এই দিনটি (১০ মার্চ) পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক রাজনীতি ও গণআন্দোলনের দিনপঞ্জিতে একটি বিশেষ দিন হিসেবেই সংযোজিত হয়েছে। এই দিনটিতে রাজ্যের স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের শাসানি, হুমকি, প্রশাসনিক ফতোয়া, চাকরির ক্ষেত্রে কালা আইনি বিধি আরোপ (ডায়াস নন আর বেতন কাটার জুজু দেখানো) ইত্যাদি নানা ভীতিমূলক নির্দেশ ও ফরমানকে অগ্রাহ্য করে ধর্মঘটের এক নতুন নজির গড়েছেন রাজ্যের মধ্যবিত্ত শ্রমিক, কর্মচারী, শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীরা।
কেবল সরকার বা প্রশাসনের ধমক-চমক বা ভীতি প্রদর্শন নয়, এই ধর্মঘট বানচাল করতে শাসক দল, তাদের অনুগত এবং সরকারের পেটোয়া একাংশ কর্মচারী লাগাতার অপপ্রচার ও নানা চেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু এই সমস্ত কিছুকেই হেলায় উড়িয়ে দিয়ে এই সময়কালের এক অভূতপূর্ব ধর্মঘটে শামিল হয়েছেন রাজ্য কোষাগার থেকে বেতন প্রাপ্ত কর্মচারী, শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীরা। তাঁরা সেদিন বুঝিয়ে দিয়েছেন চোখ রাঙিয়ে, কঠোর প্রশাসনিক নির্দেশ জারি করেও ন্যায্য দাবির আন্দোলনকে রোখা যায়না। এদিন গোটা দেশ প্রত্যক্ষ করেছে মধ্যবিত্ত শ্রমিক, কর্মচারী, শিক্ষক, শিক্ষাকর্মীর সম্মিলিত প্রতিবাদী ধর্মঘটে থমকে গেছে পশ্চিমবঙ্গের অফিস, আদালত, বিদ্যালয় সহ সরকারি কাজকর্ম। বকেয়া মহার্ঘভাতা, রাজ্য সরকারের সমস্ত শূন্যপদে স্বচ্ছভাবে নিয়োগ সহ একাধিক দাবিতে এই ধর্মঘটের মধ্য দিয়ে কর্মচারী-শিক্ষকদের যে ন্যায্য দাবির স্পর্ধিত ও দৃপ্ত প্রকাশ ঘটেছে, তা একদিকে ছিল যেমন এক কথায় নজিরবিহীন, একইসঙ্গে বিগত ১২ বছরের তৃণমূল শাসনে একেবারেই বিরল ঘটনা।
এদিনের এই সফল ধর্মঘটের মধ্য দিয়ে শুধুমাত্র মধ্যবিত্ত কর্মচারী, শিক্ষক আন্দোলনই উদ্দীপ্ত হয়নি, রাজ্যের সর্বস্তরের সংগ্রামী মানুষও স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাড়তি উৎসাহ পেয়েছেন। যা বৃহত্তর গণ আন্দোলনে কিছুটা হলেও নতুন গতি সঞ্চার করেছে। রাজ্য কো-অর্ডিনেশন কমিটি, পঞ্চায়েত যৌথ কমিটি, এবিটিএ, এবিপিটিএ সহ বিভিন্ন সংগঠনের যৌথ মঞ্চ, শহিদ মিনারে অবস্থানরত কর্মচারী, শিক্ষক, শিক্ষাকর্মীদের অপর একটি মঞ্চ একই সঙ্গে এই ধর্মঘটের আহ্বান জানিয়েছিল। এই সমস্ত সংগঠনের সমবেত প্রচেষ্টায় রাজ্য সরকারের স্বৈরাচারী, অগণতান্ত্রিক অন্যায় জুলুমবাজির বিরুদ্ধে যৌথবদ্ধ সংগ্রামী অধ্যায়ের সূচনা করেছে এই ধর্মঘট।
তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হলো, এই একইদিনে এসএফআই'র ডাকে ছাত্র-ছাত্রীরা রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থা বাঁচাতে এবং অবিলম্বে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে কলকাতার রাজপথ কাঁপিয়ে বিধানসভা অভিযানের মধ্য দিয়ে সংগ্রামী যৌবনের দৃপ্ত স্বাক্ষর রেখেছে।
কোন লক্ষ্যে ছিল এই ধর্মঘট
১০ মার্চের এই ধর্মঘট শুধুমাত্র শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রাপ্য ও দাবি-দাওয়ার ভিত্তিতেই ছিল না, এই ধর্মঘটে সাধারণ মানুষের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দাবিও উচ্চারিত হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল স্বচ্ছতার সঙ্গে শূন্যপদ পূরণ। প্রসঙ্গত, বর্তমানে রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে, বিভিন্ন পদে, কলেজ- বিদ্যালয়ে শূন্যপদে ৬ লক্ষের বেশি কর্মসংস্থান সম্ভব। কিন্তু রাজ্য সরকার তা করছে না। এছাড়াও রাজ্যের বিভিন্ন স্তরে নানা ধরনের হাজার হাজার অস্থায়ী কর্মচারীর নিয়মিতকরণের দাবিও যুক্ত ছিল। এই সময়কালে পঞ্চায়েত, পৌরসভা সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এজেন্সির মাধ্যমে বা অন্য কোনোভাবে বেশকিছু অস্থায়ী, চুক্তিভিত্তিক, অনিয়মিত কর্মচারীকে কাজে নিযুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু তাঁদের কোনো আশা বা ভবিষ্যত নেই। এঁদের এমনভাবে নিযুক্ত করা হয়েছে, যাতে তাঁরা প্রমাণ করতে না পারেন যে তাঁরা নির্দিষ্ট ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মী। এছাড়াও এই সময়ে তৃণমূল সরকার আরও যে কাজটি করেছে তা হলো, বিভিন্ন দপ্তরে অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীদের স্বল্প বেতনে (৬ থেকে ১০ হাজার টাকা) কাজে নিযুক্ত করেছে। স্থায়ী নিয়োগ হলে তার দায়বদ্ধতা নিতে হবে সরকারকে, কিন্তু সেই দায় নিতে রাজি নয় সরকার। কেন্দ্রের নয়া উদারীকরণের যে নীতি, সেই পথ অনুসরণ করেই মুখ্যমন্ত্রীর এই উদ্যোগ। আর রাজ্যে যে নিয়োগটুকু হচ্ছে, তার জন্য শাসক দলের মাতব্বরদের বিপুলহারে 'কাটমানি' দিতে হচ্ছে চাকরি প্রার্থীদের। সরকারি পদে লক্ষ লক্ষ শূন্য পদে নিয়োগ বন্ধ রাখা হয়েছে। অথচ কয়েক হাজার দলীয় কর্মীকে সিভিক পুলিশ নাম দিয়ে পুলিশ প্রশাসনে ঢোকানো হয়েছে। এখন তাঁদেরই একাংশকে স্থায়ী করার চেষ্টা হচ্ছে। এসবের ফলে রাজ্যের বেকার ছেলে মেয়েরা সরকারি চাকরির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। রাজ্য সরকার বেকার যুবক-যুবতীদের কর্মসংস্থানের কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। অথচ মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের চা,চপ,মুড়ি-তেলে ভাজার দোকান করার নিদান দিয়েছেন, যা বিস্তর হাসি ঠাট্টা-মশকরার উপাদান জুগিয়েছে। তাই ধর্মঘটের দাবিগুলোর মধ্যে অন্যতম দাবি ছিল অনিয়মিত কর্মচারী-শিক্ষকদের নিয়মিতকরণ এবং স্বচ্ছভাবে শূন্যপদ পূরণ। এই দাবিগুলোর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ দাবি ছিল রাজ্যে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা এবং সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতিকে পরাভূত করা। এই সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ দাবিতেই ঐক্যবদ্ধ হয়ে ধর্মঘটে শামিল হয়েছিলেন শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী ও কর্মচারীরা।
ন্যায্য মহার্ঘ ভাতার দাবি
যে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ দাবির ভিত্তিতে ১০ মার্চের ধর্মঘট উল্লেখযোগ্য সাড়া ফেলেছিল গোটা রাজ্যে, সেগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল, বকেয়া মহার্ঘ ভাতা(ডিএ) প্রদানের দাবি। বর্তমানে ৩৬ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা বকেয়া রয়েছে রাজ্যে। শিক্ষক-কর্মচারীদের এই দাবি বহুদিনের। প্রকৃতপক্ষে তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ন্যায্য মহার্ঘ ভাতা থেকে ক্রমাগত বঞ্চিত হচ্ছেন শিক্ষক-কর্মচারীরা। স্যাট(স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইব্যুনাল)-এর সুপারিশ, কলকাতা হাইকোর্টের একাধিকবার রায় সত্ত্বেও রাজ্য সরকার ডিএ দিতে অস্বীকার করেছে। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, কলকাতা হাইকোর্ট ডিএ-কে কর্মচারীদের অধিকার হিসেবে রায় দিয়েছে। কিন্তু রাজ্য সরকার উলটে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছে শিক্ষক ও কর্মচারীরা যাতে এই ন্যায্য অধিকার না পেতে পারেন।
লক্ষণীয় বিষয় হলো,রাজ্য সরকার একদিকে কোর্টে দাবি করেছে কোনো মহার্ঘ ভাতা বাকি নেই, অন্যদিকে বাজেটের দিন হঠাৎ করেই( মন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা চলাকালীন চিরকুট লিখে) তিন শতাংশ মহার্ঘ ভাতা দেবার ঘোষণা করেছে! সরকারের এই দোলাচলতা ও অদ্ভুত অবস্থান তাদের মিথ্যাচারকেই প্রকট করেছে।
এ প্রসঙ্গে স্মরণ করতেই হয়, বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী যখন বিরোধী দলনেত্রী ছিলেন তখন ২০১০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ধর্মতলার সমাবেশে এবং ২০১১ সালের ২২ জানুয়ারি সোনারপুরের সমাবেশে আওয়াজ তুলেছিলেন, "যে সরকার কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা দিতে পারে না, সেই সরকারের ক্ষমতায় থাকার অধিকার নেই।" সেই বক্তব্য অনুযায়ী তো তাহলে এখন তাঁর সরকারেরই চলে যাবার কথা ! যে মুখ্যমন্ত্রী ন্যায্য মহার্ঘ ভাতার দাবি জানানোর জন্য কর্মচারীদের সারমেয়দের সঙ্গে তুলনা করে চূড়ান্ত অসম্মান করতে পারেন এবং এ নিয়ে আন্দোলন করায় সম্প্রতি শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী ও কর্মচারীদের 'চোর ডাকাত' বলতে পারেন, সেই মুখ্যমন্ত্রীর রুচি-মানসিকতা নিয়ে স্বভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে। অবশ্য কটু বাক্য প্রয়োগ ও কু-নাট্য পরিচালানায় তাঁর যে জুড়ি নেই, তা শুধু রাজ্যবাসী কেন, গোটা দেশবাসীই জানেন। এবারেও শিক্ষক-কর্মচারীদের সম্পর্কে এমন কুৎসিত মন্তব্য করায় নানা মহলেই ধিক্কার উঠেছে।
মুখ্যমন্ত্রীর মিথ্যাচার
মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের শিক্ষক-কর্মচারীদের হকের দাবি অস্বীকার করছেন। আবার সম্প্রতি শিলিগুড়িতে এক প্রশাসনিক সভায় দাবি করেছেন, তিনি বিগত তিন বছরে মহার্ঘ ভাতা বাবদ ১ লক্ষ ৬১ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছেন। এটি একটি আজগুবি অঙ্ক ছাড়া আর কিছুই নয়। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে এ রাজ্যের কর্মচারী, শিক্ষক ও পেনশনাররা মাত্র ৩ শতাংশ হারে মহার্ঘ ভাতা পাচ্ছেন। সেই হিসেবে ফেব্রুয়ারি ২০২৩ পর্যন্ত রাজ্য সরকারের সর্বোচ্চ ৫,০১১ কোটি টাকা খরচ হতে পারে। কিন্তু সেখানে ১ লক্ষ ৬১ হাজার কোটির গল্প নেহাতই বিভ্রান্তি ছড়ানো ছাড়া আর কিছুই নয়। ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত বকেয়া ছিল ১২ কিস্তি মহার্ঘ ভাতা। রাজ্য সরকার দিয়েছে মাত্র ২ কিস্তি, সেটাও সর্বভারতীয় ক্রেতা মূল্য সূচক না মেনেই। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, যখন ন্যায্য মহার্ঘ ভাতার দাবি তুলেছেন কর্মচারীরা, তখন রাজ্যের এক হাকিম মন্ত্রী রাজ্যের চাকরি ছেড়ে কর্মচারীদের কেন্দ্রের চাকরি করার নিদান দিয়েছেন !
আরও একটা জলজ্যান্ত মিথ্যা প্রচার মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর অনুগত স্তাবকেরা প্রায়ই করে থাকেন যে, এই হারে মহার্ঘ ভাতা দিলে নাকি রাজ্যের সমস্ত সামাজিক প্রকল্পগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। এটা সর্বৈব মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছুই নয়। এই সরকার বেতন খাতের বরাদ্দকৃত অর্থ, যার পরিমাণ ২৫ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি, তা খরচ করতে পারছে না, অন্যত্র সরিয়ে ফেলছে। অথচ বকেয়া মহার্ঘ ভাতা দিতে সরকার বলছে প্রয়োজন ২৪ হাজার কোটি টাকা। তার থেকে বেশি পরিমাণ টাকা এই খাতে উদ্বৃত্ত রয়েছে সরকারের কাছে।
এছাড়াও আরেকটি দিক হলো, সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প নামে রাজ্য সরকার যে প্রকল্পগুলি চালাচ্ছে, দেশের প্রায় সব রাজ্যে এমন প্রকল্প চলে। ২০২৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক যে তথ্য দিয়েছে, সেই অনুযায়ী দেশের সামাজিক প্রকল্পে সবচেয়ে বেশি যে রাজ্যগুলি খরচ করে তার মধ্যে প্রথম পাঁচটি রাজ্যে পশ্চিমবঙ্গের স্থান নেই। এই রাজ্যগুলি হলো--- কেরালা, ঝাড়খণ্ড, ওডিশা, তেলেঙ্গানা ও উত্তর প্রদেশ। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, এই রাজ্যগুলি তাদের রাজ্যে কর্মচারীদের ৩১ থেকে ৩৮ শতাংশ হারে মহার্ঘ ভাতা দিয়ে থাকে। আবার অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে,যে রাজ্যগুলি সবচেয়ে বেশি ঋণ নিচ্ছে, যেমন পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশ প্রভৃতি, তারা কিন্তু তাদের রাজ্যের কর্মচারীদের কেন্দ্রীয় হারে মহার্ঘ ভাতা দিচ্ছে। ফলে সামাজিক প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবার যে গপ্প ফাঁদছেন মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর সরকার তার কোনো ভিত্তি নেই।
অনুদানের নামে জনগণের টাকা নয়ছয়
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে ২০২০-২১সালের আর্থিক বছরের অর্থ দপ্তরের যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে সিএজি (২৫ মার্চ,২০২২) তাতে প্রশ্ন তুলেছে যে, বিগত পাঁচ বছরে রাজ্যের কোষাগার থেকে ১ লক্ষ কোটি টাকার বেশি দেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী পরিচালিত এনজিওগুলিকে। বলাই বাহুল্য, এগুলি সবই শাসকদল ঘনিষ্ঠ বা অনুগত। ২০২১ সালের নির্বাচনের আগে ওই আর্থিক বছরে সর্বোচ্চ ২৭ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও অন্যান্য খাতে দেওয়া হয়েছে ১০,৮৫৯ কোটি টাকা। অথচ লক্ষণীয় বিষয় হলো, এনজিও-কে দেওয়া টাকার হিসেব করতে পারেনা সিএজি। রাজ্যবাসীর স্মরণে আছে, গতবছর মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের ক্লাবগুলোকে দুর্গাপুজোর জন্য অনুদান হিসেবে আগের বারের দেওয়া ৫০ হাজারের বদলে ৬০ হাজার টাকা করে দেবার ঘোষণা করেন। এরই পাশাপাশি কলকাতা ও রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদকে বলা হয়, পুজো কমিটিগুলির বিদ্যুৎ বিলে যেন ৬০ শতাংশ ছাড় দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে রাজ্য কোষাগার থেকে খরচ হয় ২৫৮ কোটি টাকা। এছাড়াও পুজোর পর রেড রোডে যে মহা সমারোহে কার্নিভাল হয়, তাতেও রাজ্য কোষগারের কয়েক কোটি টাকা চলে যায়। ভোটের রাজনীতির দিকে লক্ষ্য রেখে এই সমস্ত উদ্যোগ যে নিতান্তই দলীয় আনুগত্যকে পোক্ত করা তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। একদিকে যখন শাসকদল ঘনিষ্ঠ এনজিওগুলিকে কোটি কোটি টাকা দেওয়া হচ্ছে, তখন পঞ্চায়েত-পৌরসভার মাধ্যমে উন্নয়ন খাতে অর্থ বরাদ্দ কমছে। এভাবে সরকারের অনুদান দেবার ফলে রাজ্য কোষাগারের বিপুল পরিমাণ টাকা এনজিও-র মাধ্যমে আত্মসাৎ করছেন নেতা-মন্ত্রীরা। তাদের অনেককেই আজ নানা দুর্নীতির দায়ে কারান্তরালে থাকতে হচ্ছে। বর্তমানে যা অবস্থা দাঁড়িয়েছে তাতে দল ও সরকারের একেবারে শীর্ষ স্থান থেকে নিচু তলার অনেককেই এখন একই পরিণতির জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
এই সূত্রেই এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা জরুরি তা হলো, ২০১১ সাল পর্যন্ত রাজ্যের বামফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ছিল দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম বেতন গ্রহণ করা মন্ত্রিসভা।যে মন্ত্রিসভায় স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী বেতন হিসেবে নিতেন ১২হাজার টাকা, অন্যান্য মন্ত্রীরা পেতেন ৯ হাজার টাকা। সেই সময়ে মুখ্যমন্ত্রী পে-কমিশনে ধার্য একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর থেকেও কম বেতন নিতেন নীতিগত ও আদর্শগত কারণে।
আর এখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ হারে বেতন নিচ্ছেন। কোনো পে-কমিশন ও বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ ছাড়াই মুখ্যমন্ত্রী আজ ১ লক্ষ ১৭ হাজার টাকা গ্রহণ করছেন, আর তাঁর মন্ত্রিসভা সদস্যরা নিচ্ছেন ১ লক্ষ ১১ হাজার টাকা!
একদিকে এই সরকার দেদার ঋণ নিচ্ছে, আবার অন্যদিকে মেলা-খেলা-মোচ্ছব-দান খয়রাতি ও প্রশাসনিক বৈঠকের নামে জনগণের টাকা যথেচ্ছভাবে অপচয় করছে। এরা নানা কায়দায় জনগণের টাকা আত্মসাৎ করছে এবং নিয়োগ দুর্নীতির মধ্যদিয়ে কোটি কোটি টাকা লুঠ করছে। অন্যদিকে কর্মচারী-শিক্ষকদের ন্যায্য দাবি থেকে বঞ্চিত করছে। এরাই আবার তারস্বরে কেন্দ্রের বঞ্চনার দাবি তুলে সহানুভূতি আদায় করতে চাইছে ! কেন্দ্রের বঞ্চনার ধুয়ো তোলার আড়ালে নিজেদের গা থেকে দুর্নীতি-কলঙ্কের গাঢ় পাঁক ঢাকতে মুখ্যমন্ত্রী সদ্য দু'দিনের ধরনার নাটক করলেও তা সর্বাংশে ফ্লপ শো-তে পরিণত হয়েছে।
ধর্মঘটের সাফল্য
রাজ্য সরকারের অন্যায়,অবিচার,বঞ্চনা ও গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের বিরুদ্ধে শিক্ষক-কর্মচারীরা লাগাতার প্রচার আন্দোলন সংগঠিত করেছেন। ১০ মার্চের ধর্মঘটের আগে এই সমস্ত দাবি নিয়ে তাঁরা গত ২০-২১ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন কর্মচারী সংগঠনের যৌথ মঞ্চের ডাকে রাজ্য জুড়ে কর্মবিরতি পালন করেছেন,মিছিল-জমায়েত সংগঠিত করেছেন। তার আগে ১২ জুলাই কমিটির আহ্বানে ১৭ ফেব্রুয়ারি বিধানসভা অভিযান সংগঠিত হয়েছে। এই সমস্ত আন্দোলনের সাফল্যের ভিত্তিতে আরও বৃহত্তর আন্দোলনের লক্ষ্যেই ১০ মার্চ যৌথভাবে শিক্ষক ও কর্মচারীদের যৌথ মঞ্চ ধর্মঘটের ডাক দেয়। রাজ্য সরকারের সমস্ত রকম হুমকি, কড়া সার্কুলারের ভ্রূকুটি, সেই সঙ্গে শাসক দলের গুন্ডামিকে পরোয়া না করেই এদিন ধর্মঘটে শামিল হন রাজ্য সরকারের কর্মচারী,শিক্ষক থেকে পঞ্চায়েত ও পৌরসভার কর্মীরা। এদিন ধর্মঘটের সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে গ্রামাঞ্চলে। পঞ্চায়েত দপ্তরে তালা ঝুলেয়ে কর্মচারীরা যেভাবে ধর্মঘটে শামিল হয়েছেন,তা ছিল তৃণমূলের জমানায় নজিরবিহীন। রাজ্যের ৩ হাজারের ওপর গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে প্রায় ১২০০ ওপর গ্রাম পঞ্চায়েত ভবন ছিল পুরোপুরি স্তব্ধ। সব মিলিয়ে প্রায় ৮২ শতাংশ গ্রাম পঞ্চায়েতে এদিন কর্মচারীরা কাজ বন্ধ রেখেছেন। ৩০০ ওপর পঞ্চায়েত সমিতির মধ্যে ৭৯ শতাংশতে এদিন কর্মচারীদের ধর্মঘটের প্রভাব ছিল সর্বাত্মক। ২১ টি জেলা পরিষদের মধ্যে এদিন ১৫ টি জেলা পরিষদ দপ্তরে ধর্মঘটের ভালো প্রভাব পড়ে।
এদিন রাজ্যের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও ধর্মঘটের ব্যাপক প্রভাব পড়ে। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। শিক্ষক,অধ্যাপক, শিক্ষাকর্মীরা কাজে যোগ দেননি।
গ্রামাঞ্চলের মতো কলকাতা মহানগরীতেও ধর্মঘটের বিপুল সাড়া পড়ে। কলকাতা ও সল্টলেকে রাজ্য সরকারের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের কর্মীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দিয়েছেন ধর্মঘটে। একইভাবে রাজ্যের প্রতিটি জেলা সদর এবং প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়স্তর পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে ধর্মঘটের প্রভাব পড়ে ব্যাপক মাত্রায়।
ধর্মঘটকে সফল করতে কর্মচারীদের দৃঢ় মনোভাবের আভাস পেয়ে বিভিন্ন দপ্তরে কর্মচারীদের উপস্থিতি দেখাতে অভূতপূর্ব ছাড়ের ব্যবস্থা রেখেছিল রাজ্য প্রশাসন। গোটা দিনে চার বার, এমনকী বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত সময় দিয়ে নবান্নের অর্থ দপ্তর ও মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয়ে উপস্থিতির তালিকা পাঠানোর ব্যবস্থা হয়েছিল। কলকাতার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের আধিকারিকরা বিকেল পর্যন্ত ফোন করে কর্মচারীদের উপস্থিতির খাতায় স্বাক্ষর করার অনুরোধ করেছেন। কিন্তু সরকারি প্রশাসনের সমস্ত প্রচেষ্টা, আধিকারিকদের অনুরোধকে উপেক্ষা করে কর্মচারীরা ধর্মঘটকে সফল করে রাজ্য সরকারের অন্যায় অবিচারের উপযুক্ত জবাব দিয়েছেন।
আরও বৃহত্তর লড়াইয়ের ডাক
এদিনের এই ধর্মঘটকে সফল করার জন্য শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী ও কর্মচারীদের অভিনন্দন জানিয়েছে সিআইটিইউ সহ বিভিন্ন শ্রমিক ও কর্মচারী সংগঠন। তারা অবিলম্বে কর্মচারীদের বকেয়া ডিএ সহ অন্যান্য দাবি পূরণের জন্য সরকারের কাছে দাবি রেখেছে। ইতিমধ্যে রাজ্য সরকার প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে সরকারি কর্মীদের একদিনের বেতন কাটা, ডায়াস নন সহ অনেক কর্মচারীকে অন্যায়ভাবে বদলির নির্দেশ জারি করেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্য কোষাগার থেকে বেতনপ্রাপ্ত কর্মচারী, শিক্ষক,শিক্ষাকর্মীদের আন্দোলনের দু'টি মঞ্চ যৌথভাবে সরকারকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে, সরকার যদি অবিলম্বে তাদের দাবি মেনে না নেয় এবং ধর্মঘটে শামিল কর্মচারী-শিক্ষকদের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসামূলক আচরণ বা ভূমিকা নেয়, তাহলে তারা আইনি পদক্ষেপ সহ লাগাতার আন্দোলনের পথে অগ্রসর হবে। ইতিমধ্যেই তারা সেই আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।
১) আগামী ৫ এপ্রিল দিল্লিতে শ্রমিক-কৃষকদের সংসদ অভিযানে অংশ নেবেন এ রাজ্যের কর্মচারীরা। তাঁরা ওই দিনই দিল্লির একটি নির্দিষ্ট স্থান বেছে নিয়ে রাজ্যের সরকারি কর্মচারীদের প্রতি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সাম্প্রতিক অসম্মানজনক ও কুরুচিকর মন্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ধ্বনিত করবেন।
২) ৬ এপ্রিল রাজ্যের কর্মচারীরা কর্মবিরতি পালন করবেন।
৩) ১১ ও ১২ এপ্রিল ১২ ই জুলাই কমিটির ডাকে রাজ্যের বিভিন্ন মহকুমায় প্রতিবাদ সভা, মিছিল ইত্যাদি সংগঠিত করবেন।
৪) ১৩ এপ্রিল জেলা সদরে হবে প্রতিবাদ মিছিল।
এছাড়াও আরও একটি অভিনব অথচ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবাদ কর্মসূচি নিয়েছেন রাজ্যের সরকারি কর্মচারীরা। তা হলো, রাজ্যের তৃণমূল সরকার কর্মচারীদের ৩৬ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা বকেয়া রেখে দিয়ে বলেছে,সরকারের কোষাগারে নাকি টাকা নেই,সরকার গরিব ! তাই কর্মচারীরা স্থির করেছেন, মহার্ঘ ভাতার প্রতি শতাংশে এক টাকা করে মোট ৩৬ টাকা ট্রেজারির মাধ্যমে সরকারকে দান করবেন।
প্রস্তুতি দিকে দিকে
২০১১ সালে এ রাজ্যে তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পর অনেকগুলি সাধারণ ধর্মঘট হয়েছে। সেগুলি সর্বভারতীয় প্রেক্ষিতে হলেও কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের সঙ্গে গোপন সখ্যের কারণে তৃণমূল সরকার সেইসব ধর্মঘট বানচাল করতে হুমকি, ভীতি প্রদর্শন, প্রশাসনিক দমন-পীড়ন সহ বর্বরোচিত আক্রমণ নামিয়ে এনেছিল। তা সত্ত্বেও তারা সফল হয়নি। এবারেও তারা ভেবেছিল হয়ত এভাবেই হুমকি, দমন-পীড়ন চালিয়ে এই ধর্মঘটকেও ব্যর্থ করা যাবে। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। উলটে ধর্মঘটকে সফল করে গণতন্ত্র বিরোধী-স্বৈরাচারী রাজ্য সরকারকে উপযুক্ত জবাব দিয়েছেন রাজ্যের সংগ্রামী কর্মচারী-শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মীরা। এই সূত্রেই স্মরণ করা যেতে পারে, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের কর্মসংস্কৃতির দোহাই দিয়ে বিরোধীদের ডাকা (কেন্দ্রের বিরুদ্ধে হলেও) সমস্ত প্রতিবাদ বিক্ষোভ, বিশেষকরে ধর্মঘটকে পুলিশ ও প্রশাসনের সাহায্যে নিষ্ঠুরভাবে দমন করার উদ্যোগ নিয়েছেন। অথচ তিনিই বিরোধী নেত্রী হিসেবে কপট রাজনীতির স্বার্থে রাজ্যে ৭৩ বার বন্ধ ডেকে রাজ্যের স্বাভাবিক পরিস্থিতিকে অচল করতে চেয়েছেন! এই ইতিহাসও কখনো মুছে যাবার নয়!
পরিশেষে উল্লেখ করা প্রয়োজন , ১৯৫০-এর দশক থকে ৬০ ও ৭০-এর রাজনৈতিক উত্তাল ও বিক্ষুব্ধ দিনগুলিতে সর্বস্তরের শ্রমিক- কর্মচারী-শিক্ষকদের বিভিন্ন লড়াই-আন্দোলন সার্বিকভাবে রাজ্যের গণ আন্দোলনে গতিবেগ সঞ্চার করেছিল। অবশ্য তার পরিণতিতে অনেকের উপরেই নেমে এসেছিল নির্মম অত্যাচার ও নিদারুণ শাস্তির খাঁড়া। ১৯৭৭-এ রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠার পর সেই শাস্তি প্রত্যাহৃত হওয়ার পাশাপাশি শিক্ষক-কর্মচারীরা তাঁদের হারানো অধিকার ও মর্যাদা ফিরে পেয়েছিলেন। এটা রাজ্যের গণ আন্দোলনের ইতিহাসের এক স্বতন্ত্র অধ্যায়। কিন্তু এবারের ধর্মঘটের বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হলো, ১৯৭১ সালের আধা ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসের সময়কালে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে যে ধর্মঘট হয়েছিল,তার ৫২ বছর পর এবারের ধর্মঘটও ছিল প্রত্যক্ষভাবে স্বৈরাচারী রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে। এই ধর্মঘট লিখেছে নতুন অধ্যায় -- স্বৈর শাসকের রক্তচক্ষু, দমনপীড়ন, হিংসা দিয়ে আর দমানো যাবেনা শিক্ষক,শিক্ষা কর্মী ও কর্মচারীদের ন্যায্য দাবি, অধিকার রক্ষা আর গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার লড়াই। এদিনের এই ধর্মঘট অন্যান্য ক্ষেত্রের আন্দোলনকেও প্রাণিত করেছে। ১০ মার্চের ধর্মঘট জানান দিয়েছে--গণতন্ত্র বিরোধী, স্বৈরাচারী, দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারের বিরুদ্ধে এবং বিভেদের রাজনীতি রুখতে আরও বৃহত্তর লড়াইয়ের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে দিকে দিকে।
তথ্য সহায়তা - সন্দীপন রায়
(সন্দীপ দে একজন সাংবাদিক ও লেখক।)
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন