এবং ২১ শে জুলাই …

২১ জুলাই, ১৯৯৩ - ‘নির্বাচনে সচিত্র ভোটার কার্ডের আবশ্যিককরণ’-এর দাবিতে ডাকা ওই অভিযানের সঙ্গে রাজ্য সরকারের কর্মকাণ্ডের কোনো যোগ নেই। কারণ পুরো বিষয়টাই ছিলো নির্বাচন কমিশনের এক্তিয়ারভুক্ত।
মারমুখী যুব কংগ্রেস কর্মীরা
মারমুখী যুব কংগ্রেস কর্মীরাফাইল চিত্র
Published on

দিনটা যেহেতু বিতর্কিত, তাই এই দিন নিয়ে যত কম কথা বলা যায় তত ভালো। তবু কিছু কথা না বললে দিনটা সম্পর্কে মানুষের কাছে ভুল বার্তা যায়। তাই সত্য অপ্রিয় হলেও স্পষ্টাস্পষ্টি বলাই ভালো।

প্রথমেই বলে রাখা ভালো দিনটা তৃণমূল কংগ্রেসের তরফে ‘শহিদ দিবস’ হিসেবে পালন করা হলেও ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই তৃণমূল নামক কোনো দল পশ্চিমবঙ্গের বুকে ছিল না। আন্দোলন হয়েছিল যুব কংগ্রেসের পতাকার তলায়। পুলিশের গুলি অথবা সিরোসিস অফ লিভারে যে বা যারা মারা গেছিলেন তাঁরা কংগ্রেস সমর্থক ছিলেন। কাজেই তৃণমূলের তরফে যে অনুষ্ঠান পালন করা হয় তা মূলত ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের কাছ থেকে ‘দখল’ করা একটি বিশেষ দিন। হয়তোবা পশ্চিমবঙ্গ বর্তমানে প্রতিদিন যে দখলের রাজনীতি প্রত্যক্ষ করছে, এর বীজ পোঁতা হয়েছিলো তখন থেকেই, যখন থেকে তৃণমূলের তরফে ২১ জুলাই পালন শুরু হয়েছিলো।

২১ জুলাই কেন, কীভাবে, কী হয়েছিলো তা নিয়ে দাবি, পাল্টা দাবি আছে। আছে মতদ্বৈধতাও। অবশ্য সেটা থাকাই স্বাভাবিক। কারণ ১৯৯৩ সালের এই দিনকে কেন্দ্র করে যা যা ঘটেছিলো তার দুই প্রান্তে আছে দুই ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষজন। ‘আমরা’ ‘ওরা’-র দ্বন্দ্বে একদলের দাবি করা ‘শহিদ’ অন্যদলের চোখে ‘লুম্পেন’ হতেই পারে।

আক্রান্ত পুলিশ
আক্রান্ত পুলিশ

রাজনৈতিক একচোখামো ছেড়ে একটু নিরপেক্ষ দৃষ্টি থেকে ২১ জুলাইকে বিশ্লেষণ করতে গেলে অনেকগুলো প্রশ্ন সামনে এসে যায়। যে প্রশ্ন অবশ্যই যুক্তিগ্রাহ্য এবং একটু খুঁজলে হয়তো এর উত্তরগুলোও পাওয়া যেতে পারে।

কী দাবিতে ২১ জুলাই, ১৯৯৩ মহাকরণ অভিযান আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়েছিলো? বকলমে যা ছিলো ‘মহাকরণ দখল অভিযান’। ‘নির্বাচনে সচিত্র ভোটার কার্ডের আবশ্যিককরণ’-এর দাবিতে ডাকা ওই অভিযানের সঙ্গে রাজ্য সরকারের কর্মকাণ্ডের কোনো যোগ নেই। কারণ পুরো বিষয়টাই ছিলো নির্বাচন কমিশনের এক্তিয়ারভুক্ত। যে কারণে পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেসের এই আন্দোলনে সমর্থন ছিলো না। বিরোধিতা করেছিলেন কংগ্রেস নেতা তথা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিম্মা রাও। আসলে ৯২-র প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচনে সোমেন মিত্র-র কাছে একতরফা হারের পর দলে কোণঠাসা হয়ে পড়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সামনে নিজের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য এছাড়া বিকল্প আর কোনও পথ খোলা ছিলো না। সেদিক থেকে বলতে গেলে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করা ছাড়া এই আন্দোলনের পিছনে অন্য কোনও উদ্দেশ্য খুঁজে পাওয়া একটু কঠিনই।

তবু মহাকরণ অভিযানে বেশ কিছু মানুষ জড়ো হয়েছিলেন। বক্তৃতা হয়েছিলো। ঝামেলা বেঁধেছিল। গুলি চলেছিলো। কিন্তু ঠিক কী হয়েছিলো ২১ জুলাই, ১৯৯৩ সেবিষয়ে বিস্তারিত জানা যেতে পারে ওই সময়ের কিছু সংবাদপত্র থেকে। যে রিপোর্টকে পক্ষপাতদুষ্টতায় দোষী করা যায়না কোনওভাবেই।

পুলিশের গাড়িতে আগুন
পুলিশের গাড়িতে আগুন

২১ জুলাই প্রসঙ্গে ২৪ জুলাই, ১৯৯৩ দি হিন্দুর প্রতিবেদনে বলা হয়েছিলো –“…গণ্ডগোল তৈরিতে সদাব্যগ্র সমাজবিরোধী শক্তি ও গুন্ডারা অবাধ বিচরণের দিন পেয়ে গিয়েছিলো এবং তাঁদের ওপর কংগ্রেস নেতৃত্বের কোনও নিয়ন্ত্রণ ছিলোনা।…মহাকরণ ছাড়াও বিক্ষোভকারীরা কলকাতা পুরসভা দপ্তরে হামলা চালায়। একটি হাসপাতালের জরুরি বিভাগও রক্ষা পায়নি।… বিবেকবর্জিত ব্যক্তিদের ছড়ানো হিংসা মোকাবিলা করতে গেলে সরকারের কাছে খুব বেশী বিকল্প খোলা থাকেনা।…”

দি স্টেটসম্যান, ২৩ জুলাই লিখেছিলো – “…যদি দলের মধ্যে নিজেকে জাহির করা নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোনও সমস্যা থেকে থাকে, নির্দোষ নাগরিকদের উপর তার দায় তিনি চাপিয়ে দিতে পারেন না।… কংগ্রেস(আই) দলের যুব শাখার অপরিণত নেতৃত্বের দ্বারা সংগঠিত পূর্বপরিকল্পিত হিংস্রতা ও রাজ্য কংগ্রেস দলের সম্পূর্ণ অসহায়তা।…”

আনন্দবাজার পত্রিকা ২৩ জুলাই, ১৯৯৩-এর প্রতিবেদন অনুসারে – “…দেশের সমূহ সমস্যাগুলি কিন্তু তাহার দৃষ্টি সম্পূর্ণ এড়াইয়া গিয়াছে। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর তাঁহার সাড়া মেলে নাই।… নিন্দনীয় জবরদস্তি মহাকরণ দখলের উদ্যোগ।…”

মারমুখী কংগ্রেস কর্মীরা
মারমুখী কংগ্রেস কর্মীরা

দি টেলিগ্রাফের ২২ জুলাই-এর প্রতিবেদন অনুসারে – “…এই কংগ্রেস নেত্রী জনতাকে খেপিয়ে দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো সাফল্যই পাননি।… স্থিতিশীলতা ও স্বাভাবিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ আগ্রহহীন একজন দায়িত্বজ্ঞানহীন নেত্রী হিসেবেই কুখ্যাতি অর্জন করছেন তিনি।…”

টাইমস অফ ইন্ডিয়ার ২৩ জুলাই, ১৯৯৩ তারিখের প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিলো – “…নৈরাজ্যই পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য করে। … দোকান লুট, সরকারি যানবাহন ও গাড়ি পোড়ানো, কর্তব্যরত পুলিশকে গালিগালাজ করা। … একজন নেত্রীর অহংবোধের তৃপ্তি ছাড়া গোটা বিক্ষোভটির অন্য কোনও উদ্দেশ্য ছিলোনা।…”

এ তো গেল ২১ জুলাই ১৯৯৩ নিয়ে তৎকালীন সংবাদপত্রের প্রতিবেদন। আজ থেকে ২৪ বছর আগে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার এত চল ছিলোনা। ফলত প্রিন্ট মিডিয়ার এই রিপোর্টগুলো থেকে সেদিন কী ঘটেছিলো সে সম্বন্ধে একটা ধারণা করে নেওয়া খুব একটা কষ্টকর নয়।

একদম শেষে দেখে নেওয়া যেতে পারে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রসচিব, বর্তমান তৃণমূল নেতা মণীশ গুপ্তর বয়ান। যে হলফনামায় তিনি জানিয়েছিলেন – “সেদিন ৩টি বাস পোড়ানো হয়েছিল। ৩৫টি গাড়ি ভাঙচুর হয়েছিল। সব মিলিয়ে জখম হয়েছিলেন ২১৫ জনেরও বেশি পুলিশ। তাঁদের মধ্যে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার, যুগ্ম কমিশনার, ডি সি (সদর), ৭জন ডি সি, ১০ জন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার রয়েছে। ৩৪ জন পুলিশকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় পুলিশ হাসপাতালে। তাঁদের অনেকেরই পাইপগানের গুলি এবং বোমার স্প্লিন্টার লেগেছিল। তালতলা থানার সার্জেন্ট ডি কে ঘোষালের গুলি লেগেছিল। এক সাব ইনস্পেক্টর কালাচাঁদ সমাদ্দারের শরীরে আঘাত ছিল বোমার। কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের সাব ইনস্পেক্টর এ কে গাঙ্গুলিকে এস এস কে এম হাসপাতালের সামনে মেরে মাথা ফাটিয়ে, হাত ভেঙে দিয়েছিল দুর্বৃত্তরা। আক্রান্ত, রক্তাক্ত হয়েছিল পুলিশ। তাই গুলি চালিয়েছিল।”

* মতামত লেখকের ব্যক্তিগত

স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in