বাংলাতে এখনও পর্যন্ত যতগুলো 'ওয়েব' তৈরী হয়েছে, তারমধ্যে হাতে গোনা ৪-৫টার ক্ষেত্রে বলা যায় যেখানে ক্যামেরা ও সাউন্ড কথা বলেছে। ‘রক্তপলাশ’ ওয়েব সিরিজও সেই দলে জায়গা করে নেবে। কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের ‘মেঘে ঢাকা তারা’ দেখলেই বোঝা যায় তিনি এই ধারায় বিশ্বাসী। যেটা আজকাল খুব কম সিনেমা বা ওয়েবে ধরা পরে।
যদিও প্রথমেই বলে রাখি ‘কালার কারেকশন’ আমার পছন্দ হয়নি। কিন্তু জঙ্গলমহলের প্রেক্ষাপটে নির্মিত রক্তপলাশ যে কথা বলে তা আজকের সমাজ জীবনকে ঠাঁটিয়ে থাপ্পড় কষায়। এই গল্প সেইসমস্ত মুখোশ পরা মানুষগুলোর মুখোশে টান দেয়, যে মানুষগুলো নিজেদের সভ্য বলে দাবী করে তাদের। শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য তারা সমাজের সবচেয়ে অন্ধকার এলাকায় নেমেও হাত ধুয়ে নিতে পারে। আসলে এটাই বোধ হয় পুঁজিবাদী দুনিয়ার আখর কথাও।
বিদ্যাসাগর তার লেখা সভ্য অসভ্য গল্পে কে সভ্য আর কে অসভ্য তার পার্থক্য আমাদের জানান দিলেও আমরা ভুলে যাই। ভুলে যাই আমাদের নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির তাগিদেই। তাই একজন চিকিৎসক রোগীদের গিনিপিগ বানাতে পিছপা হন না, বা একজন তথাকথিত প্রগতিশীল লেখক তার বিপ্লবী বন্ধুর ঠিকানা খুব সহজেই রাষ্ট্রের হাতে তুলে দেন। এই গল্প প্রশ্ন তোলে বিপ্লবের রাস্তা নিয়েও। পরিচালক আমাদের সমাজের এইরকম বিভিন্ন অংশকেই সাবলীল ভঙ্গিতে প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড় করালেন।
গল্পের মূল প্রেক্ষাপটে পরিচালক সাতজন ব্যক্তির আভ্যন্তরীণ সাদা-কালোর দ্বন্দ্বগুলো একটা মালায় গেঁথে দিয়েছেন। যখন এই সাতজনের অন্তর্দ্বন্দ্বে সভ্য যাপনের শহুরে মুখোশ খুলে গিয়ে স্বার্থপর চারিত্রিক বৈশিষ্টগুলো ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকে তখনই তাদের রিসর্টে বন্দি হয়ে পড়েন মুক্তিপণের টোপ হিসেবে। পুরনো অন্তর্দ্বন্দ্ব মুছে তাদের মধ্যে প্রকাশ পায় জান্তব বৈশিষ্টগুলো। কার্ল মার্ক্সের কথা মত সেই পুঁজিবাদী সমাজ নারী শরীরকে বিক্রি করে নিজেদের বাঁচার প্রয়োজনে।
বিভিন্ন চরিত্রে আছেন অসীম রায় চৌধুরী, দেবদূত ঘোষ, শিলাজিৎ, অনন্যা সেনগুপ্ত, উৎসব মুখার্জী, রোজা পারমিতা দে, মৌমিতা পণ্ডিত, শুভজিত কর, শিশু শিল্পী তামান্না এবং কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় স্বয়ং। উৎসব মুখার্জী যে ক্যামেরার সামনেও এতটা সাবলীল তা আগে জানা ছিলো না। নজর কেড়েছেন অনন্যা সেনগুপ্তও। তবে যার কথা না বললেই নয় তিনি মৌমিতা পণ্ডিত। চরিত্রের প্রয়োজনে এতটা রুক্ষ অভিনয় খুব কম দেখা যায়। কেন একজন নারী পতিতা হয়? একজন পতিতার কি নিজের পছন্দ অপছন্দ বলে কিছুই নেই? নাকি সমাজ আর তা মনে করে না? এই প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা চরিত্রে মৌমিতা বড্ড বেশী ন্যাচারাল, সাবলীল।
‘ডার্ক এনার্জি’ প্রযোজিত রক্তপলাশ নিঃসন্দেহে এক রাজনৈতিক ছবি। এক ছক ভাঙা গল্প। এক আদিম জঙ্গলের প্রেক্ষাপটে নির্মিত রহস্য ও রোমাঞ্চ সিরিজ। রাজনৈতিক ছবি বলেই প্রশ্ন তোলে চরমপন্থীদের মধ্যস্থতাকারী একটা রাষ্ট্রের দালাল? কেন তাদের মধ্যে বিশ্বাসঘাতকতা? কেই বা করলেন?
প্রশ্ন উঠবে। সময়, পরিস্থিতি মানুষকে প্রশ্ন করতে শেখায়। আর শিল্পী যে তা আগে থেকেই দেখবেই তাই তো স্বাভাবিক। কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় সেই প্রশ্ন তোলার কাজ শুরু করে দিলেন।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন