চাঁদ ও সূর্যের অবস্থানান্তরে বিশ্বের বিভিন্ন সংস্কৃতিতে ক্যালেণ্ডারের নানা রূপ প্রাচীন কাল থেকেই প্রচলিত। ধর্মাচারের ভিন্নতায় গ্রহ-নক্ষত্রের বিচারে দিনপঞ্জি ও বর্ষপঞ্জির সেই গণনাধারায় এগুলির রূপগত বৈচিত্র্য সমাজে যেমন দেখা যায়, তেমনি দেখা যায় যে দেশ ও তার শাসনকালের ভিন্নতাতেও যে নানান ক্যালেণ্ডারের প্রচলন ইতিহাসে ঘটেছে।
বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের থেকে হিন্দুদের দিনপঞ্জি বিবেচনা ভিন্ন প্রকৃতির। আবার বাঙালির ক্যালেন্ডার জাপানীদের মতো নয়। অতীতে চিন, ভিয়েতনাম এবং কোরিয়ায় এক ধরনের ক্যালেণ্ডার ব্যবহৃত হত না। তবে সময় গণনার ক্ষেত্রে এইসকল ক্যালেণ্ডারেই চাঁদের দশা অথবা সূর্যের বাত্সরিক অবস্থান, কিম্বা উভয়েই বিবেচনাধীন থাকে। ইসলামিক ক্যালেণ্ডার অবশ্যই তার একটা রূপ, যা ব্যতিক্রমী নয়। এখানে চাঁদের অবস্থানই সময়ের ধ্রুবক।
খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের প্রচলন ছিল। প্রায় ১৫০০ বছর তা প্রচলিত ছিল। ৪৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে জুলিয়াস সিজার কর্তৃক প্রবর্তিত সেই জুলিয় বর্ষপঞ্জী ১৫৮২ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ ফেব্রুয়ারি নতুন বর্ষপঞ্জিতে পরিবর্তিত হয়। এই দিন পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি (১৫০২-৮৫) পূর্বতন জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের সংস্কারসাধনে নতুন গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডার প্রণয়ন করেন। সকল খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে যে এই গণনা জনপ্রিয় হয়, তেমন নয়। আঞ্চলিক সামাজিক রীতি অনেকাংশে গুরুত্ব পায়। খ্রিষ্টান হয়েও দেশভেদে ক্যালেন্ডার আলাদা হয়। গণনার ক্ষেত্রে এই প্রভেদ তাই ধর্মের পাশাপাশি আঞ্চলিক রীতিনিষ্ঠতায় ভিন্ন হয়। এই ক্যালেন্ডার প্রণয়নে গাণিতিক ও জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার পরিসরটা কেমন- সেই মূল কথাটা এখানে মনে রাখতে হবে।
গণনার ক্ষেত্রে এই প্রভেদ আরও স্পষ্ট হয় যখন দেখা যায় গ্রেগরীয় ক্যালেণ্ডারে দিনপঞ্জি গঠিত হয় চাঁদ ও সূর্যের পর্যায়ক্রমিক আবর্তনের হিসেব অনুসারে, তখন হাওয়াইবাসীর ক্যালেণ্ডারে অন্যান্য নক্ষত্রের সুনির্দিষ্ট চলাচলও বিবেচনাধীন থাকে। আবার এই গ্রেগরীয় ক্যালেণ্ডার যে হিব্রু ক্যালেণ্ডারের জনপ্রিয়তা হ্রাস করে, সেই হিব্রু ক্যালেণ্ডার ইহুদি ধর্মের দিনলিপিকে পঞ্জিকাভুক্ত করে। কৃষির কর্মপর্যায় এই দিনপঞ্জি ও বর্ষপঞ্জিতে উল্লেখ থাকতো। সময়ের অন্তরে ক্যালেণ্ডারটি তার গাণিতিক বিশ্লেষণে পরিবর্তন এনেছে, এবং মধ্যযুগের দিনলিপিতেও সেই পরিবর্তন প্রতিভাত হয়েছে।
চার শতাব্দী পর পর, প্রায় তিন দিনের পার্থক্যকে নির্দিষ্ট করে এই গ্রেগরীয় ক্যালেণ্ডার তার সাবেকী জুলিয়ান ক্যালেণ্ডারের থেকে। এটি খ্রিষ্টীয় ক্যালেন্ডার থেকে গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডার নামে বেশী পরিচিত। এই দিনপঞ্জিতে লিপ ইয়ার ধারণার সংযোজন প্রথম দেখা যায়। ক্যালেন্ডারের প্রথম বিজ্ঞানসিদ্ধ প্রথম পশ্চিমী রূপ। জুলিয়ান ক্যালেণ্ডারের সঙ্গে ১৩ দিন যুক্ত করে এবং এর ০.০০২ শতাংশ সংশোধনীর মাধ্যমে এই ক্যালেন্ডার প্রচলিত হয়। গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল ২৫ মার্চের বদলে ১ জানুয়ারি থেকে বছর শুরুর গণনা। প্রটেস্ট্যান্টদের থেকে কিছুটা ভিন্ন গণনায় ক্যাথলিক চার্চ এই ক্যালেন্ডারের প্রচলন করে। আজ তা সর্বাধিক প্রচলিত। রাশিয়া থেকে সৌদি আরব, গ্রিস থেকে মিশর হয়ে তুরস্ক, সর্বত্র আজ এই গ্রেগরীয় ক্যালেণ্ডারের বিজ্ঞানকে মেনে নেওয়া হয়েছে। এটাকে খ্রিষ্টীয় ক্যালেন্ডার পরিচিতিতে দেখা হয় না। এমন কি জার্মানিতে শিল্পায়নের জন্য প্রটেস্ট্যান্টদের ধর্মমতকে কারণ হিসেবে বিচার করলেও সেখানে এই গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডারকে ক্যাথলিক ক্যালেন্ডার বলা হয় না। বিজ্ঞানটাকে মেনে নেওয়া হয়।
বিপ্লবের ঘটনাও ইতিহাসে নতুন ক্যালেন্ডারের জন্ম দিয়েছে। ফরাসি বিপ্লবের পঞ্চম বছরে অর্থাৎ ১৭৯৩ সালে বিপ্লবী প্রজাতন্ত্রী সরকার গ্রেগরীয় বর্ষগণনার পদ্ধতির বদলে একটি নতুন পদ্ধতির প্রবর্তন করে তা বিপ্লবী ক্যালেণ্ডার নামে পরিচিত। সমগ্র বৎসরকে ৩০ দিনের ১২টি মাসে বিভক্ত করার গ্রেগরীয় রীতি বজায় রেখে মাসগুলির নাম বদলে দেওয়া হয়। ১৭৯৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর থেকে যেহেতু নতুন বিপ্লবী ক্যালেণ্ডার চালু হয়, তাই বিপ্লবী ক্যালেণ্ডারের শেষ পরবর্তী সেপ্টেম্বরে। এর আর একটি বৈশিষ্ট্য হল সপ্তাহ পদ্ধতি বর্জন। তার বদলে ১০ দিনের দেঁকাদ চালু হয়। তিন দেঁকাদে এক মাস। মাসগুলির নাম যথাক্রমে ভাঁদেমিয়্যার, ব্রু্মেঁয়্যার, ফ্রিমেঁয়্যার, নিভঁজ, প্লাভিয়ঁজ, ভাঁতজ, জ্যমিঁনাল, ফ্লেরিঁয়াল, প্রেরিঁয়াল, ম্যাসিঁদর, থেরমিদঁ, ফ্লক্তিদঁ। নামগুলি অর্থবহ। বিশেষ ঋতুতে প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য ও চেহারা অনুযায়ী মাসগুলির নামকরণ হয়েছিল।
চিনের আধুনিক ক্যালেণ্ডারের সঙ্গে ভিয়েতনাম ও কোরিয়ার ক্যালেণ্ডারের মিল থাকলেও হান সাম্রাজ্যের ক্যালেণ্ডার অথবা প্রায় চার হাজার বছর আগে শাং সাম্রাজ্যে প্রচলিত ক্যালেণ্ডার, এক নয়। সেখানেও এই লুনার-সোলার বিতর্ক আছে। আধুনিক হান ক্যালেণ্ডার ২০১২ সালের ১ জানুয়ারী থেকে গ্রেগরীয় ধারাকে অনুসরণ করে। তবে প্রাচীন হান ক্যালেণ্ডারের ঐতিহ্য আজও চিনের বহু অধিবাসী মেনে চলেন। অপরদিকে ১৮৯৬ সালে কোরিয়ায় গ্রেগরীয় ক্যালেণ্ডারের গণনা সমর্থনে সনাতনী কোরিয় ক্যালেণ্ডারে কিছু পরিবর্তন আনা হয়। সাবেকী এই কোরিয় ক্যালেণ্ডার পূর্ব-এশিয়ার জীবনধারায়, সংস্কৃতিতে পুষ্ট। বার্ষিক উৎসব এবং চাঁদ ও সূর্যের সরণ বিবেচনায় সময়ের গণনায় এই ক্যালেণ্ডার ব্যাপক জনপ্রিয় হয়।
চাঁদকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র সূর্যের গতিবিধির গাণিতিক গণনায় থাইল্যাণ্ডের ক্যালেণ্ডার সেই দেশে জনপ্রিয়। গ্রেগরীয় ক্যালেণ্ডারের দিনলিপি ও জীবনধারা এখানে স্পষ্ট হলেও এই ক্যালেণ্ডারের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল এর সাল গণনা বুদ্ধের জন্ম বছরের নিরিখে করা হয়। হিন্দু ক্যালেণ্ডারেও বার্ষিক উৎসবের প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। বৈদিক রীতি মেনে সময়ের গণনা এবং একাধিক বছরের সমন্বয়ে একটা যুগের বিবেচনা এই ক্যালেণ্ডারে করা হয়। ভারতের সাকা ক্যালেণ্ডার এমনই এক সংস্কারলব্ধ হিন্দু ক্যালেণ্ডার।
ভারতের অঞ্চলভেদে যে ভিন্ন ভিন্ন রীতির প্রচলন সামাজিক স্তরে ছিল, সনাতনী সমাজ তার সেই প্রাচীন ঐতিহ্য মেনে ক্যালেণ্ডার প্রচলন করে। এই সামাজিক রীতিগুলি বর্ষপঞ্জী গঠনে সহায়ক হয়। হিন্দু ক্যালেণ্ডার হয়েও নেপালের ক্যালেণ্ডার তামিল ক্যালেণ্ডারের সমরূপী হয় না। বাংলা ক্যালেণ্ডারেও দিন গণনার বিষয়টি ভিন্ন প্রকৃতির হয়। জাভা, সুমাত্রায়, এমনকি অধুনা মায়ানমারে দিন গণনার রীতি সম্প্রদায় ভেদে আলাদা। তবে এই সকল ক্যালেণ্ডারেই চাঁদের দশা এবং সূর্যের অবস্থান হয় সপ্তাহ, মাস ও বছর বিবেচনার প্রধান সূত্র। একটা চক্রাকার আবর্তনকে অনিবার্য ধরে নিয়ে, ঋতু এবং ফসলের সংযোগে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চা, ক্যালেন্ডার রচনায় মানব জাতিকে সাহায্য করে। ক্যালেন্ডার হল বর্ষপঞ্জী যা মানব প্রজাতির স্থায়ী আবাসনির্ভর সভ্যতার চাহিদা।
ইসলামে যে হিজরি ক্যালেন্ডারের কথা বলা হয় সেটা হল চান্দ্রবর্ষপঞ্জী। স্বয়ং মহম্মদ মক্কা থেকে মদিনা যাত্রার সময় এই গণনা করা হয় বলে ইতিহাস দাবি করে। সময়টা জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে ৬২২ খ্রিস্টাব্দ। এই জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার কারণ হিসেবে দুটি দিক সাধারণ ধারণায় আলোচিত হয়। এক, রাত্রিকালীন যাত্রা পথের আশঙ্কা, গণনার প্রথম উপাদান। দুই, চাঁদের আগমন বৈচিত্র্যময়, যা আপাতভাবে সূর্যের নেই। অন্যান্য কারণের বাইরে তাই এই চান্দ্রবর্ষপঞ্জী ৩৫৪ দিনের।
এই প্রচলিত হিজরি গণনা গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর অববাহিক অঞ্চলের জীবন প্রণালীর সঙ্গে মেলে না। খ্রিষ্টাব্দের সঙ্গে হিজরি বছরের হিসেবে যেমন গড়মিল থাকে, ঠিক তেমনি এই অববাহিকা অঞ্চলের গণনায় হিজরি সন বেখাপ্পা। এখানে যেহেতু ঋতু গুরুত্বপূর্ণ, তাই বর্ষপঞ্জী সূর্যকে মেনে চলে। চাঁদ তার ভেতরেই থাকে। প্রাচীন বাংলার রীতিতে চাঁদের পূর্ণতা প্রাপ্তির সঙ্গে তার অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার ঘটনা সমাজ জীবনে একটা লক্ষ্যণীয় বিষয়।
তবুও বলতে হয় যে বাংলা ক্যালেন্ডার বা এই বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিহাস বড় দুর্বল। ধোঁয়াশায় ভরা। বাঙালির ইতিহাস চর্চায় ভারতে সর্বোচ্চ হয়েও এই বিষয়ে যে থেকে যায় তা ইতিহাসের ভাষ্যকার নীতিশ সেনগুপ্ত মেনে নেন। তিনিও ধরে নেন যে ৬০৬ থেকে ৩৭ খ্রিষ্টপূর্বেই গৌড় রাজ শশাঙ্কের শাসনকালে গণনাকারীরা বাংলার নিজের বর্ষপঞ্জী ঠিক করে। অন্যান্য অনেক সম্ভাবনার কথা তিনি তাঁর মহাভারত থেকে মুজিব সংক্রান্ত গ্রন্থে বললেও এটা স্পষ্ট করেন না যে আজ থেকে ১৪২৮ বছর আগের দিনটা তারও হাজার বছর আগে কেন চিহ্নিত হল?
হয়তো এমন বহু প্রশ্নের উত্তর জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চায় প্রাচীন বাঙালির ইতিহাস সম্পর্কিত গবেষণার কাজ যিনি করবেন, তিনি খুঁজে পাবেন। দেখে নিতে পারবেন যে এই ৫০ খ্রিষ্টপূর্ব সময়কালে বাংলায় বিক্রমাদিত্য বর্ষপঞ্জী কোন নতুনত্বে জনপ্রিয় হয়েছিল। কেন সূর্য-চাঁদ, এই দুজনেই হাজির থাকছে গুরুত্বের সঙ্গে বাংলার মাটিতে বহুদিন।
সেই ধারা আঘাত পায় মুঘল আমলে। ধর্মের থেকেও এই ধাক্কার মূল কারণ ছিল দুটি। প্রথমত, শাসক এখানে বাংলার বাইরে থেকে নতুন কর ব্যবস্থায় কৃষিকে অন্তর্ভুক্ত করে। দ্বিতীয়ত, এই প্রথম বাংলার দৈনন্দিন জীবন জোরালোভাবে হিজরি সনের প্রশাসনিক নিয়মে চলতে শুরু করে যা বাংলার অর্থনীতির প্রেক্ষিতে বেমানান। মূলত এই দুই কারণ, ১৫০০ পরবর্তী সময় বাংলা থেকে আয় সংক্রান্ত হিজরি হিসেবের সঙ্গে এখানকার ফসলের নিয়ম রাজনৈতিক সংঘাতকে অনিবার্য করে। বারো ভূঁইয়াদের ঐক্যবদ্ধ জমিদারির ইতিহাস এবং মুঘল সৈন্যদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ ক্রমে স্পষ্ট হয়। হুসেন শাহের শাসনকালে তাই ক্যালেন্ডারের হিসেব পরিবর্তনের প্রয়োজন দেখা দেয়। প্রচলিত বাংলা বর্ষপঞ্জীর সঙ্গে হিজরি হিসেবের সংকরায়ন বাংলার আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ঘটে। ১৫৮৪র পরবর্তী সময় (বিতর্ক থাকলেও) অর্থমন্ত্রী টোডারমলের উপদেশ মেনে বঙ্গাব্দ প্রচলনে দিল্লির সম্রাট আকবরের সম্মতি মেলে। খাজনা ব্যবস্থার বিন্যাস বর্ষার আগেই মিটিয়ে দেওয়ার নিয়মে বাঁধা হয়।
কৃষি অর্থনীতি এবং সামাজিক রীতির সঙ্গে অঞ্চলবাহ্য শাসকের এই সংঘাত তর্কপ্রিয় ভারতীয় হিসেবে অমর্ত্য সেন নিজেও ধরতে চান। বাংলা ক্যালেন্ডারের সংশোধিত ও পরিমার্জিত আধুনিক রূপ সেই সংঘাতের পরিণতি হিসেবেই বিবেচিত হয়। আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাকে গুরুত্ব দিয়ে তিনি প্রায় ১৫ বছর আগেই দাবি করেন যে বঙ্গাব্দের প্রাতিষ্ঠানিক রূপটি এই সময় লাভ করে। খাজনা আদায়ের সুবিধা এবং দ্বন্দ্ব নিরসনের সহজ উপায় হিসেবে আকবর অধীন মুঘল ভারতে বহুল প্রচলিত হিজরি ক্যালেণ্ডারের সঙ্গে সূর্যের অবস্থান গণনার সংকরায়ন আমির ফতেউল্লাহ সিরাজির চেষ্টায় রচিত এবং প্রচলিত হয়। এ যেন হিজরি সনের পরিবর্তে তারিখ-ই-ইলাহীর একটা রূপ। এই বাংলা ক্যালেণ্ডার ধর্মের থেকে অনেক বেশী আর্থ-সামাজিক পরিসরে প্রচলিত সাংস্কৃতিক রেণুগুলোকে গুরুত্ব দেয়।
শকাব্দের পরিবর্তে বঙ্গাব্দ বিবেচনায় চৈত্রের শুক্ল পক্ষকে বছরের শেষ সময় ধরা হয় এবং পয়লা বৈশাখ নতুন বছরের নতুন দিন হয়। আজ সেই দিন। ১ বৈশাখ, ১৪২৮, বৃহস্পতিবার। বাঙালির সমাজ-ইতিহাসে এ হল সেই দিন, যখন দিল্লির সম্রাটের কাছে বাঙালি-প্রজার কোনো ঋণ থাকে না। ঋতুর বৈশিষ্ট্যকে প্রাধান্য দিয়ে পর্যায়ক্রমিকভাবে মাসের হিসাব করা হয়। লোকগাথায় সেই বর্ণনা উঠে আসে। বাঙালির সুখদুঃখের দৈনন্দিন গল্পে একটা দিন হিসেবে শুক্রর সঙ্গে জুম্মার লড়াই থাকে না।
আজ পাঁচশো বছর ধরে বাঙালি সেই যাপনে অভ্যস্ত হয়েছে। নববর্ষের সেই আনন্দ শুধু মঙ্গল শোভাযাত্রায় সীমায়িত নয়, এ যেন একটা অঞ্চলের বিশেষত্ব। এই বিশেষ রূপই ভারতীয় সংস্কৃতির বৈচিত্র্য বজায় রাখার জিয়নকাঠি।
সেই বৈচিত্র্যে বাঙালি পয়লা বৈশাখে ১লা নয়। দক্ষিণ এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এই দিনে অথবা এই দিনের দুয়েক দিন আগেপরে নববর্ষ। এই দিন বাঙালির কাছে মিলনের। উৎসবের। এই দিনের কোনও ধর্ম-চিহ্ন নেই, আছে বন্ধন গ্রন্থির ঘ্রাণ আর রীতি-চিহ্ন।
এটা আনন্দের দিন। এই আনন্দকে কোথাও আশঙ্কায় পরিণত করে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা করা হচ্ছে। এটা চক্রান্ত। সেই ষড়যন্ত্রীরা পয়লা বৈশাখের শুভ দিনটাকে হিন্দু নববর্ষের শুরু বিবেচনা করেন। সেখানে তারা ভুলে যান যে এতে গুজরাটিরা হিন্দু পরিচিতির লিস্ট থেকে বাদ যান। হিন্দু পরিচিতির বাইরে চলে যান রাজস্থানের হিন্দু ভাই। বাংলার মুসলমান বিদ্বেষে হিন্দুত্ববাদী প্রচারে তাই সুস্থতার ছাপ নেই। আছে গো-বোধে আনন্দ, আর হিংসার সলতে পাকানোর অভীপ্সা। এটা ত্যাজ্য। এই অবোধ পরিচয় তাই কাশ্মীরের হিন্দু পণ্ডিতদের অত্যাচারের কাহিনী গেয়েও ভুলে যায় যে ৩৭০ ধারা তুলে নেওয়া অঞ্চলেও বৈশাখের প্রথম দিনটা নববর্ষ নয়। অথচ এই হিন্দুত্ববাদীদের প্রতিনিধিদের যারা পাঞ্জাব ছাড়া করতে নেমেছে, সেই শিখ সম্প্রদায় এই সময়েই নববর্ষ পালন করে। জালিয়ানওয়ালাবাগের সেই নির্মম সাম্রাজ্যবাদী অত্যাচারের ঘটনা এই উৎসবের দিনগুলিকেই সেদিন রক্তস্নাত করেছিল।
অজ্ঞতার মূলে আছে ভারতবর্ষকে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের ভূখণ্ড হিসেবে বিবেচনা না করার রাজনৈতিক অভ্যাস। এটা কৌশলী ভুল। এটা পরিকল্পিত। এই নেতিবাচক অর্বাচীনের মিথ্যাচার এখন আত্মঘাতী বাঙালির প্রাণ শক্তি। এ হল চেতন বাঙালির মৃত্যু দূত। সমাজের সকল স্তরে প্রতিরোধের পাঁচিল গড়ে একে প্রতিহত করতে হবে। বিজ্ঞানের গবেষকগণ সেই কাজে সাহায্য করবেন। তেলেগু, তামিল, কন্নড় ও মালয়লম ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে একই দিনে নববর্ষ পালন না করার রীতি-সূচকে হিন্দু খুঁজে দেওয়ার পরীক্ষা, এই ধ্বংস-চেতন হিন্দুত্ববাদীদের দিতে হবে। চেতনায় শাণিত গণআদালতে এই বিচার করতে হবে। হিংসার বিষ নষ্ট করতে হবে।
অন্যথায় নববর্ষের আনন্দ মাঝে দমনমূলক রাজনৈতিক পন্থা হিসেবে ফ্যাসিবাদ অবশ্যই একটা আশঙ্কার রাজনীতিকে বাস্তব করে তুলতে সফল হবে।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন