মানব-সমাজের ইতিহাস জটিল ও বহুমুখী। বিপ্লব, অভ্যুত্থান, কু দে তা, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, স্বার্থের সঙ্ঘাত, মতাদর্শের লড়াই - ইতিহাসে এমন নানাবিধ ঘটনার অন্ত নেই। সেই উত্তাল প্রবাহের মধ্যে মানুষ তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। জটিল সামাজিক ঘটনাপঞ্জীর মধ্যে সে তার সমাজ-ইতিহাস নির্মাণ করে। সেই সমাজ-ইতিহাসের সঙ্গে প্রকৃতির বিকাশ পথের কিছু মৌলিক পার্থক্য আছে বলে সমাজ দার্শনিকগণ দাবি করে থাকেন। সেখানে ধরে নেওয়া হয় যে প্রকৃতির নিজস্ব কোন সচেতন শক্তি নেই, এখানে বিকাশ ঘটে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। কিন্তু সমাজের ক্ষেত্রে ঘটনায় প্রভাব বিস্তার করছে মানব চেতনা এবং সামাজিক ক্রিয়ায় সশরীরে হাজির থাকছেন সেই ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন মানুষ। মানুষ একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করে তার দিকে এগিয়ে যায়, প্রকৃতির তেমন নিজস্ব কোন চেতনা নেই। অথচ সামাজিক সত্তার সারমর্ম হল মানুষের উৎপাদন ও বৈষয়িক সম্পদসংক্রান্ত শ্রমের ক্রিয়াকলাপ যা প্রকৃতির অভ্যন্তরেই সমাজকে প্রকাশ করে।
এই সমাজে মানুষ স্বাধীনভাবে বাঁচতে চায়। সামাজিক নিয়মের যে বেড়াজাল, যে বাধ্যবাধকতা, সেগুলোকে মানুষ নিজের মধ্যেই লালন করতে পারে। নিজের মধ্যে লালনের এই জায়গা থেকেই সে সমাজকে একটা কারাগার বলে সহজে ভাবতে পারে না। কিন্তু অন্য কোন শাসন-ব্যবস্থা যখন তার সমাজের ওপর চেপে বসে, তখন তারা যূথবদ্ধভাবেই তার বিরুদ্ধাচরণ করে। ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে জাতি গঠনের বৈপ্লবিক পরিসর ১৭৭৬ সালে আমেরিকার মাটিতে দেখা যায়। ফ্রান্সের রাজা ষোড়শ লুই-এর বিরুদ্ধেও মানুষ জেগে ওঠে ১৭৮৯ সালে। "স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রী"র লক্ষ্যে ফরাসী বিপ্লব ঘটেছে। সামাজিক নিয়মের বদল ঘটেছে। আবার এই পর্বে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের প্রভাবে দৈহিক শ্রমের পরিবর্তে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি ও তার গুণগত মানের ক্ষেত্রে যে ব্যাপক উন্নতি ঘটানো সম্ভব হয়। এও এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
বিপ্লবে সামাজিক পরিবর্তন সাধিত হয়। একটি শাসকশ্রেণীর পতন ঘটে এবং নতুন এক শাসকশ্রেণীর উদয় হয়। উৎপাদন ব্যবস্থার সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে তখন নতুন শাসকশ্রেণীকে পুরাতন শাসকশ্রেণী অপেক্ষা প্রগতিশীল ও সম্ভাবনাময় শক্তি হিসেবে গণ্য করা হয়। যে-কোনো সমাজবিপ্লবের নির্দিষ্ট, বিষয়গত সামাজিক-অর্থনৈতিক অন্তর্বস্তু থাকে, যা ব্যক্তির ইচ্ছা ও চেতনা নিরপেক্ষ। ক্ষমতা দ্বন্দ্বের মীমাংসা যেহেতু রাষ্ট্রশক্তির ক্ষমতা দখলের মধ্যে দিয়ে শেষ পর্যায়ে সম্পন্ন হয়, সেহেতু সমাজবিপ্লবের মূল কথা হল পুরোনো রাষ্ট্রশক্তিকে উচ্ছেদ করে নতুন রাষ্ট্রশক্তি প্রতিষ্ঠা করা। এককথায় এর অর্থ রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল।
ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লব তার ফলশ্রুতিতে উপনিবেশবাদী রাজনীতির কায়েমি স্বার্থপূরণ করতে সাহায্য করেছিল ঠিকই, তবে এই বিপ্লব শ্রেণীনির্ভর আধুনিক বিশ্ব-সমাজ প্রতিষ্ঠা করে। ১৭৬০ থেকে চলা পুঁজিনির্ভর নতুন উৎপাদন ব্যবস্থায় শ্রমিকের দৈন্য অবস্থা বাধ্যতামূলকভাবে বিনা মজুরিতে বেগার খাটা সেই প্রাচীন করভি প্রথার মতোই মনে হয়। ফলে শিল্প বিপ্লব যে এক শ্রেণীর মানুষের জীবন যন্ত্রণাকে বাড়িয়ে তুলছে তা নিশ্চিত হতে সময় লাগে না। বসবাসের জন্য নির্ধারিত বস্তিগুলোয় শ্রমিকের জীবনযাত্রার মান, অথবা শিল্পে শিশু শ্রমিকের যথেচ্ছ ব্যবহার সম্পর্কে নির্মম কথাগুলো সমাজের মূর্ততায় চেতনায় জন্ম নেয়।
শিল্পনির্ভর ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান এই ভারতের মাটিতেও ঘটে। ১৮৫৭র মহাবিদ্রোহ তার একটা বড় নমুনা। বাধ্যকারী শেকল ছেঁড়ার সেও এক কাহিনি। আবার ফ্রান্সের মাটিতে যতই খেটে খাওয়া মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা পাওয়ার কথা বলা হোক, আদতে সন্ত্রাসের শাসনকাল সেখানে চলতেই থাকে। ১৮৩০এ ফ্রান্সে যে বিপ্লব সংগঠিত হয়, তাও ছিল ১৭৮৯র ফরাসি বিপ্লবেরই প্রতিচ্ছবি। আবার ১৮৪৮এ সেই ফরাসী সমাজেই রাজা লুই ফিলিপের স্বেচ্ছাতন্ত্রের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলিই সংগঠিত হয়। ১৮৪৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী প্যারিসের গণতান্ত্রিক নাগরিকরা রাস্তায় নেমে পড়ে। সে হল উনিশ শতকের ফেব্রুয়ারি বিপ্লব।
১৮৭১ সালের ১৮ মার্চ থেকে ২৮মে, প্যারি কমিউন। ইতিহাসে প্রথম প্রলেতারীয় বিপ্লব এবং সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণীর প্রথম সরকার গঠনের অভিজ্ঞতা। সেই প্রয়াসকে নতুন আলো জ্বালার কাজে সলতে পাকানোর কাজ ধরলে পূর্বতন সকল বিপ্লবের প্রেক্ষিতে বিশ শতকের ফেব্রুয়ারি বিপ্লব অনন্য। এই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আগে যে সকল সমাজবিপ্লব অনুষ্ঠিত হয়েছে তাতে এক শোষক শ্রেণীর উচ্ছেদ এবং অপর এক শোষক শ্রেণীর উত্থান ঘটেছে। সমাজের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত মালিকানার নিদান বজায় থাকার ফলেই সেটা ঘটেছে। কমিউনিস্ট পার্টির ইস্তেহার পুস্তিকা প্রকাশের পর থেকেই ইউরোপ যে প্রলেতারীয় বিপ্লবের ভূত দেখতে শুরু করেছিল, ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে শুরু হওয়া শ্রমজীবী মানুষের লড়াইয়ের সেই সফলতার নাম বলশেভিক বিপ্লব। নভেম্বর বিপ্লব।
উনিশ শতকের ফেব্রুয়ারি বিপ্লব মানব সমাজ বিকাশের ধারায় একটি অন্যতম ঘটনা। ঘটনাটির সময়কাল হল ১৮৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী থেকে ১৮৪৯ সালের প্রথম দিক। প্রসঙ্গত, ফ্রান্সের জুলাই রাজতন্ত্র, অর্থাৎ লুই ফিলিপের রাজতন্ত্র ১৮৩০ সালের জুলাই মাসে ক্ষমতাসীন হয়। নতুন সনদ অনুসারে বুর্জোয়ারা তাদের আকাঙ্খিত ভোটাধিকার পেলেও শ্রমিকরা তা থেকে বঞ্চিত ছিল। তাছাড়া বেকারি ও আর্থিক সংকটের ফলে ব্যাপক শ্রমিক বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়। প্রথমদিকে লুই ফিলিপ কিছুটা জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও ক্রমশ তার শাসনের প্রতি জনগণ বিরূপ হতে থাকেন। ফিলিপের শুল্ক নীতি ও শ্রমনীতি পেতি-বুর্জোয়াদের বিক্ষুব্ধ করে। এদের নেতৃত্ব করেন মার্তিন। লা মার্তিন ভোটাধিকারের সম্প্রসারণ দাবি করেন। সমাজতন্ত্রী সংস্কারক লুই ব্লা ধনতন্ত্রের অবসান ও কাজের অধিকার দাবি করেন। ভোটাধিকারের সম্প্রসারণ সমাজতন্ত্রীদেরও দাবি ছিল।
রাজা লুই ফিলিপের স্বেচ্ছাতন্ত্রের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে ফ্রান্সের সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলিই সংগঠিত হয়। ১৮৪৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি প্যারিসের গণতান্ত্রিক নাগরিকরা রাস্তায় নেমে পড়েন। রাজা জাতীয় রক্ষী-বাহিনীকে গণবিক্ষোভ দমনের আদেশ দিলে মানুষ প্রকাশ্যে বিদ্রোহীদের প্রতি সমর্থন জানায়। পরদিন আন্দোলন সশস্ত্র বিদ্রোহে ছড়িয়ে পড়ে। ২৪ ফেব্রুয়ারি লুই ফিলিপ ইংল্যাণ্ডে পালিয়ে যান। বস্তুত, ১৮৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি বিপ্লব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিপ্লবের ঢেউ তোলে। ইতালি, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, জার্মানি প্রভৃতি দেশে জনগণ স্বৈরাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করে। এই কারণেই ১৮৪৮-৪৯ বছরটি ইউরোপের ইতিহাসে বিপ্লবের বছর হিসাবে পরিচিত।
বিশ শতকের ফেব্রুয়ারি বিপ্লব গ্রেগেরিয় ক্যালেন্ডারের নিয়মে মার্চে ঘটলেও এটি জুলিয়ান নিয়মে ফেব্রুয়ারিতে গণনা করা হয়। গণনার আর এক অনন্যতায় এই বিপ্লব শ্রেণী শোষণ থেকে মুক্ত একটা সমাজ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস রচনার উৎস হয়, মানুষ সচেতনভাবে যেখানে নিজেকে যুক্ত করেছিল। এমন অভিনব ঘটনাটি রাশিয়ার পেত্রোগ্রাদে ১৯১৭ সালের ৮ থেকে ১২ মার্চের মধ্যে ঘটে। রাশিয়ানরা যেহেতু জুলিয়ান ক্যালেণ্ডার মেনে চলে তাই দিনটি ২৩ থেকে ২৭ ফেব্রুয়ারী। এই ফেব্রুয়ারী মাসে ঘটা আন্দোলনে পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েত প্রতিষ্ঠিত হয়। শুরুর দিনটি ছিল নারী দিবস। এটা ছিল দ্বিতীয় নিকোলাসকে সিংহাসনচ্যুত করার আন্দোলন। প্রথম রাশিয়ান প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। অর্থনৈতিক ও সামাজিক দৈন্য থেকে মুক্তি পেতে এবং জার শাসনের অবসানে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই লড়াই-এ সামিল হয়েছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সামরিক অভিযানে রাশিয়ার ব্যর্থতা, হাজার হাজার রুশ সেনার মৃত্যু, দুর্দশাগ্রস্ত কৃষকের জীবনযন্ত্রণা বৃদ্ধি, খাদ্য নিরাপত্তার অভাব, শ্রমিক শ্রেণীর আর্থ-সামাজিক অবস্থায় দৈন্য, প্রযুক্তিগত পশ্চাদপদতা, লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক দলের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের প্রসার, ইত্যাদি এই সংগ্রামের স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি কারণ। বাহুল্য হলেও এই কথা স্বীকার করতেই হয় যে রাশিয়ায় এই আন্দোলন বিপুল জনজাগরণের ভিত্তিভূমি রচনা করে। ওই বছরের অক্টোবর (নভেম্বর) বিপ্লবের সাফল্যে লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়ায় বলশেভিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এই মহতি উদ্যোগের পটভূমি রচনা করে ফেব্রুয়ারি বিপ্লব।
বিশ শতকের বিশ্ব-সমাজে কমিউনিস্ট অভ্যুত্থান ১৯১৭র মার্চ মাসে (সোভিয়েত ক্যালেণ্ডার জুলিয়ান নিয়ম অনুযায়ী ফেব্রুয়ারিতে) ঘটে। এতে রাশিয়ায় জারতন্ত্রের অবসান হলেও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব তখনও দূরে। অস্থায়ী সরকার কখনো জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। ১৯১৭ সালের জুলাই মাসে কেরেনস্কির নেতৃত্বে যে সরকার গঠিত হয় তার শ্রমিকবিরোধী ও শান্তিবিরোধী নীতিও ক্রমেই প্রকট হয়ে পড়ছিল। এপ্রিলে লেনিন দেশে ফিরে পেত্রোগ্রাদে এলেন এবং অবিলম্বে বলশেভিক দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করলেন। তিনি দাবি করেন যে, শ্রমিক-কৃষকদের সোভিয়েতকে পূর্ণ ক্ষমতা দিতে হবে এবং যুদ্ধ থেকে হাত গুটিয়ে নিতে হবে।
জুন মাসে পেত্রোগ্রাদে সৈনিক ও শ্রমিকদের সোভিয়েতগুলির এক সম্মেলন হয়। এই ঘটনার পর থেকে বলশেভিকরা ক্রমশ জনপ্রিয় হতে থাকে। তাদের নেতৃত্বে শ্রমিক বিক্ষোভ, নাবিক বিক্ষোভ ইত্যাদি সংগঠিত হয়। ইতোমধ্যে দেশের মধ্যে দক্ষিণপন্থীদের গুঞ্জনও শুরু হয়ে যায়। দক্ষিণপন্থী নেতা প্রাক্তন সেনাধ্যক্ষ করনিলভ সেপ্টেম্বর মাসে একটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটাতে গিয়ে ব্যর্থ হন। বলশেভিকদের জন্যই করনিলভের অভ্যুত্থানকে ব্যর্থ করে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। এদিকে ধীরে ধীরে বলশেভিকদল লেনিনের নেতৃত্বে সর্বস্তরে বাহিনী গড়ে তোলার কাজে সফল হতে থাকে। সেনাবাহিনীর মধ্যেও বলশেভিকদের প্রচার সফল হয়েছিল। ডাক দেওয়া হয়- শ্রমিক, সৈনিক ও কৃষকদের বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক! ৭ নভেম্বর বলশেভিকরা আঘাত হানে। কেরেনস্কি বিনা প্রতিরোধে পালিয়ে যান। পেত্রোগ্রাদ ও মস্কো বলশেভিকদের অধিকারে আসে। সোভিয়েতকে সমস্ত ক্ষমতা দিয়ে নতুন সরকার গঠন করা হয়।
১৯১৭ সালের বিপ্লবী সংগ্রামের সূচনা ঘটেছিল ১৯০৫-১৯০৭ সালের বিপ্লবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে সামাজিক-অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বগুলো অত্যন্ত তীব্র আকার ধারণ করে। ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারির বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব জারতন্ত্র উচ্ছেদ করে, কিন্তু শ্রমিক ও কৃষকদের চাহিদা পূরণ করতে পারেনি। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব তখন আশু কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। লেনিন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বলশেভিক পার্টির পরিচালনায় এটির নেতৃত্ব দেয় রুশ শ্রমিক শ্রেণী। জমি, শান্তি ও রুটির শ্লোগানে বলশেভিকরা জনগণকে সংগঠিত করে।
বিপ্লবের এই বিশ শতকীয় নতুন দিশায় নভেম্বর সমাজতান্ত্রিক মহাবিপ্লব বিশ্ব-ইতিহাসে প্রথম বিজয়ী প্রলেতারীয় বিপ্লব। লেনিনের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টির পরিচালনায় রাশিয়ার শ্রমিক শ্রেণী, শ্রমজীবী কৃষকদের সঙ্গে নিয়ে এটি সম্পন্ন করেছিল। অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক মহাবিপ্লবের ফলশ্রুতিতে বুর্জোয়া ও জমিদাররা ক্ষমতা হারায় এবং সোভিয়েত রূপে সিদ্ধান্তগ্রহণে প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। অক্টোবরের বিজয় বিশ শতকের প্রধান ঘটনা, যার ফলে সমগ্র মানবজাতির বিকাশের গতিপথের আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। এই বিজয়ের ফলে বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে।
১৯১৭ সালের ২৪শে অক্টোবর (জুলিয়ান নিয়মে) পেত্রোগ্রাদে সশস্ত্র বিদ্রোহের শুরু। ২৫ ও ২৬শে অক্টোবরের মাঝামাঝি রাতে শীতপ্রাসাদ আক্রমণ ও দখলের পর সাময়িক সরকারকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯১৭ সালের ২৫শে অক্টোবর (গ্রেগেরিয় নিয়মে ৭ই নভেম্বর) সোভিয়েতের দ্বিতীয় সারা-রুশ কংগ্রেসের উদ্বোধনের পর সেখানে সোভিয়েতগুলির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা ঘোষণা করা হয়। অতঃপর প্রলেতারিয়েত কল-কারখানার মালিকানা পেল, সোভিয়েত রাজ কৃষকদের কাছে জমি হস্তান্তর করল এবং বৃহৎ শিল্প, ব্যাংক ও রেলপথের জাতীয়করণ হল। ইতিহাসে প্রথম যাবতীয় প্রাকৃতিক সম্পদ ও জমিসহ গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদনের উপায়সমূহ জনগণের সম্পত্তিতে পরিণত হল। বিভিন্ন জাতির সমানাধিকার ঘোষিত হল।
নভেম্বর বিপ্লব পুঁজিবাদের বিশ্বব্যাপী আধিপত্যের অবসান ঘটায়। পৃথিবী দুটি ব্যবস্থায় বিভক্ত হয় — সমাজতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী। এই বিপ্লবের ফল পরবর্তীতে পুঁজিবাদের ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনকে পরাভূত করে মানবকল্যাণের পক্ষ নিয়েছে। সভ্যতার সংকট কাটাতে সাহায্য করেছে। এই সমাজতান্ত্রিক মহাবিপ্লব যে নবযুগের সূচনা করেছে সেটা হল মানবজাতির মুক্তি চেতনায় গড়ে ওঠা এক স্বাধীন বিশ্ব-সমাজ, সে হল বিপাকীয় ফাটলমুক্ত পুঁজিবাদী শোষণহীন যৌথ খামার, সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে জাতিগুলির মুক্তি ঘোষণার যুগ, ব্যক্তি মালিকানাধীন পুঁজির আধিপত্য উচ্ছেদে সাম্য ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিয়োজিত গণসংগ্রামের সময়সূচনা।
দুনিয়ার শ্রমজীবী মানুষ যতদিন না এই বিকাশমান উৎপাদিকা শক্তির সঙ্গে অপসৃয়মান উৎপাদন সম্পর্কের দ্বন্দ্বে পুরোনো সমাজকাঠামো ভেঙে নতুন বিশ্ব-উৎপাদনব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারছেন, ততদিন শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে এমন সমাজবিপ্লব ঘটে চলবে। স্ফুলিঙ্গের ভূমিকায় নভেম্বর বিপ্লব সেই শিক্ষা দেয়।
* লেখক সমাজবিদ্যার অধ্যাপক, এস এন এইচ কলেজ, ফারাক্কা
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন