রাতারাতি শিবির বদল করে নবম বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নিয়েও একটুও স্বস্তিতে নেই নীতিশ কুমার। বরং আগামী ১২ ফেব্রুয়ারির আস্থা ভোটে আদৌ বিহারের নীতিশ সরকার টিকে থাকবে কিনা রাজনৈতিক মহলে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এখন সেটাই। কারণ শিবির বদলে এনডিএ-তে যোগ দিলেও এবং আপাতদৃষ্টিতে খুব সহজ মনে হলেও বিধানসভায় দাঁড়িয়ে নীতিশকুমারের পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতার অঙ্ক মেলানো এখন বেশ কিছুটা কঠিন।
আপাতত নীতিশকুমার যে বেশ কিছুটা ব্যাকফুটে তা বিহারের রাজনীতির গত কয়েকদিনের গতি প্রকৃতিতেই স্পষ্ট। যে কারণে এখনও মন্ত্রীসভা সম্প্রসারণের কাজ করে উঠতে পারেননি নীতিশ কুমার। আস্থা ভোটের আগে মন্ত্রীসভা সম্প্রসারণ করে দিলে আস্থা ভোটে ক্রস ভোটিং-এর সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিতে পারছেন না নীতিশ কুমার। ফলে যে আট জন মন্ত্রীকে নিয়ে তিনি নতুন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে গত রবিবার ২৮ জানুয়ারি তিনি শপথ নিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যেই দপ্তর বন্টন হয়েছে। যেখানে জেডিইউ-এর হাত থেকে অর্থ দপ্তর চলে গেছে বিজেপির সম্রাট চৌধুরীর হাতে।
উল্লেখযোগ্যভাবে অতীতে স্বরাষ্ট্র এবং সাধারণ প্রশাসন দপ্তর নীতিশ কুমার নিজের হাতেই রেখেছেন। এবার এখনও পর্যন্ত স্বরাষ্ট্র দপ্তর তাঁর হাতেই আছে। যদিও বিজেপি এখনও পর্যন্ত দপ্তর বন্টনের প্রশ্নে নীতিশকে বেশ চাপে রেখেছে বলেই রাজনৈতিক মহলের দাবি। ইতিমধ্যেই বিজেপির দুই উপমুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে সম্রাট চৌধুরী হাতে গেছে অর্থ, স্বাস্থ্য, নগর উন্নয়ন, আবাসন, ক্রীড়া, শিল্প, আইন এবং বাণিজ্যিক কর দপ্তর। বিজয় কুমার সিনহা নিয়েছেন কৃষি, রাজস্ব, ভূমি সংস্কার, শ্রম এবং সড়ক নির্মাণ দপ্তর।
অন্যান্যবারের তুলনায় বিজেপির এবারের দাবি অনেকটাই বেশী। বিজেপির ৭৮ বিধায়ক সম্বলিত দলের যে দাবি মাত্র ৪৫ বিধায়ক দলের নেতা নীতিশ কুমারের পক্ষে ফেলে দেওয়া সম্ভব নয় এবং তিনি তা ফেলতেও পারেননি। নিজের দুপাশে বিজেপির দুই কৈরি এবং ভূমিহার উপমুখ্যমন্ত্রীর সাঁড়াশি চাপে নীতিশ কুমার কতটা নড়াচড়া করতে পারবেন প্রশ্ন তা নিয়েই। যে জাতপাতের সমীকরণের রাজনীতি করতে নীতিশ অভ্যস্ত এবার সেই জাতপাতের অঙ্কই তাঁর পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
ইতিমধ্যেই উপমুখ্যমন্ত্রী সম্রাট চৌধুরী নীতীশ কুমারকে স্পষ্ট বার্তা দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন বিজেপি এবার কুশওয়াহা সম্প্রদায়ের ভোট ব্যাঙ্কে হাত দিতে চলেছে। বিহারের মোট জনসংখ্যার ৪.২১ শতাংশ কুশওয়াহা জনসংখ্যা এবং কুর্মি সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা ২.৮৭ শতাংশ। রাজ্যের ভোট শতাংশের বিচারে নীতিশ কুমারের জেডিইউ-এর ভোটের হার ১৫ শতাংশের কিছুটা বেশী। অন্যদিকে বিজেপির ভোট শতাংশের হার নীতিশের প্রায় দ্বিগুণের কাছাকাছি।
নীতিশ কুমারের আচমকা এই শিবির বদলে রাজ্যের একটা বড়ো অংশের মানুষের পাশাপাশি তাঁর নিজের দলেরই বেশ কিছু বিধায়ক ক্ষুব্ধ ও অসন্তুষ্ট। আরজেডি একদম চুপচাপ হয়ে গিয়ে তলে তলে অন্য কোন খেলা খেলছে তা নিয়েও এখন রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা। কারণ তেজস্বী যাদব সরকার পতনের পর প্রকাশ্যেই বলেছেন, ‘খেল তো আভি বাকি হ্যায়।’ সেই খেলা কী? আস্থা ভোটের দিন নীতিশ কুমারের দলের ৪৫ বিধায়কের সকলে তাঁর সঙ্গে থাকবেন তো? নাকি সেদিন গোপনে অন্য কোনও খেলা হয়ে যাবে? সে সম্ভাবনা কিন্তু একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। আর সত্যিই যদি তা হয় তাহলে বিহারের সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত রাজনৈতিক দলের নাম হবে জেডিইউ।
বিহারের বর্তমান সরকারে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান হতে চলেছে জিতন রাম মাঝির নেতৃত্বাধীন হ্যাম-এর। এই দলে মাত্র চার জন বিধায়ক থাকলেও সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রশ্নে তাদের গুরুত্ব অপরিসীম। এরা শিবির বদলালেই বিহার সরকার নড়বড়ে হয়ে যাবে, সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাবে। এই প্রসঙ্গে লোক জনশক্তি পার্টি (রামবিলাস)-এর প্রধান এবং ঘোরতর নীতিশ বিরোধী চিরাগ পাসোয়ানের বক্তব্যের দিকেও খেয়াল রাখা প্রয়োজন। যিনি সম্প্রতি জানিয়েছেন "কোন সন্দেহ নেই যে জিতন রাম মাঝির দলের বিধায়কের সংখ্যা কম কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের বিশাল গুরুত্ব রয়েছে এবং তিনি যদি জোটের মধ্যে আলোচনা করে থাকেন তবে এই সরকারে তাকে পর্যাপ্ত সম্মান দেওয়া উচিত।" নতুন সরকারের কাছ থেকে জিতন মাঝি যে সম্মান আশা করছেন তা না পেলে তিনি কী করবেন তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
এর পরেও পড়ে থাকছে আসন্ন লোকসভা নির্বাচন। মহাজোটবন্ধন-এ থাকার সময় কথা হয়েছিল নীতিশের জেডিইউ ১৬ অথবা ১৭ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। যদিও নীতিশ এনডিএ শিবিরে যোগ দেবার পর পরিস্থিতি অনেকটাই বদলেছে। কারণ বিজেপির কাছে নীতিশ ২০১৯ ফর্মুলা মেনে ১৭ আসন দাবি করলেও সেই সংখ্যক আসন বিজেপি ছাড়তে রাজি নয়। এখনও পর্যন্ত যা খবর, তাতে নীতিশকে বিজেপি ১২-র বেশী আসন ছাড়বে না। কারণ বিজেপিকে এনডিএ-র সঙ্গে থাকা এলজেপি-র দুই গোষ্ঠীকে আসন ছাড়তে হবে। আসন ছাড়তে হবে হ্যামকেও।
বিজেপি যদি জেডিইউ-কে ১২-র বেশী আসন ছাড়তে শেষ পর্যন্ত রাজি না হয় তাহলেও ঢোঁক গিলে এনডিএ-তে থেকে যাওয়া ছাড়া নীতিশের সামনে অন্য কোনও পথ খোলা নেই। এমনিতেই পাঁচ বার শিবির বদল করে নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা একেবারেই তলানিতে নিয়ে গেছেন নীতিশ। এই মুহূর্তে তাঁর পক্ষে আর শিবির বদলানো সম্ভব নয়।
রাজনৈতিক ঘটনা পরম্পরায় এটা খুবই স্পষ্ট যে বিহারে এবার আর ২০১৯-এর ফলাফলের পুনরাবৃত্তি হবেনা। যদিও জাতের রাজনীতির অঙ্কের দিকে লক্ষ্য রেখেই নীতিশকে নিজেদের শিবিরে টেনেছে এনডিএ। লক্ষ্য গতবারের মত ৫৪.৪ শতাংশ ভোট পাওয়া। যা এবার হবেনা। ফলে বিজেপির আসন যত না কমবে তার চেয়ে বেশী কমবে জেডিইউ-এর। স্পষ্টভাব বলতে গেলে নিজের অজান্তেই হয়তো নিজের রাজনৈতিক কবর খুঁড়ে ফেলেছেন নীতিশ কুমার।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন