Russia: লেনিনকে ভোলেনি জন্মস্থান, ব্যাপক কারচুপির পরেও নির্বাচনে আসন বাড়লো কমিউনিস্ট পার্টির

‘আমি আশা রাখি আমার জীবদ্দশায় নতুন রুশ সমাজতন্ত্রের নির্মাণ আমি দেখে যাব’, সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন বছর চল্লিশের এই কমিউনিস্ট নেতা, ‘বাম দিকে মোড় অবধারিত’।
ফাইল ছবি
ফাইল ছবিছবি সংগৃহীত
Published on

উলিয়ানভস্ক, রাশিয়া। এই শহরেই আজ থেকে দেড়শো বছর আগে জন্ম নিয়েছিলেন ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ। এই নামের গালভরা শেষ অংশ অবশ্য তেমন কেউ ব্যবহার করতেন না। বন্ধুরা তাঁকে ডাকতেন শুধু ইলিচ বলে আর বিশ্ব তাঁকে চিনেছে তাঁর সুবিখ্যাত ছদ্মনাম দিয়েই। তাঁর জন্মস্থানের শহরেই শুধু নামটা বেঁচে আছে। তাঁর জন্মের পর কেটে গেছে পৃথিবী কাঁপানো দেড় শতক। এই শহরের শ্রেষ্ঠ সন্তানের হাতে জন্ম নিয়েছে, পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। আবার সেই রাষ্ট্রের পতনও হয়েছে। তারপরেও লেনিনকে তাঁর জন্মস্থান ভোলেনি।

সোভিয়েত রাষ্ট্রের পতনের পরেও উলিয়ানভস্ক লাল দুর্গ হিসেবে পরিচিত। এখনও এই শহর মুষ্টিমেয় এমন কিছু স্বল্প শহরাঞ্চলের অন্তর্গত যেখানে ভ্লাদিমির পুতিনের ‘ইউনাইটেড রাশিয়া’-র প্রবল শক্তি ও প্রভাব খাটিয়েও জনসমর্থনে বা সংগঠনে ‘কমিউনিস্ট পার্টি অফ রাশিয়ান ফেডারেশন’-কে টপকাতে পারেনি। ২০২১-এ রশিয়ার নির্বাচনের প্রাক্কালে একটি কফির দোকানের পাশে অবস্থিত ছোট পার্টি অফিসে বসে ‘মস্কো টাইমস’-কে সাক্ষাৎকারে এই কথাগুলিই খুব গর্ব করে বলেছিলেন স্থানীয় পার্টি নেতা আইরাত গিবাতদিনোভ। তাঁর কন্ঠে ছিল আত্মবিশ্বাস। ‘আমি আশা রাখি আমার জীবদ্দশায় নতুন রুশ সমাজতন্ত্রের নির্মাণ আমি দেখে যাব’, সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন বছর চল্লিশের এই কমিউনিস্ট নেতা, ‘বাম দিকে মোড় অবধারিত’। আসন্ন রুশ ডুমা নির্বাচনে তার শ্রেষ্ঠ সন্তানের পার্টিকে উলিয়ানভস্ক এবারেও ফেরাবে না, এই বিষয়ে তিনি একেবারেই নিশ্চিত ছিলেন।

গত ২০ তারিখ, রাশিয়ার নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশিত হলে দেখা গেল উলিয়ানভস্ক সত্যিই এবারও উলিয়ানভের দলকে ফেরায়নি। দুটি আসনের দুটিই রুশ কমিউনিস্ট পার্টি জিতেছে। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে রাশিয়ার নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টির ফলাফল একেবারেই আশানরূপ হয়নি। আপাতদৃষ্টিতে ভোটের ফলাফল দেখলে মনে হতে পারে, কমিউনিস্ট পার্টি তার শক্তি বাড়িয়েছে। ২০১৬ সালে কমিউনিস্ট পার্টি লাভ করেছিল ১৩.৩৪% ভোট ও ৪২টি আসন। এবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ১৮.৯৩% ভোট ও ৫৭টি আসন। কিন্তু বাস্তব হল, ভোট গণনা যখন প্রথম দিকে শুরু হয়েছিল তখন একদা কমিউনিস্ট পার্টি প্রায় ২৫% ভোট লাভ করেছে এমন পরিস্থিতিও দেখা গিয়েছিল। এক্সিট পোল ও নানা সমীক্ষাতেও কমিউনিট পার্টির ভোট শতাংশ কোনভাবেই ২০%-এর নিচে নামেনি। তাহলে এইরকম ফলাফল হল কেন?

রুশ সুদুর পূর্ব ও পূর্ব সীমান্ত অঞ্চলে এখনও কমিউনিস্টদের প্রভাব অটুট আছে স্থানীয় রাজনৈতিক স্তরে। একই কথা প্রযোজ্য মধ্য রাশিয়ার উরাল এবং ভোল্গা অববাহিকা অঞ্চলে। এখানে কমিউনিস্ট পার্টি ভ্লাদিমির পুতিনের ইউনাইটেড রাশিয়াকে শুধু টক্কর দেয়নি, অনেক ক্ষেত্রেই পরাজিতও করেছে বিপুল ব্যবধানে। কিন্তু পশ্চিম রাশিয়া ও ককেশাসের ভোট একেবারেই কমিউনিস্ট পার্টির বিপক্ষে গেছে। এর একটা কারণ যদি স্থানীয় সংগঠনে ও আন্দোলনে দুর্বলতা হয়, অপরটি অবশ্যই ভোটিং কারচুপি। সমগ্র ভোট প্রক্রিয়ায় প্রায় পাঁচ হাজারের কাছে কারচুপির অভিযোগ এসেছে।

খোদ রাজধানী মস্কো, যেখানে স্থানীয় নির্বাচনে কয়েকমাস আগেও কমিউনিস্ট পার্টি ইউনাইটেড রাশিয়াকে ভোট শতাংশের নিরিখে পেছনে ফেলে দিয়েছিল, সেখানে এমনকি বিরোধী রাজনীতির কেন্দ্রস্থলেও প্রথমদিকে বিপুল ভোটে এগিয়ে থেকেও কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থীরা পরাজিত হয়েছেন। এর কারণ কি? তিনটি কারণ মূলতঃ আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারি। প্রথম, ১৭ থেকে ১৯শে সেপ্টেম্বর এই তিনদিন ব্যাপী কোভিড পরিস্থিতিতে ভোট গ্রহণের সময় ভোটারদের ভয় এবং প্রলোভন দেখানো থেকে, ব্যালট স্টাফিং, ‘নিরপেক্ষ’ সরকারী কর্মীদের মাধ্যমে ভোটারদের প্রভাবিত করা সবরকম কৌশল নেওয়া হয়েছে।

কমিউনিস্ট পার্টির ভোট কাটার জন্য কমিউনিস্টস অফ রাশিয়া নামে একটি পার্টি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে ক্রেমলিন, তার প্রার্থীরা আবার কমিউনিস্ট পার্টি অফ রাশিয়ান ফেডারেশনের দাঁড় করানো প্রার্থীদের নামের সঙ্গে মিল রেখে প্রার্থী দিয়েছে নিজেদের – ভিতালি প্রেত্রভের কেন্দ্রে দাঁড়িয়েছেন ভাসিলি পেত্রভ, নিকোলাই ভলকোভের কেন্দ্রে অ্যালেক্সেই ভলকোভ, আনাস্তাশিয়া উদলাৎসোভার কেন্দ্রে আনা উদালোভা। যতরকম ভাবে সম্ভব নেতিবাচক প্রচার করানো হয়েছে কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে, ভিক্টর মোখভ নামক কুখ্যাত ধর্ষক ও অপহরণকারীর মুখ দিয়ে বলানো হয়েছে জেলখানা থেকে – ‘কমিউনিস্ট পার্টিকে ভোট দিন।’

এরপরেও যখন ভোট গণনা চলছিল মস্কোর অধিকাংশ আসনেই কমিউনিস্টরা ভালো ব্যবধানে এগিয়ে ছিলেন। গোলযোগ বাধল ই-ভোট গণনা করার সময়। এই বছর কোভিড পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে বাড়ি থেকেই অনলাইনে ভোটাররা যাতে ভোটদান করতে পারে, সেই উদ্দেশ্যেই ই-ভোটের বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। এই ভোট গণনার সময়েই মূল বিপত্তির সূচনা হয়েছে।

প্রাথমিক ভাবে কমিউনিস্টরা তাঁদের প্রতিপক্ষের সঙ্গে যে ব্যবধান তৈরি করেছিলেন, এই ভোট গণনার সঙ্গে সঙ্গেই তা ক্রমশঃ উবে যায়। এমন অনেক আসনে পশ্চিম রাশিয়ায় এবার কমিউনিস্টদের এই ই-ভোটের দৌলতে পরাজয় হয়েছে, যেখানে তাঁদের পরাজিত হওয়া কার্যত অসম্ভব। স্বভাবতই পরাজিত প্রার্থীরা এই ফলাফল মেনে নেননি। মস্কোর রাস্তায় তাঁরা ক্রেমলিনের ভ্রুকুটি অগ্রাহ্য করেই প্রতিবাদ মিছিলে সামিল হয়েছেন, ডাক দিয়েছেন পুতিন রাজকে উৎখাত করার। বর্তমানে বহু স্থানেই কমিউনিস্ট পার্টি ইউনাইটেড রাশিয়ার সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি ত্যাগ করে সংঘর্ষের পথে যেতে আগ্রহী। আগ্রহী পার্টির বাইরেও বিভিন্ন পুতিন বিরোধী শক্তিকে একত্রিত করতে।

এই ঘটনাক্রম অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এর কারণ হল, পার্টির সাধারণ সম্পাদক গেন্নাদি জুগানভ সহ কমিউনিস্ট নেতৃত্বের একটি বড়ো অংশ ক্রেমলিনের কর্তাদের ক্ষমতাকে সত্যি সত্যি চ্যালেঞ্জ জানাতে আগ্রহী নন তা তাঁরা বারংবার প্রমাণ করেছেন। বরং তাঁরা ক্রেমলিনের বাধ্য প্রতিপক্ষের ভূমিকায় অভিনয় করে আখের গোছাতেই অধিক আগ্রহী। ২০১১-এর ব্যপক গণআন্দোলনে ভর করে কমিউনিস্ট পার্টির সাফল্য ২০১৬ সালে পার্টি যে ধরে রাখতে পারেনি, এটিই তার মূল কারণ।

কিন্তু এই অবস্থার বর্তমানে দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। কমিউনিস্ট পার্টির স্থানীয় নেতৃত্বে ও এলাকাভিত্তিক আন্দোলনের মাথায় একদল তরুণ নেতৃত্ব বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। দীর্ঘ দেড় দশকের আপোষহীন সংগ্রামে গড়ে ওঠা এই নেতৃত্ব মূলতঃ কমিউনিস্ট পার্টি অফ রাশিয়ান ফেডারেশনের অন্দরে জুগানভের আপোষনীতির চুড়ান্ত বিরোধী অংশটিকেই শক্তিশালী করেছে। এঁদের উপেক্ষা করা আর জুগানভদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। ক্রেমলিন নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনী রাজনীতি এই নতুন প্রজন্ম মেনে নিতে নারাজ। তাঁরা মার্কসবাদী-লেনিনবাদী আদর্শের হাতেকলমে প্রয়োগ চান। তাই এই নির্বাচনে ফলাফল আশানরূপ না হলেও রাশিয়ার কমিউনিস্টদের মধ্যে সোভিয়েতের পতনের পর এমন এক লড়াকু আগুন এবং আত্মবিশ্বাস দেখা গেছে, যা পূর্বে অনুপস্থিত ছিল।

‘বাম দিকে মোড় অবধারিত’ বলেছিলেন গিবাতদিনোভ। পুতিনের ‘ইউনাইটেড রাশিয়া’-এর ২০২১-এর রুশ নির্বাচনে প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ ভোট লাভ করে চূড়ান্ত বিজয় সত্ত্বেও, তাঁর এই কথার সারবত্তা এমনকি ক্রেমলিনের কর্তারাও অস্বীকার করতে পারছেন না। এমন নয়, কমিউনিস্ট পার্টি আপোষের রাস্তা থেকে সরে এলেও তারা ভ্লাদিমির পুতিনের বজ্রমুষ্টি থেকে রাষ্ট্রক্ষমতা ছিনিয়ে নেওয়ার এখনও ক্ষমতা রাখে। কিন্তু কালক্রমে এই ক্ষমতা যে বিলক্ষণ তাঁদের হতে পারে, এ ক্রেমলিন জানে।

২০১৮ সালের প্রাইমোরিয়ার স্থানীয় প্রাদেশিক গভর্নর নির্বাচনে সূক্ষ এবং স্থূল নানা কৌশল গ্রহণ করে, পুরো রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহার করে, স্বয়ং প্রেসিডেন্ট পুতিনের হস্তক্ষেপের পরেও বছর সাঁইত্রিশের কমিউনিস্ট নেতা আন্দ্রেই ইশচেঙ্কোকে মাত্র ১% ভোটের ব্যবধানে পরাস্ত ‘ইউনাইটেড রাশিয়া’-এর হেভিওয়েট গভর্নর আন্দ্রেই তারাশেঙ্কো নিজের গদি বাঁচাতে সক্ষম হন। তাও প্রায় পুরো নির্বাচনে তিনি ৫% ভোটের ব্যবধানে পিছিয়ে ছিলেন, শেষমুহূর্তে ২০২১-এর ডুমা নির্বাচনের মতোই হঠাৎ করেই তাঁর পক্ষে কিভাবে যেন কিছু ভোটের জোগাড় হয়ে যায়।

এইপ্রকার বহু স্থানীয় নির্বাচন এবং সেখানে তরুণ কমিউনিস্ট নেতাদের কার্যকলাপ ক্রেমলিনকে বুঝিয়েছে জুগানভের সঙ্গে বোঝাপড়ার দিন শেষের পথে। অচিরেই তাঁদের মুখোমুখি হতে হবে এবং হতে হচ্ছে এমন একটি কমিউনিস্ট পার্টির যার লড়াইয়ে কোন খাদ নেই। ক্রেমলিন তার যথার্থ মোকাবিলা করতে পারবে কিনা, তার উপরেই নির্ভর করছে আইরাত গিবাতদিনোভের ভবিষ্যৎবাণী। অদূর ভবিষ্যতে রাশিয়ার রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে একটি মোড় যে অবধারিত, তা রাজনৈতিকভাবে বিপুল পাণ্ডিত্যের অধিকারী না হয়েও বলা যায়। কিন্তু সেই মোড় বাম মোড় হবে কিনা, তার উত্তর দেবে একমাত্র ভবিষ্যৎ।

স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in