১৯৯৪ সালে দেশের সর্বোচ্চ আদালত এস আর বোম্মাই বনাম ভারত সরকার মামলার রায়দানের সময় রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়টি উল্লেখ করেন। ন’জন বিচারক নিয়ে গঠিত এই বেঞ্চ মন্তব্য করেন যে ধর্মনিরপেক্ষতা ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক বৈশিষ্ট্য। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ রাষ্ট্র কর্তৃক প্রত্যেক ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা নয়, বরং রাষ্ট্রের বিচার্য বিষয়গুলি থেকে ধর্মের বিচ্ছিন্নতাই সংবিধানের নির্দেশ। এই রায়ে বিচারকরা আরও উল্লেখ করেন যে প্রত্যেক নাগরিকের ধর্মপালন অবশ্যই সাংবিধানিক অধিকার, কিন্তু রাষ্ট্রের কাছে কোন ধর্ম, কোন মানুষের ধর্মবিশ্বাস বা ভক্তি ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এইসমস্ত বিষয়ে রাষ্ট্রের অংশগ্রহণ একেবারেই অনভিপ্রেত এবং সংবিধান বিরোধী।
কিন্তু বর্তমান ভারতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এই সংবিধান বিরোধী কাজটাই করে চলেছে। নব্বই-এর দশক থেকে বিজেপির উত্থানের সাথে সাথেই রাজনীতির সঙ্গে ধর্মকে মিলিয়ে দেওয়া প্রবলভাবে বৃদ্ধি পায়। তার মানে এই কথা বলা যায় না যে তার আগে কোন রাজনৈতিক দল রাজনীতির সঙ্গে ধর্মকে বা রাষ্ট্রের কার্যকলাপের সাথে ধর্মকে মেলাত না। তবে এই ধর্ম ও রাজনীতির মিশ্রণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছিল প্রচ্ছন্ন বা অপ্রকাশিত। কিন্তু সংসদে বিজেপির ক্ষমতা বৃদ্ধি ও বিভিন্ন রাজ্যে ক্ষমতা দখলের সাথে সাথে রাজনৈতিক নেতাদের ধর্মীয় কার্যকলাপ এবং তার মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখল ও ক্ষমতা বজায় রাখার প্রচেষ্টাই প্রধান হয়ে ওঠে। অনেক আঞ্চলিক দলও এই একই পথ অনুসরণ করে ক্রমাগত ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে।
পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষ সাম্প্রতিককালে এই ধর্মকে সামনে রেখে দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির শিকার। স্বাধীনোত্তর পশ্চিমবঙ্গের মানুষ দেশভাগের যন্ত্রণা এবং উদবাস্তু সমস্যার মোকাবিলা করতে করতে বামপন্থী মতাদর্শকে সামনে রেখেই বাঁচার পথ খুঁজে নিয়েছিল; গড়ে তুলেছিল এক নতুন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল। অবশ্যই এই উদার রাজনৈতিক বোধসম্পন্ন সমাজ গঠনের পেছনে উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের বৌদ্ধিক ও সাংস্কৃতিক প্রবাহেরও অবদান ছিল। এই রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ধর্ম ছিল মানুষের ব্যক্তিগত আচরণের বিষয়। ধর্মের পাশাপাশি যুক্তিবাদ ও জ্ঞানবিচারের প্রসার বাংলার সর্বস্তরের সমাজে কুসংস্কারের সঙ্গে লড়াই চালাতে পেরেছিল দীর্ঘদিন ধরে। তাই সাংস্কৃতিক জগতে ঐতিহ্য ও মুক্ত চিন্তার পারস্পরিক সহাবস্থানে কোন বাধা ছিল না। বাংলার মানুষ প্রগতিশীল সংস্কৃতির বাতাবরণে শিক্ষাকে হাতিয়ার করে উন্নততর জীবনচর্যার পথে অগ্রসর হচ্ছিল।
কিন্তু এই সময়টা পালটে গেল এই রাজ্যে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সাথে সাথে। তৃণমূল কংগ্রেসের মতাদর্শহীন রাজনীতি এবং ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির প্রয়াসের ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিশেষভাবে ধর্মকে কেন্দ্র করে সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের প্রতি ঝোঁক দেখা দিল। প্রাত্যহিক ধর্মাচরণের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ল রাষ্ট্র স্বয়ং। গত ১২ বছর ধরে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ধর্মাচরণের সময় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সহ অন্যান্য নেতা নেত্রীর সরাসরি অংশগ্রণ যেমন মানুষের মধ্যে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করেছে, তেমনি ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলিতে আর্থিক অনুদান, রাষ্ট্রের সহায়তায় ধর্মীয় অনুষ্ঠান পরিচালনা, মন্দির ইত্যাদি নির্মাণে রাষ্ট্রের উদ্যোগ ইত্যাদি সম্পূর্ণ সংবিধান বহির্ভুত কাজকর্মের ফলে গুরুত্ব পেয়েছে কুসংস্কার এবং সংকীর্ণ ধর্মীয় মনোভাব। ফলস্বরূপ সমাজের যুক্তিবাদী, মানবিক, উদার ধারা ব্যাহত হয়েছে এবং বৃদ্ধি পেয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে ধর্মীয় বিভাজন।
সারা দেশ জুড়ে ভারতীয় জনতা পার্টির ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করেছিল তৃণমূল কংগ্রেসের হাত ধরেই। বাংলার বুকে এই দুই দলের সাম্প্রতিক কার্যকলাপ এই ধর্মীয় বিভাজনকেই আরও সুদৃঢ় করেছে। কিন্তু পিছিয়ে পড়েছে বাংলার শিক্ষা ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকার। রাষ্ট্র যখন অর্থব্যয় করেছে মন্দির নির্মাণে, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অনুদান দিতে গিয়ে কিংবা গঙ্গারতি বা দূর্গাপ্রতিমার বিসর্জন শোভাযাত্রা আয়োজন করতে গিয়ে, রাজ্যের অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তখন অর্থাভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার মুখোমুখি হয়েছে, বন্ধ থেকেছে শিক্ষক নিয়োগ, লেখাপড়ার সুযোগ হারিয়েছে বহু প্রান্তিক পরিবারের ছেলেমেয়ে।
পিছোতে থাকা এই সমাজে যুব সম্প্রদায়ের জন্য নতুনভাবে কোন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরী হওয়া দূরের কথা, অতীতে যে সুযোগ ছিল এবং যে সম্ভাবনা তৈরী হচ্ছিল, তাও বিনষ্ট হয়েছে। সমাজের বৌদ্ধিক উন্নতির জন্য রাষ্ট্রের যে ভূমিকা থাকা প্রয়োজন ছিল, বর্তমান রাজ্য সরকারের ভূমিকা তার সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী হওয়ার ফলে সমাজে ফিরে আসছে পিছিয়ে পড়া চিন্তাভাবনা ও সংস্কার, অসহিষ্ণুতা গ্রাস করছে যুবসমাজকে, প্রাচীন ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার নাম করে জীবনকে আটকে ফেলা হচ্ছে পচা কল্পকাহিনীর জলাভূমিতে।
একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ নেওয়া যাক। সুমিত সাউ একটি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। বয়স ১৯ বছর। শিক্ষাগত যোগ্যতা মাধ্যমিক পর্যন্ত বা তারও কম। সে পরিবারের গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য কোন নিয়মিত কাজকর্ম করে না। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলি সুমিতকে মিছিল বা কোন কর্মসূচীতে নিয়ে যাওয়ার জন্য টাকা দেয় এবং এই টাকার বিনিময়ে সুমিত এই রাজনৈতিক দলগুলির প্রয়োজন মত কাজ করে দেয়। রামনবমীর দিনে আয়োজিত শোভাযাত্রায় সে বন্দুক নিয়ে যোগ দেওয়ার ফলে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে এবং এই মুহূর্তে কারাগারে বন্দী। রাজনৈতিক দলের দ্বারা সে ব্যবহৃত হয়েছে ধর্ম নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে এবং তার মতনই কোন গরীব পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তে। উপরের এই গল্পটা সুমিতের একার গল্প নয়। বর্তমান বাংলায় যুব সম্প্রদায়ের এক বিরাট অংশ এইভাবেই রাজনৈতিক দলের সংকীর্ণ ধর্মীয় রাজনীতির শিকার।
তবে প্রশ্ন থেকেই যায় এককালের প্রগতিশীল, যুক্তিবাদী, উদার বাংলার সমাজে সুমিতের মত যুবকেরা এই ধরণের ধর্মীয় রাজনীতির শিকার হচ্ছে কি করে? অথবা কিভাবেই বা বাংলার সমাজ তার জ্ঞান বিচারের ধারাকে হারিয়ে ফেলে কুসংস্কার বা সংকীর্ণ ধর্মীয় মনোভাবের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে? এখানে গ্রামশির ব্যাখ্যাকে নিয়ে আসা যায়। আন্তোনিও গ্রামশি বলছেন, আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হল রাষ্ট্রের অন্যতম নৈতিক কার্যাবলি। অর্থাৎ একটি রাষ্ট্রের চরিত্র শুধু শোষণমূলক নয়। পুঁজিবাদী রাষ্ট্র নিজেকে টিকিয়ে রাখে জনগণের সম্মতি আদায় করে। আর জনগণের সম্মতি আদায়ের জন্য প্রতিদিন কাজে লাগানো হয় পুরসমাজকে, যাদের মাধ্যমে সংস্কৃতি, মূল্যবোধের মত বিষয়গুলিতে হস্তক্ষেপ করা হয় এবং মানুষের মগজটাকে নিজেদের দখলে নিয়ে আসা হয়।
গ্রামশিরই সহযোদ্ধা পামিরো তোইলিয়াত্তি বলেছিলেন যে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পরিশ্রম করে শ্রমিক যখন গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন, তখন তাঁর একটা সাংস্কৃতিক বিনোদনের পরিসর প্রয়োজন। রাষ্ট্রের যারা চালিকাশক্তি, বর্তমান ভারতে কর্পোরেটের প্রতিনিধিরা প্রতিদিন এই সংস্কৃতির নির্মাণ করে এই মগজ ধোলাই-এর কাজে লাগায়। বর্তমান বাংলায়, তথা সমগ্র ভারতবর্ষে শ্রমজীবি পরিবারের এই সাংস্কৃতিক বিনোদনের পরিসরটি তৈরী করা হচ্ছে কর্পোরেট পরিচালিত টেলিভিশনের মাধ্যমে, যার দ্বারা ছড়ানো হচ্ছে যাবতীয় কুসংস্কার এবং পিছিয়ে থাকা সমাজের উপাদানগুলি। শাসকদলগুলির দ্বারা আয়োজিত হচ্ছে নিম্নরুচির সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা অনুদানপ্রাপ্ত ধর্মীয় কর্মসূচী। মিথ্যা কল্পকাহিনী সত্যের মত নির্মাণ করে বইপত্রের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
এর বিপরীতে উদারবাদী কোন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গঠন করা সম্ভব না হওয়াতে শ্রমজীবি মানুষের মগজধোলাই শাসকশ্রেণীর পক্ষে সহজই হয়ে উঠছে। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক থেকে তৈরী হওয়া বাংলার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে সরিয়ে চেপে বসছে নতুনতর ধর্মকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল। একই সাথে শিক্ষার সুযোগ সংকুচিত করে দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষার শেষে সংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের সুযোগগুলি একে একে বন্ধ করা হচ্ছে। ফলে শিক্ষার প্রতিও স্বাভাবিক যে উৎসাহ গরীব ও মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে বিগত একশো বছরে গড়ে উঠেছিল তা হারিয়ে যাচ্ছে। ফলে আজকের বাংলায় সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি আর অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। তাই হাওড়ার শিবপুর বা হুগলির রিষড়ার মত ঘটনা বাংলার বুকে ঘটতে পারে।
অতীতের ব্রিটিশ শাসনকালে, ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য বিদেশী শক্তি হিন্দু ও মুসলমান ধর্মের মানুষের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে তাকে অবলম্বন করেই চালিয়েছিল তাদের “ডিভাইড এন্ড রুল” নীতি। বর্তমানের শাসক শ্রেণী শুধু বিভাজনের রাজনীতি নয়, তার সঙ্গে বেছে নিয়েছে মানুষের মগজ ধোলাইএর মাধ্যমে আধিপত্য বিস্তারের রাজনীতিকেও। একে প্রতিহত করতে গেলে যেমন প্রয়োজন শ্রমজীবি মানুষের ঐক্য, তেমনি প্রয়োজন আধিপত্যের এই প্রাচীরটাকে ভেঙ্গে ফেলার, এক নতুন পালটা সংস্কৃতি তৈরী করার। নাহলে এই লড়াইতে জয়ের সম্ভাবনা কম।
- লেখক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, মতামত লেখকের ব্যক্তিগত
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন