২৮-২৯ মার্চ দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট - লড়াইটা কিন্তু দেশপ্রেমিক

শিক্ষা, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বেসরকারিকরণের গতি অপ্রতিরোধ্য। স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সরকারের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হলে মানুষের জীবনে কী পরিণতি ডেকে আনতে পারে করোনা মহামারির সময়ে সে অভিজ্ঞতা দেশের মানুষের হয়েছে।
ছবি - প্রতীকী
ছবি - প্রতীকী
Published on

আবার একটা দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট। এবার আটচল্লিশ ঘণ্টার। ধর্মঘটের যে দাবিসনদ তার পুরোটাই রচিত হয়েছে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের অনুসৃত নীতির বিরোধিতা করে। যে নীতির মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে উদারীকরণকে বিস্তৃত করে আরও আরও আর্থিক সংস্কার। কেন্দ্রীয় নীতির বিরোধিতায় এই ধর্মঘট জনমানসে কতোটা ছায়া ফেলতে সক্ষম হবে তা সময়ই বলবে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের ফল বিজেপি'র অনুকূলে গেছে। সফল কৃষক আন্দোলন জাতীয় রাজনীতিতে বিজেপি-কে অনেকটা কোণঠাসা করতে পেরেছিল। বলা যায়, এই বিধানসভা নির্বাচনের ফল বিজেপি-কে অক্সিজেন দিলো। মুচড়ে-পড়া বিজেপি এখন আবার আগের মতো ফের উজ্জীবিত। নিশ্চিতভাবেই ধর্মঘটী সংগঠনগুলির কাছে এটা কোনো সুখবর নিয়ে আসবে না। কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলি এবং স্বাধীন সারা ভারত ফেডারেশনগুলির যৌথ মঞ্চ এই ধর্মঘট ডেকেছে। সংযুক্ত কৃষক মোর্চা এই ধর্মঘটকে সমর্থন করছে। স্বাভাবিকভাবেই সঙ্ঘ পরিবারের ট্রেড ইউনিয়ন ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ এই ধর্মঘটে থাকতে পারে না। তারা হয়তো ধর্মঘটের দুদিন ২৮-২৯ মার্চ সক্রিয় বিরোধিতার পথেই যাবে।

কিন্তু গত বছরের ৩ ডিসেম্বর যখন ধর্মঘটের দিন ঘোষণা করা হয় তখন কিন্তু পরিস্থিতি আন্দোলনকারীদের পক্ষে যথেষ্টই অনুকূল ছিল। এর কয়েকদিন আগেই টানা ৩৬৩ দিন রাস্তায় থেকে কৃষকরা জয় হাসিল করেছেন ; আদানি-আম্বানিদের সাধের তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছেন মোদি। আমরা সবাই জানি, ওই সফল কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল সংযুক্ত কৃষক মোর্চা । যাতে পাঁচশো-বেশি সংগঠন রয়েছে। কয়েকটা সাধারণ দাবি নিয়ে এতো বৃহৎ আন্দোলনের মঞ্চ মনে হয় স্বাধীন ভারতে এর আগে কোনোদিন গড়ে ওঠে নি। দাবি আদায় ছাড়াও এই আন্দোলনে আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক আছে।

দীর্ঘ আন্দোলনে পুরো সময়টাই কৃষকরা ট্রেড ইউনিয়নগুলিকে তাদের পাশে রাস্তায় পেয়েছে, বিশেষকরে সিআইটিইউ সহ বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়নগুলিকে। এই কৃষক আন্দোলনের সূচনাও হয়েছিল ২০২০ সালের ২৬ নভেম্বর কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির ডাকা এরকমই এক সাধারণ ধর্মঘটের দিন। ওইদিনই পাঞ্জাব, হরিয়ানা থেকে কৃষকরা তিন কৃষি আইন বাতিলের দাবি নিয়ে দিল্লির অভিমুখে হাঁটা শুরু করেন। বামপন্থী শ্রমিক, কৃষক এবং খেতমজুর সংগঠনগুলির রাজনৈতিক কৌশলই হচ্ছে এই তিন উৎপাদক শ্রেণিকে ঐক্যবদ্ধ করা ; যাতে তাঁদের রাজনৈতিক পরিভাষা অনুযায়ী শাসকশ্রেণিকে জোরদার আঘাত হানা যায়। মূলত সিআইটিইউ, সারা ভারত কৃষক সভা এবং সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়ন দাবি আদায়ের সাথেই এই লক্ষ্য নিয়ে কৃষক আন্দোলনে অংশ নিয়েছে। এবং রাস্তার লড়াইতে এই তিন উৎপাদক শ্রেণিকে ঐক্যবদ্ধ করতে তারা অনেকাংশে সফল হয়েছে। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই ধর্মঘটে এটা কতোটা কার্যকরী হবে তা আমরা দেখতে পাবো। কিন্তু, বিজেপি সরকারের নীতির বিরুদ্ধে কিংবা আর্থিক সংস্কারের বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদি লড়াইয়ে এটা অবশ্যই আগামীদিনে তাদের ডিভিডেন্ড দেবে।

ভারতের অর্থনীতির উদারনীতির পথে যাত্রা শুরু গত শতকের নব্বইয়ের দশকে, যখন পি ভি নরসিমা রাও সরকারের অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিং ১৯৯১ সালের জুলাই মাসে লোকসভায় বাজেট পেশ করলেন। কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর বামপন্থী দলগুলির নিয়ন্ত্রণের কারণে কোনো কোনো সময়ে সংস্কারের গতি হয়তো মন্থর হয়েছে। কিন্তু পরবর্তী প্রতিটি কেন্দ্রীয় সরকারই এই নীতিকে আশ্রয় করেই এগিয়েছে। এই নীতি অতি আগ্রাসী রূপ ধারণ করেছে বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারগুলির সময়ে । বস্তুত, মনমোহন সিং যখন ওই বাজেট পেশ করেছিলেন তখন বিজেপি'র পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, কংগ্রেস তাদের মস্তিষ্কপ্রসূত ভাবনাকেই হাইজ্যাক করেছে। সেই মস্তিষ্কপ্রসূত ভাবনাটির প্রকৃত রূপ ঠিক কীরকম ছিল, বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় আসার পর তা দেশবাসীর বোধগম্য হচ্ছে।

উদারনীতির প্রায়োগিক ক্ষেত্রে অন্যতম কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো — অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমস্ত কিছু নির্ধারণের ক্ষমতা বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া, রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদের বিলগ্নিকরণ-বেসরকারিকরণ, আমদানির ওপর ধীরে ধীরে সব নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং ভরতুকি ব্যবস্থার সম্পূণ অবসান। এই নীতিগুলির বিরোধিতা করেই ধর্মঘটের বারো দফা দাবি সংবলিত দাবিসনদ তৈরি হয়েছে। দেশে উদারনীতির জমানা শুরু হওয়ার পর এখনো পর্যন্ত যে কুড়িটি সাধারণ ধর্মঘট হয়েছে তার প্রতিটি দাবিসনদের মর্মবস্তু ছিল উদারনীতির সর্বাত্মক বিরোধিতা।

একটু বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণে যদি সক্ষম হই তা'হলে দেখা যাবে গত তিন দশক ধরে দেশে উদারনীতি আমাদের জন্য কোনো সুদিন নিয়ে আসে নি। একটা ক্ষুদ্র মুষ্টিমেয়র উজ্জ্বল ভারত গড়ে উঠেছে পীড়িত ভারতের পরিধিটাকে ক্রমশ বড়ো করে। রাষ্টায়ত্ত সম্পদের সর্বক্ষেত্রে বিলগ্নিকরণ বেসরকারিকরণ কেন্দ্রীয় সরকারগুলির মুখ্য নীতিতে পরিণত হয়েছে। সরকারগুলির যা পরিকল্পনা ছিল তাতে তিন দশকে ভারতে একটাও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা অবশিষ্ট থাকত না। এটা সত্য যে, এই সময়কালে ৭০-রও বেশি সংস্থার বিলগ্নিকরণ হয়েছে। হিন্দুস্থান জিঙ্ক, এয়ারপোর্ট হোটেল, আইটিডিসি'র হোটেল, হোটেল করপোরেশন অব ইন্ডিয়া, এইচটিএল, মর্ডান ফুড, মারুতি, বলকো, এয়ারইন্ডিয়ার মতো বারোটি সংস্থার বেসরকারিকরণ হয়ে গেছে। অর্থাৎ এই সংস্থাগুলি এখন দেশি-বিদেশি বেসরকারি মালিকদের হাতে। আইপিসিএল, আইবিপি, আইডিবিআই'র মালিকানা প্রত্যক্ষভাবে রাষ্ট্রের হাতে না থাকলেও, সংস্থাগুলিকে অন্য রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা কিনে নিয়েছে। এতদসত্ত্বেও এখনো ২৫৫ টি সংস্থার মালিকানা রাষ্ট্রের হাতে রয়েছে। যারা সম্মিলিতভাবে বছরের পর লাভ করে চলেছে। ডিভিডেন্ড, অন্যান্য কর বাবদ প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিচ্ছে। কয়েকটা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কিছু অংশ শেয়ারের বিলগ্নিকরণ হয়েছে। ২৭ টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ককে সংযুক্ত করে ১২টি করা হয়েছে। কিন্তু তাদের রাষ্ট্রীয় চরিত্র অবলুপ্ত হয়নি । জিআইসি ও চারটি সাধারণ বিমা কোম্পানি এবং এলআইসি'র বিলগ্নিকরণের লক্ষ্যে বিজেপি সরকার আইন সংশোধন করেছে। ঘোষণা হয়েছে এলআইসি’র পাঁচ শতাংশ শেয়ার বিলগ্নিকরণের। এসব কোনোটাই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক, বিমা শিল্পের জন্য সুখবর নয়। বলা যায় অশনিসংকেতই। তবুও এদের রাষ্ট্রায়ত্ত চরিত্র এখনো অটুট।

ভারতের অর্থনীতিতে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক-বিমা শিল্পের এখনো এই শক্তিশালী অবস্থান কোনো কেন্দ্রীয় সরকারের দয়া দাক্ষিণ্যের ফল যে নয় তা আমরা সবাই বুঝতে পারি। উদার অর্থনীতির প্রয়োগের প্রথমদিন থেকেই বিলগ্নিকরণ- বেসরকারিকরণের নীতির বিরোধিতা করে আসছে কমিউনিস্ট পার্টি, বামপন্থী দলগুলি এবং অবশ্যই বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়নগুলি। পরে অন্যান্য ট্রেড ইউনিয়ন যুক্ত হয়েছে। সংসদের ভিতরে লড়াই, সংসদের বাইরে তাদের ধারাবাহিক ধর্মঘট-আন্দোলন চীনের প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছে বিলগ্নিকরণ-বেসরকারিকরণ নীতি রূপায়ণের সামনে। শুধু ব্যাঙ্ক কর্মচারীরাই ব্যাঙ্ক শিল্পের বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে ৪০টিরও বেশি ধর্মঘট করেছে। অসংখ্যবার ধর্মঘট করেছেন বিমা কর্মচারীরা। বর্তমান বিজেপি সরকারও ৪৫টি-র মতো রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে সম্পূর্ণ বিক্রির তালিকায় রেখেছিল। এয়ার ইন্ডিয়া ছাড়া তারা কোনোটায় সফল হয়নি । প্রতিরক্ষা শিল্প, ওডিশার নালকো, তামিলনাডুর নেভেলি লিগনাইট, সালেম স্টিল প্ল্যান্ট, কর্ণাটকের বিইএমএল, পশ্চিমবঙ্গের অ্যালয় স্টিল প্ল্যান্ট, উত্তরপ্রদেশের সেন্ট্রাল ইলেকট্রনিকস লিমিটেড, অন্ধপ্রদেশের ভাইজ্যাগ স্টিল প্ল্যান্টের বেসরকারিকরণের বিজেপি সরকারের প্রচেষ্টাকে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করে রুখে দিয়েছে সংস্থার শ্রমিকরা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শ্রমিকদের রাষ্ট্রের সম্পদ বাঁচানোর এই লড়াইতে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের জনগণও শামিল হয়েছিলেন। সম্প্রতি বিজেপি সরকার রেল, জাতীয় সড়ক, বন্দর, বিমানবন্দর, টেলিকম টাওয়ার, স্টেডিয়ামের মতো পরিকাঠামো এবং মাটির তলার সম্পদ সব করপোরেটদের কাছে বিক্রি করে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে।

এই লেখার শুরুতে কৃষক আন্দোলনের কথা বলা হয়েছে। উদার আমদানি নীতি, কৃষিতে ব্যাঙ্কের ঋণ হ্রাসের নীতি, বিদ্যৎ-কৃষি উপকরণে ভরতুকি প্রত্যাহার, জমি হাঙরদের রাষ্ট্রের প্রশ্রয় দেশের কৃষি অর্থনীতিতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ফসলের দাম না পেয়ে ঋণে জর্জরিত কৃষকদের আত্মহত্যা মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে প্রতিদিন। অন্যদিকে কৃষিপণ্যে আগাম বাণিজ্য, অবাধ ফাটকাবাজিতে খাদ্যের দাম রকেট গতিতে বেড়েছে। এর পরিণতিতে দেশে অনাহার ক্ষুধা যে বর্ধমান তার জ্বলন্ত প্রমাণ বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারতের ক্রমঅবনমন। এর বিনিময়ে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে আদানি-আম্বানিরা। এই পরিস্থিতিতে গত দুতিন বছরে জমি বিল এবং কৃষি আইনের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন কিছুটা হলেও কৃষকদের বাঁচার রসদ জুগিয়েছে। আদানি-আম্বানি এবং ধনী দেশগুলির স্বার্থের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন ছিল। কৃষক, খেতমজুররা যদি না বাঁচে তা'হলে দেশকে খাওয়াবে কে? এই আন্দোলন ভারতকে আবার খাদ্যের ব্যাপারে আমেরিকা সহ ধনী দেশগুলির মখাপেক্ষী হওয়া থেকে রক্ষা করেছে।

শিক্ষা, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বেসরকারিকরণের গতি অপ্রতিরোধ্য। স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সরকারের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হলে দেশের মানুষের জীবনে কী পরিণতি ডেকে আনতে পারে করোনা মহামারির সময়ে সে অভিজ্ঞতা দেশের মানুষের হয়েছে। আজ সারা দেশেই বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং, ম্যানেজমেন্ট, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছড়াছড়ি। কেন্দ্রীয় সরকারের নয়া শিক্ষানীতি এই প্রক্রিয়াকে আরও দুর্বার করার লক্ষ্যেই। এই প্রক্রিয়া একবার যদি ছাড়পত্র পায় তাহলে পাবলিক এডুকেশন সিস্টেমের দফারফা হয়ে যাবে। উদারনীতির কোনো রাখঢাক না রেখে জনশিক্ষা, জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার অবসানের কথাই বলে। বিজেপি সরকার সমস্ত চালু শ্রমআইনকে লঘু করে একসঙ্গে চারটি শ্রমকোডে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এর ফলে ন্যূনতম মজুরি, দৈনিক শ্রমঘণ্টা, শ্রমস্থলে নিরাপত্তা, পেনশন, পিএফ, গ্র্যাচুইটির মতো অধিকারগুলি থেকে শ্রমিকদের বঞ্চিত করা যাবে। আইএমএফ-বিশ্বব্যাঙ্কের শ্রমআইন লঘু করার এই প্রেসক্রিপশন বহুদিনের। বিজেপি সরকার এর রূপায়ণ করতে সফল হলো। এই শ্রমঅধিকারগুলি থেকে বঞ্চিত হওয়ার অর্থই হলো শ্রমিক শোষণ বৃদ্ধি। মুনাফা বৃদ্ধি মালিকের। শ্রমিক-কর্মচারীদের মজুরি বৃদ্ধি হলে তাঁদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে, সম্প্রসারিত হয় বাজার। নতুন কলকারখানা তৈরির জমি প্রস্তুত হয়। আর নতুন শিল্প মানেই নতুন কর্মসংস্থান।

শিক্ষা,স্বাস্থ্য, শিল্প,কৃষি, শ্রম সহ সর্বক্ষেত্রে বিজেপি সরকারের গৃহীত নীতি উদারনীতির চাকাকে গড়গড়িয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দাবিসনদের মধ্যদিয়ে এর বিরুদ্ধে একটা বিকল্পের কথা বলার চেষ্টা করছে এই সাধারণ ধর্মঘট। এটা কম ব্যাপার নয়। ট্রেড ইউনিয়নগুলির ধর্মঘট-আন্দোলন যতটুকু সাফল্য হবে বেসরকারিকরণ-বিলগ্নিকরণের প্রক্রিয়া ততটাই পিছু হটবে। অটুট থাকবে দেশের সম্পদ। ধর্মঘট-আন্দোলনের মধ্যদিয়ে ওপরের বিষয়গুলির যদি সামান্যও নিষ্পত্তি ঘটে তাহলে কিছুটা গতি পাবে দেশের শিল্প-কৃষি-পরিষেবা। মুখ থুবড়ে-পড়া অর্থনীতি কিছুটা হলেও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে। আখেরে লাভ হবে আমজনতারই।

রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা, ব্যাঙ্ক, বিমায় ধর্মঘট সর্বাত্মক হবে বলেই মনে হয়। কেন না সেখানে উদারনীতির আক্রমণটা সরাসরি, আর ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনও শক্তিশালী। কৃষকদের ধর্মঘটে অংশগ্রহণ কেমন হয় সেটা অবশ্যই দেখার। সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে কৃষকদের ভূমিকা হতাশই করেছে। বিজেপি'র তীব্র সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাজনীতিতে রাজনৈতিক দাবি আন্দোলন সব ভেসে গেছে। এখনো কৃষক আন্দোলনের বিদ্যুৎ বিল বাতিল এবং ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের আইনি সুনিশ্চিতিকরণের দাবি মোদি সরকার মেনে নেয় নি। ধর্মঘটের দিনকৃষকরা আন্দোলনের পুরনো মেজাজকে ধরে রাখতে পারে কীনা সেটাই দেখার। সম্প্রতি বিধানসভা নির্বাচনের ফলে বলিয়ান হয়ে বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলির প্রশাসন ধর্মঘট ব্যর্থ করতে দমনপীড়নের পথে যাবে। পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকারের বহু পদক্ষেপই মোদি সরকারের মতো অতো আগ্রাসী না হলেও তার নীতিরই অনুসারী। আবার দুর্নীতি, আইনশৃঙ্খলার নৈরাজ্যকর অবস্থায় বর্তমানে যথেষ্ট চাপে রয়েছে এই সরকার। এরাজ্যেধর্মঘট সফল হলে এ চাপ আরও বাড়বে। তা হলে আগামীদিনে বাম দলগুলির আন্দোলন সরকারকে দিশেহারা করে দিতে পারে। মমতা ব্যানার্জি সেটা কখনোই চাইবে না। এমনিতেই মমতা সরকারের ঘোষিত অবস্থান হলো ধর্মঘটের বিরুদ্ধে। তৃণমূলের ট্রেড ইউনিয়নও এই ধর্মঘটে নেই। তাই স্বাভাবিকভাবে ধর্মঘটকে ভাঙতে তৃণমূল সরকার পুলিশ প্রশাসনকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করবে। বাম, কংগ্রেস এবং বিজেপি-বিরোধী দলগুলিশাসিত রাজ্যে ধর্মঘট হবে। কেন না তারা রাজনৈতিকভাবেই ধর্মঘটকে সমর্থন জানিয়েছে।

এই ধর্মঘট কতটা কর্মনাশা, দেশের অর্থনীতিতে কী নেতিবাচক প্রভাব ফেলল, কত শ্রমদিবস নষ্ট হলো — তা নিয়ে টেলিভিশন চ্যানেলগুলিতে আগামী কয়েকদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাছেঁড়া চলবে। বাজারি দৈনিকগুলিতে ধর্মঘটের কুফল নিয়ে টন টন নিউজপ্রিন্ট খরচ হবে। তা হোক। কিন্তু একথা অস্বীকার করা যাবে না যে, এখনো পর্যন্ত যতটুকু দেশের সম্পদ অবশিষ্ট রয়েছে তা সম্ভব হয়েছে শুধু এই ধর্মঘট-আন্দোলনের ফলেই। আর দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ এবং মানবসম্পদকে বাঁচাতে এই লড়াইটাই জারি রাখতে হবে। তাহলেই বাঁচবে দেশ। নাহলে দেশের সম্পদ লুট করে, প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা করছাড় পেয়ে বিলিওনেয়ারের সংখ্যা বাড়বে। যাইহোক শ্রমিক-কৃষকদের এই ধর্মঘটের লড়াইটাকে দেশবিরোধী জনবিরোধী বলে আখ্যায়িত করা যায় না। তারা দেশপ্রেমিক কর্তব্যই পালন করছে।

ছবি - প্রতীকী
অগ্নিগর্ভ ইউক্রেন – দায় কার ? এই যুদ্ধকে এড়ানো সম্ভব ছিল ? উত্তরগুলো সহজ না

স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in