গত ১৪-ই জুলাই ছিল বাস্তিল দিবস। ঐ দিনেই ফরাসী জনতা দখল নিয়েছিল ফরাসী স্বৈর শাসনের প্রতীক বাস্তিল দুর্গের। সূচনা হয়েছিল মানব ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা – ফরাসী বিপ্লবের। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয় না, কিন্তু তার একটা ছন্দ আছে। বাস্তিলের পতনের ঠিক ২৩৩ বছর পূর্ণ হওয়ার মাত্র পাঁচ দিন আগে, ৯-ই জুলাই শ্রীলঙ্কায় জনতা দখল নিল রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপাক্ষের প্রাসাদের।
খাতায় কলমে রাজা না হলেও রাজাপাক্ষে পরিবার বিগত প্রায় দেড় দশক শ্রীলংকার রাজনীতিতে যে সুগভীর প্রভাব রেখেছে তা ফরাসি আঁশিয়া রেজিমের বুর্বোঁ রাজাদের থেকে কোনো অংশে কম নয়। সেইদিক দিয়ে বিচার করলে গোতাবায়ার দেশত্যাগ ও গত ১৩-ই জুলাই সিঙ্গাপুর থেকে পদত্যাগের কথা ঘোষণা শ্রীলঙ্কার এই গণ অভ্যুত্থানকে আলাদা মাত্রা প্রদান করে।
রাজাপাক্ষে উৎখাতে যে নজির সৃষ্টি হলো, তাতে এই উপমহাদেশের শাসকরা স্বাভাবিক ভাবেই খুশি নয়। আমাদের দেশের শাসক প্রভাবিত সংবাদমাধ্যমে চোখ রাখলে মনে হবে শ্রীলঙ্কার বর্তমান সংকটের জন্য তার শাসকদের নব্য উদারনৈতিক অর্থনৈতিক নীতি বা সংখ্যাগুরুবাদ কোনোটাই যেন দায়ী নয় – চৈনিক ঋণ আর জনমোহিনী ভর্তুকির নীতি যেন দায়ী। এই যে দুটি কারণ বারবার ভারতের পেটোয়া সংবাদমাধ্যম তুলে ধরছে, তা একেবারেই অসত্য।
আমাদের দেশের শাসক প্রভাবিত সংবাদমাধ্যমে চোখ রাখলে মনে হবে শ্রীলঙ্কার বর্তমান সংকটের জন্য তার শাসকদের নব্য উদারনৈতিক অর্থনৈতিক নীতি বা সংখ্যাগুরুবাদ কোনোটাই যেন দায়ী নয় – চৈনিক ঋণ আর জনমোহিনী ভর্তুকির নীতি যেন দায়ী।
একথা বুঝতে কোনো বিকল্প সংবাদমাধ্যমে কান না পাতলেও চলবে, পশ্চিমের সংবাদমাধ্যমগুলি, যাদের মধ্যে অনেকগুলি যথেষ্ট পক্ষপাতমূলক ভাবে খবর প্রচার করলেও এখনও লজ্জার মাথা খেয়ে একেবারে কাঁচা মিথ্যা বলতে রাজি নয়, তাদের শ্রীলঙ্কা সমস্যা নিয়ে রিপোর্টিং অনুসরণ করলেও বোঝা যাবে। সংখ্যাগুরুবাদ কিভাবে শ্রীলঙ্কার সমস্যার কারণ, তা নিয়ে বামপন্থী পত্রপত্রিকায় কিছু আলোচনা হয়েছে, কিন্তু অর্থনীতির দিকটি নিয়ে আমার জ্ঞানত হয়নি। এই প্রবন্ধে শ্রীলংকা সমস্যার অর্থনৈতিক কারণ তাই তুলে ধরার চেষ্টা করা হল সংক্ষেপে। আশা করা যায়, এতে যে ধোঁয়াশা মূল ধারার ভারতীয় সংবাদমাধ্যম তৈরি করেছে, তা কিছুটা হলেও কাটবে।
শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট বুঝতে গেলে প্রথমে বুঝতে হবে তার বাণিজ্য ঘাটতিকে। বর্তমান যুগে কোনো দেশই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। আলপিন থেকে উড়োজাহাজ সবই এক দেশে উৎপাদন করা সম্ভব নয়। এই কারণে সব দেশই বিশ্ব বাণিজ্যের মাধ্যমে নিজের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি আমদানি ও নিজের দেশের উদ্বৃত্ত পণ্য রপ্তানি করে। এই আমদানি ও রপ্তানি উভয়েই হয় বিদেশী শক্তিশালী মুদ্রা, সাধারণতঃ মার্কিন ডলারের মাধ্যমে। এই কারণে প্রত্যেক দেশই বিদেশী মুদ্রার, বিশেষ করে ডলারের একটি ভান্ডার সবসময় মজুত রাখে। যে সব দেশের এই বাণিজ্য ভারসাম্য ইতিবাচক থাকে তারা আমদানিতে যত বিদেশী মুদ্রা ব্যয় করে, রপ্তানিতে তার থেকে বেশি বিদেশী মুদ্রা আয় করে।
অন্যদিকে যেসব দেশের বাণিজ্য ভারসাম্য নেতিবাচক থাকে তাদের আমদানিতে ব্যয় করা বিদেশী মুদ্রার তুলনায় রপ্তানিতে আয় করা বিদেশী মুদ্রার পরিমাণ কম হয়। অর্থাৎ এই দেশগুলি বাণিজ্য ঘাটতিতে চলে। সাধারণ বুদ্ধি বলে যেসব দেশ বাণিজ্য ঘাটতিতে চলছে একটা সময়ের পর তাদের বিদেশী মুদ্রার ভান্ডার নিঃশেষ হয়ে যাবে। কিন্তু তা হয় না। কারণ বাণিজ্য ছাড়াও বিদেশী মুদ্রা আয়ের অনেকগুলি উৎস থাকে, বিভিন্ন দেশের যা দিয়ে বাণিজ্যে যে বিদেশী মুদ্রার ঘাটতি হয় তা মিটিয়ে নেয়। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স এমনকি আমাদের ভারতেও বাণিজ্য ভারসাম্য ঘাটতিতে চলছে। কিন্তু এই সবকটি দেশের বিদেশী মুদ্রার ভান্ডার নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে না কারণ সেই মুদ্রা আয়ের এই সবকটি দেশেরই অন্য উপায় আছে। তাই শ্রীলঙ্কার মূল সমস্যা বর্তমানে এই নয় তাদের বাণিজ্য ঘাটতি আছে, মূল সমস্যা সেই ঘাটতি পূরণের জন্য তারা যে রাস্তা নিত, সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনা সেই রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে।
যেসব দেশ বাণিজ্য ঘাটতিতে চলছে একটা সময়ের পর তাদের বিদেশী মুদ্রার ভান্ডার নিঃশেষ হয়ে যাবে। কিন্তু তা হয় না। কারণ বাণিজ্য ছাড়াও বিদেশী মুদ্রা আয়ের অনেকগুলি উৎস থাকে, বিভিন্ন দেশের যা দিয়ে বাণিজ্যে যে বিদেশী মুদ্রার ঘাটতি হয় তা মিটিয়ে নেয়। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স এমনকি আমাদের ভারতেও বাণিজ্য ভারসাম্য ঘাটতিতে চলছে।
শ্রীলঙ্কার মূল বিদেশী মুদ্রা আয়ের উৎস তিনটি – পর্যটন, প্রবাসী নাগরিকদের রেমিটেন্স ও চা। এর মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ উৎস হলো অবশ্যই পর্যটন। এই পর্যটন প্রথম ধাক্কা খায় ২০১৯ সালের ২১ শে এপ্রিল, যখন নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে একটি মসজিদে খ্রীশ্চান সন্ত্রাসবাদী হামলার বদলা নিতে শ্রীলঙ্কায় ইস্টারের দিন ইসলামিক সন্ত্রাসবাদীরা হামলা চালায়। এতে ২৬৯ জনের মৃত্যু হয়, যার মধ্যে ৪৫ জন বিদেশীও ছিলেন। তৎক্ষণাৎ শ্রীলঙ্কায় বিদেশী পর্যটকের আগমন একেবারে থমকে যায়। পর্যটন শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির ক্ষেত্রে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা শুধু এই তথ্য দিলেই পরিষ্কার হবে যে ২০১৯ সালে শ্রীলঙ্কার জিডিপির ২২%-ই এসেছে পর্যটন থেকে এবং দেশের প্রায় অর্ধেকের বেশি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে পর্যটন শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। তাও কিছুটা যা আশা করা গেছিল, যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, তাতে ইতি টেনে দেয় কোভিড-১৯ মহামারি। দুই বছর মহামারি শেষে আবার যখন আশায় বুক বাঁধছিল শ্রীলঙ্কা, তখনই শুরু হলো রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ। শ্রীলঙ্কায় রুশ পর্যটকরাই সবথেকে বেশি বেড়াতে আসেন, ইউক্রেনিয়ানদের সংখ্যাও নেহাত খুব কম নয়। এর ফলে ২০১৮ সালে যেখানে পর্যটন থেকে শ্রীলঙ্কার প্রায় ৪.৪ বিলিয়ন ডলার বিদেশী মুদ্রা আয় হয়েছিল, সেই আয়ের পরিমাণ ২০২১-এ দাঁড়িয়েছে ৫০৭ মিলিয়ন মাত্র।
রেমিটেন্স শ্রীলঙ্কার বিদেশী মুদ্রা আয়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। এখানে ক্রমবর্ধমান ঘাটতির কারণ হল শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি। সস্তায় ডলারের মাধ্যমে লেনদেন করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশ কিছু সময় ধরে ডলার থেকে শ্রীলঙ্কান রুপির এক্সচেঞ্জ রেট বাজার দরের থেকে অনেক বেশি কমিয়ে রেখেছিল।
রেমিটেন্স শ্রীলঙ্কার বিদেশী মুদ্রা আয়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। এখানে ক্রমবর্ধমান ঘাটতির কারণ হল শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি। সস্তায় ডলারের মাধ্যমে লেনদেন করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশ কিছু সময় ধরে ডলার থেকে শ্রীলঙ্কান রুপির এক্সচেঞ্জ রেট বাজার দরের থেকে অনেক বেশি কমিয়ে রেখেছিল। কিন্তু প্রবাসী লঙ্কানরা যখন দেখলেন খোলা বাজারে এই এক্সচেঞ্জ রেট অনেক বেশী, তখন তারা সরকারী ব্যাঙ্কে টাকা জমা দিতে রাজি হলেন না। ফলে দেখা গেল রেমিটেন্সে ঘাটতি। কতটা ঘাটতি? শুধু ২০২০ থেকে ২০২১-এই রেমিটেন্সের পরিমাণ কমেছে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার। সরকার সস্তায় ডলার পাওয়ার লোভে নিজেদের পায়েই কুড়ুল মেরে বসল। বিদেশী মুদ্রার ভান্ডার সংরক্ষণের বদলে আয়ের উৎসই গেল শুকিয়ে।
২০২০ থেকে ২০২১-এই রেমিটেন্সের পরিমাণ কমেছে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার। সরকার সস্তায় ডলার পাওয়ার লোভে নিজেদের পায়েই কুড়ুল মেরে বসল। বিদেশী মুদ্রার ভান্ডার সংরক্ষণের বদলে আয়ের উৎসই গেল শুকিয়ে।
এই দুই বিষয় মিলে শ্রীলঙ্কার বিদেশী মুদ্রার ভাঁড়ার এমনিতেই খুব খারাপ অবস্থায় ছিল। ২০২১ সালে রাজাপাক্ষে ঘোষণা করলেন শ্রীলঙ্কা রাসায়নিক সার আর আমদানি করবে না। সরকারী ভাষ্যে বলা হলো এই সিদ্ধান্তের উদ্দেশ্য শ্রীলঙ্কাকে একটি পরিবেশবান্ধব দেশ হিসেবে গড়ে তোলা, যেখানে শুধু প্রাকৃতিক সারের ভিত্তিতেই চাষবাস হবে। কিন্তু আসল কারণ ছিল রাসায়নিক সার আমদানিতে শ্রীলঙ্কাকে যে বিপুল পরিমাণ বিদেশী মুদ্রা ব্যয় করতে হত তাতে ইতি টানা। কিন্তু হিতে বিপরীত হলো। শ্রীলঙ্কা এর আগে মোটামুটি খাদ্যে স্বয়ম্ভর দেশ ছিল। রাসায়নিক সার আমদানি বন্ধ করার ফলে ফসলের উৎপাদন প্রবল ভাবে মার খেল – ধানের মতো খাদ্য শস্য থেকে চায়ের মতো অর্থকরী বাগিচা ফসল, কিছুই বাদ গেল না। মোট কৃষি উৎপাদন রাতারাতি প্রায় অর্ধেক হয়ে গেল। এর ফলে চা থেকে প্রাপ্ত বিদেশী মুদ্রা তো গেলই, চাহিদা মেটাতে বাইরে থেকে খাদ্য শস্য আমদানি করতে হল – ফলে বিদেশী মুদ্রার ব্যয় কমার বদলে বহুগুণ বেড়ে গেল।
শ্রীলঙ্কা এর আগে মোটামুটি খাদ্যে স্বয়ম্ভর দেশ ছিল। রাসায়নিক সার আমদানি বন্ধ করার ফলে ফসলের উৎপাদন প্রবল ভাবে মার খেল – ধানের মতো খাদ্য শস্য থেকে চায়ের মতো অর্থকরী বাগিচা ফসল, কিছুই বাদ গেল না। মোট কৃষি উৎপাদন রাতারাতি প্রায় অর্ধেক হয়ে গেল।
এই তিন সংকটের নিটফল হলো যেখানে ২০১৯ সালে শ্রীলঙ্কার বিদেশী মুদ্রার ভান্ডার ছিল ৭.৯ বিলিয়ন, ২০২১-এ তা কমে দাঁড়ালো মাত্র ১.৬ বিলিয়ন। এইকারণে বিদেশী মুদ্রা বাঁচাতে সরকারকে খাদ্য থেকে জ্বালানি সব কিছুতেই কাটছাঁট করতে হলো। এর উপর ব্যাঙ্কের কৃত্রিম কারেন্সি ম্যানিপুলেশনের লাগামও হাত থেকে বেরিয়ে গেল। দেখা দিল লাগাম ছাড়া দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, যা জুন মাসে প্রায় ৮০% স্পর্শ করেছে। ৯ থেকে ১৫ ঘন্টার বেশি দিনে বিদ্যুৎ দেওয়ার মতো জ্বালানিও রাষ্ট্রের এখন আমদানি করার ক্ষমতা নেই। বিদেশী মুদ্রার অভাবে কেনা যাচ্ছে না কাগজও। বাতিল করতে হয়েছে নবম, দশম ও একাদশ শ্রেণীর পরীক্ষা। এই পরিস্থিতিতে মে মাসের মাঝামাঝি শ্রীলঙ্কা প্রায় ৫১ বিলিয়ন ডলারের ঋণ খেলাপির কথা ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। সুতরাং সামগ্রিক ভাবে বাণিজ্য ঘাটতি পূরণ করার মতো বিদেশী অর্থনৈতিক মুদ্রার অভাব ও মুদ্রা ভান্ডারে টানই হলো শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকটের মূল কারণ।
মে মাসের মাঝামাঝি শ্রীলঙ্কা প্রায় ৫১ বিলিয়ন ডলারের ঋণ খেলাপির কথা ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। সুতরাং সামগ্রিক ভাবে বাণিজ্য ঘাটতি পূরণ করার মতো বিদেশী অর্থনৈতিক মুদ্রার অভাব ও মুদ্রা ভান্ডারে টানই হলো শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকটের মূল কারণ।
দুটি বিষয় এর পাশাপাশি আরও একটি বিষয় একটু খোলসা করা প্রয়োজন। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের চৈনিক ঋণ ও সামাজিক খাতে ব্যয় এই সংকটের জন্য দায়ী, এই দাবী কতটা সত্যি? প্রথমে সামাজিক ব্যয়ের বিষয়টিতে আসা যাক। শ্রীলঙ্কা একদা দক্ষিণ এশিয়ার সবথেকে উন্নত জনকল্যাণ ব্যবস্থা নির্মাণ করেছিল ১৯৬০ ও ৭০-এর দশকে। কিন্তু ৯০-এর দশকের পর থেকেই নয়া উদারবাদী অর্থনৈতিক ডগমা মেনে ধীরে কিন্তু স্থির ভাবে এই ব্যবস্থা ভেঙে ফেলা হয়। মাহিন্দ্রা ও গোতাবায়া, দুই রাজাপাক্ষে ভাইই এই প্রক্রিয়ার অত্যন্ত উৎসাহী সমর্থক ছিলেন। তাঁরা IMF-এর কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার শর্ত হিসেবেই সরকারী দায় দায়িত্ব সংকুচিত করেন, অর্থাৎ ভারতের মিডিয়া যেমন বলছে তার ঠিক উল্টো।
মাহিন্দ্রা ও গোতাবায়া, দুই রাজাপাক্ষে ভাইই এই প্রক্রিয়ার অত্যন্ত উৎসাহী সমর্থক ছিলেন। তাঁরা IMF-এর কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার শর্ত হিসেবেই সরকারী দায় দায়িত্ব সংকুচিত করেন, অর্থাৎ ভারতের মিডিয়া যেমন বলছে তার ঠিক উল্টো।
এর পাশাপাশি তাঁরা দেশের ধনকুবেরদের সুবিধার জন্য বিপুল পরিমাণ কর ছাড় দেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রণিল বিক্রমসিংহ এখন নিজেই বলছেন এতে প্রায় ২.২ বিলিয়ন ডলার ঘাটতি হয়েছে। এই কর হ্রাসের হার আরও ভালোভাবে বোঝা যায়, যখন আমরা দেখি ১৯৯০-৯২ সালে যেখানে ট্যাক্স টু জিডিপি রেশিও ছিল ১৮.৪% তা ২০২০ তে এসে দাঁড়িয়েছে ৮.৪%-তে। এই একই সময়ে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বরাদ্দ ক্রমাগত কমেছে। এগুলো মতামত নয়, তথ্য। সুতরাং ভারতীয় সংবাদমাধ্যম কোথা থেকে সামাজিক খাতে ব্যয়বরাদ্দ বৃদ্ধির তত্ত্ব আবিষ্কার করল, তা গবেষণার বিষয়।
শ্রীলঙ্কার মোট ঋণের মাত্র ১০% চিনের। বাকির ঋণের ১২% জাপানের, ১৪ শতাংশ জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রভাবিত এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের, ১০% বিশ্বব্যাঙ্কের ও বাকি ৫৪% বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থার কাছে। এই বেসরকারী ঋণের সিংহভাগ ঋণই মার্কিন ‘ব্ল্যাক রক’ ও ব্রিটিশ ‘অ্যাশমোর’ ফার্মের কাছে। এদের ঋণের টাকা মেটাতেই হাম্বানটোটা বন্দরের ৭০% মালিকানা শ্রীলঙ্কা চিনা কোম্পানির কাছে লিজ দেয়, চিনের ঋণের নয়।
পড়ে থাকে চৈনিক ঋণের বিষয়টি। শ্রীলঙ্কার মোট ঋণের মাত্র ১০% চিনের। বাকির ঋণের ১২% জাপানের, ১৪ শতাংশ জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রভাবিত এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের, ১০% বিশ্বব্যাঙ্কের ও বাকি ৫৪% বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থার কাছে। এই বেসরকারী ঋণের সিংহভাগ ঋণই মার্কিন ‘ব্ল্যাক রক’ ও ব্রিটিশ ‘অ্যাশমোর’ ফার্মের কাছে। এদের ঋণের টাকা মেটাতেই হাম্বানটোটা বন্দরের ৭০% মালিকানা শ্রীলঙ্কা চিনা কোম্পানির কাছে লিজ দেয়, চিনের ঋণের নয়।
এই তথ্যগুলি অতি সহজেই পাওয়া যায়। সমস্যা হল চিনের বিদেশনীতির সুচিন্তিত এবং বৈধ সমালোচনা করার জন্য যে সময়, অধ্যয়ন ও নৈতিক সততা প্রয়োজন তা ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের নেই। তাঁরা সস্তায় বাজিমাত করতে চান। সেই কারণে চৈনিক ঋণের জন্য শ্রীলঙ্কার এই অবস্থা – এমন সস্তা এবং সম্পূর্ণ মিথ্যা ভাষ্যের তাঁদের আশ্রয় নিতে হচ্ছে। তাঁরা এও জানেন এই বিষয়ে তাঁদের মিথ্যা ভাষণ যদি কেউ ধরিয়েও দেয়, খুব সহজেই ‘চিনের দালাল’ বা ওই ধরণের কিছু বলে তাঁদের দাগিয়ে দিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়া যাবে।
শ্রীলঙ্কার পতন একদিনে হয়নি। ২০০৯ সাল থেকেই দেশটি ধীরে কিন্তু স্থির ভাবে বর্তমান পতনের দিকে এগিয়ে চলেছিল। উগ্র জাতীয়তাবাদ, তার সংখ্যাগুরুবাদী রাজনীতিতে মানুষ মেতে থাকায় খেয়ালও করেনি।
শ্রীলঙ্কার পতন একদিনে হয়নি। ২০০৯ সাল থেকেই দেশটি ধীরে কিন্তু স্থির ভাবে বর্তমান পতনের দিকে এগিয়ে চলেছিল। উগ্র জাতীয়তাবাদ, তার সংখ্যাগুরুবাদী রাজনীতিতে মানুষ মেতে থাকায় খেয়ালও করেনি, বা করতে চায়নি নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতি কখন দেশের ভিত ফোঁপরা করে দিয়েছে। আজ ভারতের শাসকবর্গ তাদের পেটোয়া সংবাদমাধ্যম দিয়ে মিথ্যাভাষণ করে আসল কারণের বদলে শ্রীলঙ্কার পতনের জন্য সামাজিক নীতিতে অর্থব্যয় থেকে চিনের ঋণ সবদিকে আঙুল তুলে লাফাতে পারে, কিন্তু চিরদিন এমন থাকবে না। প্রত্যেকবার শাসক ও তার পেটোয়া গোষ্ঠী যখন মিথ্যাভাষণ করেন, মানুষকে বিভ্রান্ত করেন, তখন তাঁদেরও দেশের মানুষের কাছে একটি অদৃশ্য ঋণ হয়। এই ঋণ কিন্তু একদিন না একদিন তাঁদের মেটাতেই হবে, যেমন শ্রীলঙ্কায় হচ্ছে।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন