকে মাঝে তৃণমূল কংগ্রেসের ঘর করে ফের বিজেপির টিকিটে ভোটে দাঁড়িয়েছেন অর্জুন সিং। কলকাতা উত্তরে বিজেপি প্রার্থী করেছে সদ্য তৃণমূল ছাড়া তাপস রায়কে।
তৃণমূল ছেড়ে আসা শীলভদ্র দত্তও পেয়েছেন বিজেপি’র টিকিট । এক দিকে দুই দলের জনপ্রতিনিধিদের ঘনঘন দল বদল রাজনীতির ছবিটা করুণ করেছে। অন্যদিকে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তৃণমূল আদৌ কতোটা ভরসাযোগ্য শক্তি সেই প্রশ্নও এই দল বদলের কারণে উঠছে।
দেশের রাজনীতিতে বিজেপি বিরোধী শক্তি হিসেবে ‘ইন্ডিয়া’র গড়ে ওঠা বিজেপি’কে চিন্তিত করেছে ঠিকই, কিন্তু রাজ্যে ইন্ডিয়া’র ছবিটা স্বতন্ত্র। এখানে ইন্ডিয়ার কার্যত দুটি ব্লক। একদিকে কংগ্রেস, সিপিআই(এম) অন্যদিকে তৃণমূল। রাজ্যের বাইরে যদিও তৃণমূলের কোন অস্তিত্ব নেই।
লোকসভায় ৪২ আসনেই প্রার্থী ঘোষণা করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। বিজেপিও লড়ছে রাজ্যের ৪২ আসনে। আর রয়েছে সিপিআই(এম), বামফ্রন্টের শরিক দল আরএসপি, সিপিআই, ফরওয়ার্ড ব্লক। রয়েছে আইএসএফ এবং কংগ্রেস। পাহাড় থেকে সমতল, এই দলগুলিকে নির্বাচনী ঐক্যের সুতোয় বাঁধাটাই সিপিআই(এম)’এর কাছে অন্যতম চ্যালেঞ্জ।
সিপিআই(এম) এবং কংগ্রেস নিজের মধ্যে আলোচনা করেছে আসন সমঝোতা নিয়ে। সেই মতো বেশ খানিকটা দেরিতেই প্রার্থী ঘোষণা করেছে দুই দল। অবশেষে তিন দফায় প্রার্থী ঘোষণা করেছে বামফ্রন্ট।
এখনও পর্যন্ত ২১ আসনে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে বামফ্রন্ট। ১৭ টি আসনে লড়ছে সিপিআই(এম), কোচবিহার কেন্দ্র থেকে লড়ছে ফরওয়ার্ড ব্লক, বালুরঘাট এবং আলিপুরদুয়ার থেকে লড়ছে আরএসপি, মেদিনীপুর কেন্দ্র থেকে লড়ছে সিপিআই।
এখনও অবধি ৯ আসনে প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেছে কংগ্রেস। কংগ্রেসের আসনগুলি হল - কলকাতা উত্তর, পুরুলিয়া, মালদা দক্ষিণে, মালদা উত্তর, জঙ্গিপুর্, বহরমপুর, রায়গঞ্জ, বীরভূম এবং কোচবিহার। একমাত্র কোচবিহার আসনেই বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেসের প্রার্থী রয়েছে। তবে, এই নিয়ে চলছে আলোচনাও। পুরুলিয়ায় লড়ার কথা ঘোষণা করেছে ফরওয়ার্ড ব্লক। যদিও সেটা বামফ্রন্টের সিদ্ধান্ত নয়। বেশ কিছু আসনে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে আইএসএফও।
রাজ্যে এই দলগুলির মধ্যে সমন্বয়ের কাজে বিশেষ দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে সিপিআই(এম)’কেই। দলের রাজ্য সম্পাদক বারবার বলেছেন, বামফ্রন্ট, কংগ্রেস, আইএসএফ সহ সমস্ত তৃণমূল ও বিজেপি বিরোধী শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করার কথা। সেই কাজও চলছে রাজনৈতিক ভাবে।
এই কাজে এগিয়ে আসছে কংগ্রেসও। হামরো পার্টির নেতা অজয় এডওয়ার্ড’-এর ইন্ডিয়া জোটে যোগদান এবং মুনিশ তামাংয়ের কংগ্রেসে যোগদানও রাজ্যের রাজনীতিতে নতুন সমীকরণের জন্ম দিচ্ছে।
বাকি আসনে প্রার্থী কবে? প্রশ্নে জেরবার বামফ্রন্ট, কংগ্রেস নেতারা। কিন্তু প্রার্থী প্রশ্নে ধীরে চলাই এখন একমাত্র রাস্তা।।
সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রে প্রচারের ফাঁকে স্পষ্ট করেছেন, সিপিআই(এম) নেতারা যে কাজ করছেন সেটাকে সূচে সুতো গলানো, তারপর সেটা দিয়ে বুননের কাজ। সকলেরই জানার কথা, এই কাজে কতোটা শ্রম এবং ধৈর্য প্রয়োজন। প্রয়োজন সতর্কতাও।
দীর্ঘ সময় সমঝোতার রাজনীতি অসফল হচ্ছিল মুর্শিদাবাদে। ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে অধীর চৌধুরীকে সমর্থন করেছিল সিপিআই(এম)। অধীরের বিরুদ্ধে আরএসপি প্রার্থী দিলেও, সিপিআই(এম) কর্মীরা নেমেছিলেন কংগ্রেসের প্রচারে। তবে জঙ্গীপুর আর মুর্শিদাবাদ এই দুই কেন্দ্রে সিপিআই(এম) ও কংগ্রেস উভয় দলই প্রার্থী দেয়। তার প্রভাব পরে ভোটেও। একুশের নির্বাচনে সার্বিক সমঝোতা হলেও দুই দলের একাংশের কর্মীদের মধ্যে সংশয় ছিল। তবে এরপর পঞ্চায়েত নির্বাচনে লড়াইয়ের মাঠ থেকেই তৈরী হয়েছে বর্তমান বোঝাপড়ার ভিত্তি।
এবারের এই সমঝোতা কোন উপরতলার বোঝাপড়া নয়। তৃণমূল আর বিজেপির বিরুদ্ধে সিপিআই(এম) এবং কংগ্রেসের বুথস্তরের কর্মীদের রণনীতি।
মুর্শিদাবাদ সহ একাধিক কেন্দ্রে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে আইএসএফ। তবে রাজনৈতিক শিবিরের মত, বোঝাপড়ার পথে হাঁটবে আইএসএফও।
এই লড়াইয়ে সকলকেই নিজেদের কিছু কিছু এলাকা ছাড়তে হবে সহযোগীর জন্য। এটাই এখন একমাত্র বাস্তব।
*মতামত লেখকের ব্যক্তিগত
*লেখক - বিশিষ্ট সাংবাদিক
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন