এক।
শুনেছিলাম, পাঁচ ফুট চার ইঞ্চির ছিপছিপে মুম্বাইকার, রমাকান্ত দেশাই বল নিয়ে হাইকোর্ট এন্ড থেকে দৌড় শুরু করলেই নাকি, ইডেন গার্ডেনসের এক কোণে কে যেন ছন্দ মিলিয়ে কাঁসর-ঘণ্টা বাজাতো। সোবার্স-জাহির আব্বাসের দারুণ ইনিংসে উঠে দাঁড়াত ইডেন। ওয়াংখেড়েতে ভারত হারার পরও, গ্যাটিং’র ‘ঐতিহাসিক’ রিভার্স সুইপে ১৯৮৭’র বিকেলে তীরে এসে যেদিন তরী ডুবল ইংল্যান্ডের, সেদিনও বর্ডারের অস্ট্রেলিয়াকে অভিবাদন জানিয়েছিল ইডেন। ইডেনের সবুজ গালিচার কটা মানসপুত্র ছিল। ৪০’র দশকে মুস্তাক আলি। ৬০-এ সেলিম দুরানি। তারপর গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ, ভগবত চন্দ্রশেখর, কপিল দেব, আজাহারউদ্দিন। আর সকলকে ছাপিয়ে, ক্যারিবিয়ান ক্যালিপসোর ক্যারিশমাটিক ঐ রোহন কানহাই।
কিন্তু দিন গড়িয়ে সন্ধ্যে হতেই শ্রীলঙ্কার স্কিলের কাছে সেদিন মুখ থুবড়ে পড়ল ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা। দুপুরের টস থেকে নিয়ন আলোর স্নিগ্ধ ইডেনের র্যাঙ্ক টার্নারে প্রথম বলেই কট অ্যান্ড বোল্ড আজাহারউদ্দিন সেদিন ভিলেন। প্রবল প্রত্যাশার বাঁধ না মানা আবেগের একলাখি ইডেনে সেদিন অপমানের আগুন জ্বলল। আগুন অবশ্য ইডেনে আগেও জ্বলেছে। তবে সে আগুন কখনও উচ্ছ্বাসের, কখনও আনন্দের। ক্ষোভের আগুন সেই প্রথম।
১৯৯৯’র ফেব্রুয়ারি। চতুর্থ ইনিংসে পাকিস্তানের রান তাড়া করে দ্রুত জয়ের দিকে এগোচ্ছে ভারত। চতুর্থ দিনের লাঞ্চের পর শোয়েব আখতারের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কিতে বিতর্কিত রান আউটে সদ্য প্যাভিলিয়নে ফিরেছেন শচীন তেন্ডুলকার। আবার গর্জে উঠলো ইডেন। বিস্ময় বালকের মাঠ পরিক্রমা আর অনুরোধে সেদিন যুদ্ধবিরতি হয়েছিলো বটে, কিন্তু ঘৃণার আগুনে জ্বলতে থাকা ইডেনে পঞ্চম দিনের খেলা হয়েছিল কড়া পুলিশি পাহারায়, দর্শক শূন্য আসনে।
দুই।
ইডেনের বদলটা সমাজ বদলেরই প্রতিবিম্ব। ইতিহাস ঘাঁটলে বহু যুগ ধরেই ভারতীয় সমাজে ধর্মের প্রভাব আপনি দেখতে পাবেন। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে রাজনীতির ন্যারেটিভে ধর্মের ডাইরেক্ট এন্ট্রি ১৯৯২-র আদবানির রথ যাত্রা এবং পরবর্তী সময় বাবরি মসজিদ ধ্বংস। প্রছন্ন ভাবে হিন্দু ধর্মের একমাত্র রক্ষাকর্তা হিসেবে নিজেদের প্রোজেক্ট করতে চাইলেও, সঙ্ঘ পরিবারের ঘোষিত এজেণ্ডা - ‘হিন্দুত্ব’। খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে, সঙ্ঘ পরিবারের কাজ - ভারতের সোশ্যাল ফ্যাবরিককে পরিবর্তন করে রাজনৈতিক হিন্দু তৈরি করা; ধর্মকে রাজনীতির কাজে ব্যবহার করা; ধর্মকে লার্জার দেন লাইফ হিসেবে প্রমোট করা; ধর্মকে যুক্তি, তর্ক, বিজ্ঞানের উপরে নির্মাণ করা।
২০২১-এ বাংলায় বিধানসভা নির্বাচনের সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এসে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন। যা থেকে সঙ্ঘ পরিবারের কয়েক দশকের কোর অ্যাজেন্ডার একটা আন্দাজ আপনি পেতে পারেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন ‘বাঙলা তে ধর্মের সম্মান নেই। বাঙলায় ধর্মের সম্মান ফিরিয়ে আনতে হবে।’ আচ্ছা খুব সূক্ষ্ম ভাবে ভাবতে গেলে এই ধর্মের সম্মান মানেটা ঠিক কি?
ধর্মের সম্মান ফিরিয়ে আনতে হবে মানে, আপনি ধর্মকে নিয়ে হাসাহাসি করবেন, ব্যাঙ্গ চিত্র আঁকবেন - চলবে না। বাক স্বাধীনতার নামে বন্ধুর ভুঁড়ি দেখে গণেশের নামে প্যাঁক দেবেন কিম্বা কাঁচা কার্তিক বলবেন - চলবে না। বাচ্চারা ঠাকুরের কেন চারটে হাত, পাঁচটা মাথা থাকে জিজ্ঞেস করলে আপনি দাঁত ক্যালিয়ে হাসবেন - চলবে না। গায়ের রঙ কালো এমন ঠাকুর খুঁজে পাওয়া যায় কেন প্রশ্ন করবেন – চলবে না।
ধর্মের সম্মান ফিরিয়ে আনতে হবে মানে, ধর্মকে চার ভরি সোনার গয়নার মতো পরতে ইচ্ছে না হলে খুলে রাখা যাবে না। কিম্বা ল্যাকমে কোম্পানির ২০০ টাকার নেল পোলিশের মত পছন্দ না হলে, ৩০ টাকার রিমুভার দিয়ে তুলে দেওয়া যাবে না। ধর্ম হল গিয়ে ‘গার্জেন’। আপনারও গার্জেন, আপনার বাপেরও গার্জেন, সবার গার্জেন! ধর্মকে গার্জেনের মতই ট্রিট করতে হবে। প্রশ্ন করা যাবে না। আঘাত করা যাবে না।
তিন।
১৯৯২ যদি হয় একটা টার্নিং পয়েন্ট হয়, তাহলে বাঙলার জন্য সেটা তৃণমূলের উত্থান। সাম্প্রতিক কিছু সময়ে বাঙলার বিভিন্ন জায়গায় যে ধর্মীয় উত্তেজনা তৈরি হয়েছে সেখানে দুটো বিষয় বিশেষ ভাবে খেয়াল করা প্রয়োজন। প্রথমত, তৃণমূল সরকারের প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা। দ্বিতীয়ত, ১২ মাসে ১৩ পার্বণের বাঙলাতে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি হওয়ার উৎসবগুলি হল রামনবমী কিংবা হনুমান জয়ন্তী। আজ থেকে বছর কয়েক আগেও বাঙালী যে দুটো উৎসবের নামও হয়ত জানতো না।
ফলত এই ধর্মীয় উত্তেজনার নেপথ্যে যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে সেটা বুঝতে তো আর রকেট সায়েন্স জানতে হবে না! আপনি বর্তমান রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতিটা একটু আতস কাঁচের নিচে ফেলে দেখুন। দুর্নীতিতে জেরবার তৃণমূল কংগ্রেস। বাঙলার প্রতিটি কোণায় “তৃণমূল চোর” এই কথাটার সামাজিকরণ হচ্ছে। যেটা যে কোনও রাজনৈতিক দলের পক্ষে বিপজ্জনক। অন্যদিকে বিজেপি জাতীয় রাজনীতির ভরকেন্দ্রে থেকেও সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্ত সূচকে ক্রমশ পিছচ্ছে ভারত। তার থেকে বড় কথা বর্তমান বাঙলায় বিজেপি বকলমে উধাও।
যে সমস্ত মানুষ বিজেপিকে তৃণমূলের বিকল্প হিসেবে ভেবেছিলেন তারা দ্রুত সরছেন, সেকথা দিনের আলোর মত স্পষ্ট হয়ে গেছে ২০২১ পরবর্তী সময়ের নির্বাচনে। আর এই দুই-র বিপক্ষে বামপন্থীদের বহু প্রত্যাশিত উত্থান গতি পেয়ছে। এই আঙ্গিকেই ধর্মীয় উত্তেজনা তৈরি করে রাজ্য রাজনীতির বাইনারিটাকে আবার তৃণমূল বিজেপিতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টাই মুখ্য উদ্দেশ্য, এই রাজনৈতিক মতের যথেষ্ট সারবত্তা আছে। আর এখানেও ভয় সঙ্ঘ পরিবারের।
চার।
আসলে বাঙলাতে ধর্ম পালনের অধিকারের সঙ্গেই যুক্তিবাদের সহাবস্থানের সামাজিক যে পরিবেশ বিরাজ করে, মুক্তমনা যে সংস্কৃতিতে আমরা বড় হওয়ার সুযোগ পেয়েছি তার জন্য বামপন্থীদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ধর্ম পালন সম্পর্কে বামপন্থীরা দুটো কথা খুব জোর দিয়ে বরাবর বলে এসেছে। প্রথমত, ধর্ম পালনের অধিকার সবার রয়েছে। কিন্তু ধর্ম পালন ব্যক্তিগত বিষয়। রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে ধর্মের কোন যোগাযোগ থাকা উচিৎ না। দ্বিতীয়ত, বামপন্থীরা ধর্ম পালনের বিষয়টি একমাত্রিক স্বাধীন কোনও বিষয়ে হিসেবে দেখে না। বরং আর্থ-সামাজিক বিন্যাসের দ্বান্দ্বিকতার ভিত্তিতেই ধর্ম পালনের বিষয়টি ব্যাখ্যা করে এবং সমাধানের চেষ্টা করে।
মানুষের জীবন জীবিকার সমস্যা, অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানে দায়বদ্ধ প্রগতিশীল কোন রাষ্ট্রের ভিত্তি ধর্ম হতে পারে না। কিন্তু বিজেপির মত যে কোনও ফ্যাসিস্ট পার্টির মোডাস অপারেণ্ডির একটা গুরুত্বপূর্ণ পার্ট হল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্তরে প্রভাব বিস্তার করা। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্তরে ধর্মের এই আনাগোনা বিজেপির রাজনৈতিক উত্থানের সমান্তরাল এবং বাই প্রোডাক্ট। ভারতের বহুত্ববাদকে নষ্ট করে সঙ্ঘ পরিবারের একমাত্রিক হিন্দুত্বর অ্যাজেন্ডার প্রতিষ্ঠা করার ব্লু প্রিন্ট।
দুর্গাপূজার কমিটিতে অনুদান দিয়ে কিম্বা সফট হিন্দুত্বের কোলে দুলতে দুলতে এই সুদূরপ্রসারী বিপদের গুরুত্ব বুঝতে পারা, তা প্রতিরোধ করার ক্ষমতা অর্জন করা সম্ভব না। প্রয়োজন গভীর আদর্শবোধ! আর তাই সেটা পারে একমাত্র বামপন্থীরা। আর সেটা সঙ্ঘ পরিবার বোঝে বলেই, তৃণমূল বিজেপির ন্যাচারাল অ্যালি। সঙ্ঘ পরিবার জানে, ৩৪ বছরে এই রাজ্যে ধর্মের নামে বেয়াদপি করা যায়নি, আর আবার বামপন্থীরা এলে আবারও যাবে না। কেউ না কেউ হিম্মত নিয়ে বুক চিতিয়ে বলবে “পুলিশকে বলেছি দাঙ্গাবাজদের মাথায় গুলি করতে।” ওপেন অ্যান্ড শাট কেস!
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন