আগামী ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সেই অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সুবর্ণ জয়ন্তীর অনুষ্ঠানে মোদির আগমনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলে ও সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। সরকার, প্রশাসন ও সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের সাথে মোদি বিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয়া সাধারণ মানুষ ও বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন এখন মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। প্রতিদিনই ঢাকাসহ সারাদেশে প্রতিবাদ কর্মসূচি চলছে। আন্দোলনকারীদের উপর প্রশাসন ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হামলা করছে। চলছে ধরপাকড়। সব কিছু উপেক্ষা করেই মাঠে নেমেছে বিভিন্ন ছাত্র রাজনৈতিক সংগঠন ও মূলধারার রাজনৈতিক সংগঠন।
নরেন্দ্র মোদির আগমনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক মহল থেকে যে বিরোধিতা শুরু হয়েছে সেই প্রতিবাদ থেকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও তাদের জোট সঙ্গীরা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেছে। একই কাজ করছে সরকার দলীয় জোটের শরিক ১৪ দলের সবকটি দল। বাংলাদেশে মোদির আগমন বিরোধী আন্দোলন মূলত শুরু হয়েছে বিভিন্ন ছাত্র রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, ছাত্র ফেডারেশন, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী সহ অন্যান্য বামপন্থী ছাত্র সংগঠন সমূহ প্রতিবাদে মাঠে নামে। গত ১৫ তারিখ থেকে তারা বিভিন্ন কর্মসূচি দিয়ে সারাদেশে প্রতিবাদ মিছিল, মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৮ মার্চ ৯টি প্রগতিশীল বামপন্থী ছাত্র সংগঠন মিলে বিক্ষোভ মিছিল করে এবং মিছিল শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিন থেকে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে লাগাতার কর্মসূচি ঘোষণা করে। সংবাদ সম্মেলনে তারা নরেন্দ্র মোদিকে একজন, ‘দাঙ্গাবাজ, সাম্প্রদায়িক, অগণতান্ত্রিক ও ফ্যাসিস্ট’ আখ্যা দিয়ে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে তাকে আমন্ত্রণ জানানো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিপন্থী বলে উল্লেখ করেন। সংবাদ সম্মেলনে তারা বলেন, ‘এই নরেন্দ্র মোদির হাতে এখনো গুজরাটের হাজার হাজার মানুষের রক্তের দাগ লেগে আছে। গত বছর দিল্লি কিলিংয়ের ঘটনা মোদি সরকারের নির্দেশে ঘটেছে। মানবতাবিরোধী নাগরিকত্ব আইন করে আসাম ও পশ্চিমবাংলা থেকে কয়েক লক্ষ বাঙালী জনগণকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার আয়োজন করেছে মোদি সরকার। প্রবলভাবে সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দিচ্ছে। ভারতের জনগণের ন্যায়সঙ্গত সমস্ত আন্দোলনকে কঠোরভাবে দমন করছে। সাম্প্রতিক কৃষক আন্দোলনে আমরা মোদি সরকারের ফ্যাসিস্ট রূপ দেখেছি।’
বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রতিবাদ কর্মসূচিতে মোদি বিরোধিতার পাশাপাশি ভারতের সাথে বাংলাদেশের বন্ধুত্বের যে সুসম্পর্ক রয়েছে সেটারও সমালোচনা করা হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনের প্রদত্ত বক্তব্যে তারা সীমান্ত হত্যাকাণ্ডের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে প্রায়শই বিএসএফ গুলি করে বাংলাদেশের জনগণকে হত্যা করছে। কিন্তু এসব হত্যার কোনো বিচার হচ্ছে না। তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা বাংলাদেশ পাইনি। তিস্তা চুক্তির কথা থাকলেও দীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। নদী, বন্দর, সুন্দরবন সমস্ত কিছু ভারতীয় আগ্রাসনের শিকার। এমনকি বাংলাদেশের রাজনীতির অভ্যন্তরীণ ব্যাপারেও হস্তক্ষেপ করছে। ফলে, মুক্তিযুদ্ধে গণমানুষের যে আকাঙ্খা দাঙ্গাবাজ ,সাম্প্রদায়িক মোদির অংশগ্রহণ গৌরবোজ্জ্বল সে ইতিহাসের সাথে সাংঘর্ষিক। আমরা তা হতে দিতে পারি না।’ এরই ধারাবাহিকতায় বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলো এককভাবে ও জোটগতভাবে গত কয়েকদিন থেকে সারাদেশে লাগাতার প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করছে।
এদিকে সরকার ও সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন এবং পুলিশ প্রশাসন মোদি বিরোধী প্রতিবাদ কঠোরভাবে দমন শুরু করেছে। গত ২৩ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দুটি ভিন্ন ভিন্ন প্রতিবাদ কর্মসূচিতে ছাত্রলীগ হামলা চালায়। ২৩ মার্চ সকাল ১১টায় বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের প্রতিবাদ মিছিলে হামলা করে ছাত্রলীগ এবং মোদির কুশপুত্তলিকা কেড়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। একই ঘটনা ঘটে বিকেলে প্রগতিশীল ছাত্র জোটের প্রতিবাদ মিছিলে। সেখানেও হামলা করে এবং ২০ জন নেতাকর্মীকে আহত করে। আহতদের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক সুমাইয়া সেতু ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক আসমানী আশা। গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি করানো হয়। এছাড়াও সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট নেত্রী প্রগতি বর্মণও গুরুতর আহত হয়ে মেডিক্যালে ভর্তি হন। ২৪ তারিখে সিলেটে বাংলাদেশের বিভিন্ন বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর মোর্চা ‘বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট’র প্রতিবাদ কর্মসূচিতে পুলিশ হামলা করে ১০ জনকে আটক করে। অনেকে আহত হন। একই পরিস্থিতি সারাদেশে।
নরেন্দ্র মোদির আগমনের প্রতিবাদ করছে বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। তারাও গত প্রায় এক সপ্তাহ থেকে লাগাতার প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করছে। ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ ২০১৮ সালে বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন নামে বৃহৎ আন্দোলন থেকে তৈরি হয়। বর্তমানে সারাদেশের জেলা, উপজেলা ও শিক্ষপ্রতিষ্ঠানগুলোতে তারা ভালো অবস্থান করে নিয়েছে। ২০১৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি পদেও তাদের প্রার্থী নির্বাচিত হয়। ফলে তারা এখন বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতি তো বটেই মূলধারার রাজনীতিতেও ‘ফ্যাক্টর’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারাও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে মোদির আগমন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে মাঠে নিয়মিত কর্মসূচি পালন করছে। একই সাথে তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা, সীমান্ত হত্যা, এনআরসি ইত্যাদিকে ঘটনাগুলো নিয়েও তারা মোদির আগমনের তীব্র বিরোধিতায় মাঠে নেমেছে।
বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক মোঃ রাশেদ খান বলেন, ‘আমরা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরোধী করছি। ভারতে জনগণের সাথে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। আমরা একজন গণহত্যাকরী, ফ্যাসিস্ট ও সাম্প্রদায়িক মোদির বিরোধিতা করছি। তার মতো একজন ব্যক্তিকে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে বাংলাদেশের ছাত্র সমাজ ও সাধারণ মানুষ চায় না।’ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় জনগণ ও সে সময়ের কংগ্রেস সরকার যে সহযোগিতা করেছিল সেটা অতুলনীয়। আমরা সেজন্য ভারতের জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞ।’
ইসলামপন্থী বিভিন্ন সংগঠনগুলোও মোদি বিরোধী আন্দোলন করছে। তাদের প্রতিবাদের মূলে রয়েছে ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট। তারা মোদির আগমনকে ধর্মীয় কারণে প্রতিহত করতে চায়। তবে এই ধারার আন্দোলন খুবই ক্ষীণ।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আগমনের বিরুদ্ধে যে বা যারা প্রতিবাদ করবে কিম্বা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে তাদের কঠোরভাবে প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন। গত ১৫ মার্চ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার গত ১৭ মার্চ থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত সব ধরণের রাজনৈতিক কর্মসূচির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে মোদি বিরোধী যে কোন আন্দোলনকে কঠোরভাবে দমন করা হবে বলেন। ডিএমপি কমিশনারের বক্তব্যের পরই বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ও অন্যান্য প্রগতিশীল সংগঠনগুলো এই সিদ্ধান্তের নিন্দা জানিয়ে সংবাদ বিবৃতি দেয় এবং প্রতিবাদ কর্মসূচি ঘোষণা করে।
নরেন্দ্র মোদির আগমন প্রতিহত করার আন্দোলনটি বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলো শুরু করলেও এনিয়ে সরকার ও প্রশাসনের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের বিবৃতি এবং ছাত্রলীগের হামলার ঘটনায় আন্দোলন ক্রমে গণচরিত্র ধারণ করছে। এবিষয়ে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক দীপক শীল বলেন, ‘নরেন্দ্র মোদি একজন গণহত্যাকারী, দাঙ্গাবাজ, সাম্প্রদায়িক ও ফ্যাসিস্ট চরিত্রের ব্যক্তি। তার হাতে গুজরাট দাঙ্গায় নিহতদের রক্তের দাগ লেগে আছে। গত বছর তার নির্দেশেই দিল্লিতে দাঙ্গা হয়েছে। বিভিন্ন প্রগতিশীল ব্যক্তিদের উপর দমন-পীড়ন চালানো হচ্ছে। তথাকথিত নাগরিকত্ব বিলের নামে আসামে ১৯ লাখ মানুষের রাষ্ট্র পরিচয় কেড়ে নিয়েছে মোদি সরকার। তার মতো একজন আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে আসা মানে মুক্তিযুদ্ধের যে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা। আমরা তা হতে দিতে পারি না। ছাত্র ইউনিয়ন দেশের সাধারণ মানুষকে সাথে নিয়ে মোদির আগমন প্রতিহত করবে।’
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন