১৪৫তম জন্মদিনে দাঁড়িয়ে স্তালিনকে স্মরণ করলে তাঁর বিপ্লবী কর্মকাণ্ডতেই ফিরে যেতে হয়। মার্কস-এঙ্গেলসের ঐতিহাসিক মতবাদের বাস্তব রূপায়ণে তাঁর ভূমিকার দিকে আমাদের চেয়ে থাকতে হয়। বিজ্ঞাননির্ভর মার্কসবাদী তত্ত্বের বিকাশে মহান লেনিনের পাশাপাশি তাঁর উজ্জ্বল অবদান সেখানে মুক্তিকামী শ্রমজীবী মানুষের জীবন-ইতিহাসে শিরোনাম হয়ে থাকে।
পশ্চাৎপদ কৃষি-অর্থনীতিতে ভর করে রুশ দেশের সমাজ কাঠামোকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের মূলে ছিল লেনিনের শিক্ষা। সেই জ্ঞানে, লেনিনের মৃত্যুর পর, সামাজিক পরিবর্তনের মূল চালিকা শক্তি সমবেত রুশ জনগণ হলেও, স্তালিনকে তার প্রধান স্থপতি ও রূপকার বলা চলে। বিপ্লবের সফল রূপায়ণে তাঁর অসামান্য অবদান পৃথিবীর ইতিহাসে আজও অমলিন।
লেনিনের পরে তিনিই ছিলেন শ্রমিকশ্রেণীর আন্তর্জাতিকতা ও বিশ্ববিপ্লবের উদ্গাতা। বিশ্বের বিপুলাংশে সাম্যবাদের পতাকা তুলে ধরতে প্রতিবাদী মানুষকে তিনিই সাহস যুগিয়েছেন। তাঁর নেতৃত্বেই ফ্যাসিস্ট হিটলার চরমভাবে পরাজিত হয়েছেন। সেই অসামান্য অবদানে তাঁর নাম সমাজ গঠনের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। আজও তিনি আমাদের কাছে তাই মার্কসবাদী-লেনিনবাদী তত্ত্বের একজন সর্বজনস্বীকৃত শিক্ষক৷
নীতির ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন আপোষহীন। একটি জাতি অথবা রাষ্ট্রগুলির পরিণাম বর্তমানে শুধু নেতাদের দিয়েই নির্ধারিত হয় না, নির্ধারিত হয় প্রথমত এবং প্রধানত লক্ষ লক্ষ মেহনতী জনসাধারণের কর্মকাণ্ডের দ্বারা। সুতরাং শুধুমাত্র নেতাদেরই ইতিহাসের স্রষ্টা বলে মনে করার কোনো কারণ তিনি দেখেন না। বরং বলশেভিক বিপ্লবের পর থেকে শ্রমিক, কৃষক ও মেহনতি মানুষের কথায় ইতিহাস যে উজ্জ্বল হয়ে ওঠতে শুরু করে, সেটা তিনি দেখান।
তিনি মানতেন, একটি কাল যখন শুরু হয়, তখন তাকে এমন কতকগুলি পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়, যা ঘটনার উপাদান হিসেবে সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত ছিল। সেই কালের নিরিখে নেতৃত্ব পরিস্থিতিগুলিকে যতটা গভীরে হৃদয়ঙ্গম করতে এবং কীভাবে তা পরিবর্তন করা যায় তা বুঝতে সক্ষম হবেন, তত সহজে সমাজ পুনর্গঠনের কাজটা করা সম্ভবপর হবে। তিনি বলতেন, “এ কথা বোঝার সময় এসেছে যে পৃথিবীতে যতরকম মূল্যবান পুঁজি আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান এবং সবচেয়ে নির্ধারক পুঁজি হল জনগণ, কর্মীগণ।”
সেই চেতনায় পারিবারিক জীবনেও তিনি কমিউনিস্টসুলভ আচরণ প্রকাশ করেছেন। স্ত্রী ছিলেন একজন সাধারণ কর্মী। নিজের পুত্রদের পাঠিয়েছেন যুদ্ধক্ষেত্রে। নাৎসি জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের জন্য অপারেশন বারবারোসা শুরু করলে তিনি জ্যেষ্ঠ সন্তান ইয়াকভ ইওসিফোভিচ ঝুগাশভিলিকে (যিনি ছিলেন প্রথম স্ত্রী কাতো সভানিদজের পুত্র এবং যিনি তার জন্মের নয় মাসের মাথায় মাতৃহারা হন, ২২ নভেম্বর, ১৯০৭) আক্রমণের সম্মুখে পাঠান। তাঁকে জার্মানরা বন্দী করে। তাঁর মুক্তির জন্য স্তালিন মুচলেখা দিতে অস্বীকার করলে ১৪ এপ্রিল, ১৯৪৩ সালে সাচসেনহাউসেন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে তাঁকে মেরে ফেলা হয়।
গুপ্ত পুলিশের অফিসার অর্লভ, ইতিহাস রচয়িতা কটকিন, মন্তেফিওরে প্রমুখ এই প্রসঙ্গে অনেক রূপকথার গল্প ছড়ালেও এটা প্রতিষ্ঠিত হয় না যে স্তালিন তাঁর মাতৃহারা প্রথম সন্তানকেই কেবল মাত্র লাল ফৌজে সামিল করেছিলেন। ভাসিলি আইওসিফোভিচ স্তালিনকেও (যিনি ছিলেন দ্বিতীয় স্ত্রী নাদেজহদা আলিলুয়েভার প্রথম সন্তান) যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠান। ভাসিলি বিমান বাহিনীতে যোগ দেন। ইঞ্জিনিয়র দাদা ঝুগাশভিলি ছিলেন পদাতিক বাহিনীতে।
রাজনৈতিক অবস্থানে সংগঠনের স্বার্থে কর্মীর কমিউনিস্ট পরিচয় তার কাজের ধারায় প্রতিভাত হয়। স্তালিন সেই কথা মানতেন। সেটা না মানলে শৈশব থেকে যৌবন জুড়ে বিপ্লবী কার্যকলাপের সংস্পর্শে থাকা আলিলুয়েভাকে ১৯২১ সালে, প্রথম সন্তান ভ্যাসিলির জন্মের কয়েক মাস পরে, বলশেভিক পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হয়! ১৯১৯র মার্চে তাঁদের দাম্পত্য জীবন শুরু হয়েছিল। ইতিহাসবিদ ওলেগ খলেভনিউকের মতে পরিবার ও সন্তান লালনে বেশী সময় দেওয়ার জন্য পার্টির কাজ পরিচালনা করতে আলিলুয়েভার সমস্যা হচ্ছিল। পার্টির স্বার্থে স্তালিন ছিলেন বজ্রকঠিন। একজন পিতা, একজন স্বামী, অথবা একজন বন্ধু পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে তিনি একজন কমিউনিস্ট সংগঠক হতে পেরেছিলেন।
স্তালিন যুগ পরিচয়ে রচিত পশ্চিমী ইতিহাস ঘাটলে সোভিয়েত বিরোধী ঐতিহাসিক বয়ানের স্ববিরোধিতা চোখে পড়ে। সেই বিকৃতি অনেকাংশেই রাজনৈতিক। সেখানে সহজে স্বীকার করা হয় না যে কেন ইভান পেত্রোভিচ পাভলভকে বিপ্লবের পরেও বিজ্ঞানের অগ্রগতির জন্য গবেষণা চালাতে বলশেভিক পার্টি সহায়তা করেছিল? স্তালিনের সময়ে শিক্ষার অগ্রগতি, বিজ্ঞান গবেষণার ভিত্তি প্রসারিত না হলে মহাকাশ দৌড়ে ১৯৬১র এপ্রিলে সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি স্পষ্ট বিজয় অর্জন করা কীভাবে সম্ভব হয়েছিল?
সমালোচকেরা যাকে স্তালিনায়ন আখ্যায় কটাক্ষ করেন, সেটার প্রভাবেই যে ১৯৩০-এর দশকের শুরুতে চালু হওয়া র্যাডিক্যাল অর্থনীতির তরঙ্গ সোভিয়েত ইউনিয়নের শিল্প ও কৃষির অভিমুখকে সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল, সেটা তাঁরা মানেন না। কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পিত এই রাজনৈতিক-অর্থনীতি (এটি ‘গ্রেট টার্ন’ নামে পরিচিত) বড় দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় অনেকাংশে সফল হয়। পারমাণবিক বোমার আবিষ্কার, যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠন, ভোস্তক ১-এ চড়ে ইউরি গ্যাগারিনের মহাকাশ বিজয় – এই সবই সেই ধারাবাহিক পরিকল্পনার ফলাফল। তাঁর শান্তি নীতি সমাদৃত হয়েও আজ আড়ালে রাখার ষড়যন্ত্র চলে। সামাজিক পরিসরে মেয়েদের সিদ্ধান্ত-গ্রহণের ক্ষমতা এবং বাড়ির বাইরের কাজে তাদের অংশগ্রহণের মাত্রা জার-শাসনকালের থেকে কতটা এগিয়ে থাকে, সেটা সমালোচকগণ বলেন না। তারা যেটা বলেন তাতে পুঁজিবাদের বুকে কাঁপন ধরানোর শ্রেণী চরিত্রে আমরা আজও স্তালিনকে খুঁজে পাই।
শুধুই কি পুঁজিপন্থী সমালোচকেরাই স্তালিনকে কলঙ্কচিহ্নিত করেছিলেন? কখনই না। শ্রেণী-সংগ্রাম স্থগিত রাখার প্রসঙ্গটিকেই যদি ধরি তবে দেখবো যে পার্টির অভ্যন্তরেও তেমন পরিস্থিতির জন্ম হয়েছিল। নীতির ক্ষেত্রে আপোষ করতে অভ্যস্ত না থাকা স্তালিনও কোথাও লেনিনের সেই এক পা আগে, দুই পা পিছে চলার নীতিটিকে মেনে চলতেন। হয়তো সেই কারণেই তাঁকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সাময়িকভাবে শ্রেণী-সংগ্রাম স্থগিত রাখতে বাধ্য করে। মতাদর্শের প্রতি এই আমলাতান্ত্রিক চাপ যাঁরা প্রয়োগ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে পলিটব্যুরোর তৎকালীন সদস্যদের বৃহদাংশ নিশ্চয়ই ছিলেন।
অপবাদ তাঁকে নিকিতা ক্রুশ্চেভও কম দেননি। একজন পরিচালকের নৈর্ব্যক্তিক অবস্থানের দৃঢ়তায় তাঁকে অনেক কিছুই সইতে হয়েছে। এই প্রসঙ্গে হয়তো আমাদের অনেকেরই লাল ফৌজের সেই সকল সর্বোচ্চ অধিনায়কের কথা মনে পড়ে, যাঁদের বিচার হয়েছিল সোভিয়েত সামরিক আদালতে। সেই বিচারে সোভিয়েত সেনাবাহিনীর শ্রেষ্ঠ উদীয়মান প্রতিভাদের আসামী হিসেবে দেখা যায়। বিচার শেষে তুখাচেভস্কি, উবেরোভিচ, গামার্নিক, আইদেমান, য়াকির, ফেল্ডমান, পুতনা, প্রিমাকভ, কোর্ক এবং ক্লুখেরের মতো সেনানায়কদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। গোটা বিষয়টাকে পরবর্তীতে ক্রুশ্চভ ভুল দাবি করেন এবং অপরাধ স্তালিনের ঘাড়ে চাপান। সোভিয়েত এনসাইক্লোপিডিয়ায় ওঁদের সংক্ষিপ্ত জীবনী ছেপে ক্রুশ্চেভ তাঁদের স্মৃতিরক্ষার ব্যবস্থা করেন।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এনসাইক্লোপিডিয়ায় সবার নাম নেই। নিষ্কলঙ্ক প্রচারের সেই রাজনৈতিক কৌশলে এনসাইক্লোপিডিয়ায় ফেল্ডমান, প্রিমাকভ, পুতনা, ক্লুখের এবং কর্কের নাম বাদ যায়। সুতরাং ক্রুশ্চেভও পরোক্ষে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগটা অস্বীকার করতে পারেন না। তবুও কোথাও নিন্দুকের প্রচারে গুলাগের সমার্থক শব্দ হয়ে ওঠে সোসো। কবিদের বধ্যভূমির রচয়িতা হয়ে ওঠেন জোসেফ। একচ্ছত্রবাদের নাম হয় স্তালিন। আর আধুনিক রুশ সমাজ হয়ে ওঠে দস্তয়েভস্কির অলিখিত উপন্যাস।
সেই বিকৃতিতে পিতিরিম সরোকিনের মতো সমাজতাত্ত্বিকের অবদানও কম নয়। ঠাণ্ডা লড়াইয়ের সময় সিআইএর সহযোগিতায় সেটা ব্যাপক মাত্রায় পৌঁছায়। গত শতাব্দীর নয়ের দশকের পরে তা অনন্য রূপ ধারণ করে। কমিউনিস্ট পার্টিকে ধ্বস্ত করে পুঁজিবাদের বিকাশ সর্বমাত্রিক করে তোলার রাজনৈতিক কৌশলে আজও স্তালিনের রক্ত ঝরে। যন্ত্রণার বালুচরে শেকল ছেঁড়ার স্বপ্ন বুকে নিয়ে একাকী দাঁড়িয়ে থাকেন সোসো। তবুও মৃত্যু তাঁকে ছুঁতে পারে না।
সেই সোসো, যে মাত্র ১৬ বছর বয়সে ‘সোসেল’ ছদ্মনামে ‘ইবেরিয়া’তে তাঁর স্বপ্নের কথা লিখেছিলেন।
শ্রমজীবী মানুষের জীবনসংগ্রামে জয়ের নিশ্চয়তায় তিনি লিখেছিলেন –
অন্তহীন মেহনতে বেঁকে গেছে যাদের পিঠ
কাল পর্যন্ত যারা উদ্ধত ভ্রকুটির সামনে মাথা নত করেছে
তারা জেগে উঠবেই, আমরা জানি
পর্বত সরে যাবে মাথা নিচু করে
আশার ডানায় ভর করে তারা উঠবে সবার উপরে।।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন