অবশেষে সত্তর বছর পর ইউরোপের মাটিতে বেজে উঠল যুদ্ধের দামামা। যখন এই কথাগুলো লিখছি রুশ সেনাবাহিনী দাঁড়িয়ে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের দোরগোড়ায়। কি করে এই পরিস্থিতির উদ্ভব হল ? এর জন্য দায়ীই বা কে ? এই যুদ্ধকে এড়ানো সম্ভব ছিল ? প্রশ্ন অনেক আর উত্তরগুলোও সহজ না।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ইউনিয়নের মধ্যে ইউক্রেনিয়ান সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক নামক প্রজাতন্ত্রটিই বর্তমান ইউক্রেন প্রজাতন্ত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। প্রাচীন কাল থেকেই রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের ইতিহাস ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। যে সভ্যতা থেকে রুশ সভ্যতা বিকশিত হয়েছে, সেই কিয়েভান রুস-এর আঁতুড়ঘর ছিল বর্তমান ইউক্রেন। এই রাজ্যটির নাম থেকেই দেশটার নাম ‘রাশিয়া’ হয়।
দীর্ঘকাল এই অঞ্চলটি পোলিশ-লিথুয়ানিয়ান কমনওয়েলথ এবং রুশ সাম্রাজ্য-এর মধ্যেই বিভাজিত ছিল। অটোম্যান তুরস্কের রমরমার সময় তারাও মাঝে মাঝে এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করেছে, যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে রুশ সাম্রাজ্যের সঙ্গে। পিটার দ্য গ্রেটের পরবর্তী সময় ইউরোপীয় মহাশক্তি রূপে রাশিয়ার উত্থানের পর এই অঞ্চলটিকে দৃঢ়ভাবে রুশ সাম্রাজ্যের অধীনে আসে। এই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি সবই ছিল, কিন্তু তা মূল রুশ সংস্কৃতির থেকে তার বিশাল ব্যবধান কোনোদিনই ছিল না।
এই অঞ্চলটির অধিবাসীরা তাই ইউক্রেনিয়ান অপেক্ষা দক্ষিণ রাশিয়ান নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন, ঠিক যেমন তাঁদের উত্তরের প্রতিবেশীরা পরিচিত ছিলেন শ্বেত রাশিয়ান বা বেলারুশিয়ান নামে। এই নিবিড় ঐতিহাসিক যোগ সত্ত্বেও দক্ষিণ রুশরা গ্রেট রাশিয়ান পরিচালিত জারতন্ত্রী রুশ সাম্রাজ্যের আমলে নানা ভাবে বঞ্চনার শিকার হয়। ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদ এই বঞ্চনার ক্ষোভ থেকেই বিকাশ লাভ করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরে ইউক্রেনে দুটি সমান্তরাল সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, রাশিয়ার মতোই। একদিকে ছিল ইউক্রেনিয়ান পিপলস রিপাবলিক আর অন্যদিকে ছিল ইউক্রেনিয়ান সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাব্লিক। বহুমুখী গৃহযুদ্ধে শেষ পর্যন্ত ইউক্রেনের সোভিয়েত সরকারই জয়লাভ করে। ইউক্রেনের সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। অক্টোবর বিপ্লবের পরবর্তীকালে লেনিন ছিলেন প্রথম কোনো রুশ নেতা যিনি ইউক্রেনীয় জাতিসত্ত্বাকে পূর্ণ স্বীকৃতি প্রদান করে।
এর পর সোভিয়েত ইউনিয়ন ইউক্রেনাইজেশনের নীতি গ্রহণ করে যেখানে নবগঠিত সোভিয়েত রাষ্ট্র ইউক্রেনিয়ান ভাষা, সংস্কৃতি ও কৃষ্টিকে পূর্ণ সমর্থন প্রদান করে। যখন প্রথম ইউক্রেনিয়ান এস.এস.আর সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয়, তখন ইউক্রেনীয় ভাষা, সংস্কৃতি ও কৃষ্টির অন্যতম রক্ষক ছিলেন ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন। রুশ জাতীয়তাবাদ কোনোদিনই ইউক্রেনীয় ভাষা বা সংস্কৃতির আলাদা অস্তিত্ব স্বীকার করেনি।
লেনিন, যিনি রুশ জাতীয়তাবাদী চিন্তা থেকে মুক্ত ছিলেন, সব সময় লক্ষ্য রেখেছেন যাতে ইউক্রেনের নিজের সংস্কৃতি রুশ সংস্কৃতির আধিপত্যের শিকার না হয়। এই মর্মে তিনি যে প্রক্রিয়া শুরু করেন ও উৎসাহ দেন, ইতিহাসে তা ইউক্রেনাইজেশন নামে পরিচিত। এই দিক দিয়ে আধুনিক ইউক্রেনীয় ভাষা ও সংস্কৃতিকে রুশ আধিপত্যবাদের ছায়া থেকে বের করে এনে তাকে লালন করার জন্য বিংশ শতকে যাঁদের অবদান সবথেকে অধিক ছিল, তিনি হলেন লেনিন। মজার বিষয় হল, ২০১৪ পরবর্তী ইউক্রেনীয় রেজিমের কাছে লেনিনের এই অবদানের কোনোই মূল্য নেই। বরং তিনি হলেন,তাঁদের কাছে রুশ আধিপত্যের প্রতীক। তাঁর মূর্তি ভাঙা, তাঁর নামে রাখা রাস্তার নাম পাল্টানো ইত্যাদি ২০১৪-এর পর নতুন গতি পায়।
অন্যদিকে ভ্লাদিমির পুতিন ও রুশ জাতীয়তাবাদীরাও লেনিনকে সহ্য করতে পারেন না। পুতিন গত ২১-শে ফেব্রুয়ারিও ক্ষোভের সঙ্গে বলেছেন – “The Soviet Ukraine emerged as a result of the Bolshevik policy, and even nowadays it can with good reason be called Vladimir Ilyich Lenin Ukraine. He is its author and architect. This is fully confirmed by the archive documents, including Lenin’s directives regarding Donbas which was literally squeezed into Ukraine," এবং যোগ করেছেন রাশিয়ার যা ঐতিহাসিক ভূমি, ইউক্রেন, তাকে লেনিনই দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করেন তার আলাদা পরিচিতি স্বীকার করে নিয়ে।
এ খুবই যথাযথ যে যুযুধান দুই অলিগার্ক নিয়ন্ত্রিত সোভিয়েত-পরবরতী রাষ্ট্রের জাতীয়তাবাদীরাই লেনিনের দিকে থুতু দিচ্ছেন। প্রশংসিত হলেই তো তিনি বরং অখুশি হতেন। যাই হোক, অচিরেই ইউক্রেন হয়ে ওঠে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কৃষিক্ষেত্র ও শিল্পাঞ্চল। রাজনীতিতেও সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বোচ্চ স্তরে উঠে আসেন একঝাঁক ইউক্রেনীয় নেতা, যেমন লাজার কাগানোভিচ। বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন ক্ষমতার মধ্যগগণে তখন তার রাষ্ট্রনায়কও ছিলেন একজন ইউক্রেনিয়ানই – নিকিতা ক্রুশ্চেভ।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর অন্যান্য প্রজাতন্ত্রের মতো ইউক্রেনও ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যায়। এরপর থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত পর্যন্ত ইউক্রেনের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেছে মূলতঃ ইউক্রেনিয়ান অলিগার্করা। প্রত্যেক প্রেসিডেন্টই কোনো না কনো অলিগার্ক গোষ্ঠীর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছেন। যেমন বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভলদোমির জেলেনস্কির পেছনে রয়েছে অলিগার্ক ইহোর কলময়িস্কির লম্বা হাত। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অলিগার্কদের এই প্রভাব ইউক্রেনের জনতা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে।
এই গোষ্ঠীটিকে আমরা সোভিয়েত পরবর্তী পুঁজিবাদী শক থেরাপির শিকার সব দেশেই দেখতে পাব। কিন্তু প্রধান সমস্যা হল, ক্রমশ ইউক্রেনের এই অলিগার্কির মধ্যে দুটি ভাগের উত্থান হল। একটি ভাগ উৎসাহী ছিল রাশিয়ার সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় করতে আর অপর একটি ভাগ উৎসাহী ছিল ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে। এই দুই গোষ্ঠী সংঘাতই মুলতঃ ইউক্রেনিয়ান রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণ করেছে এই শতকে।
২০১৪ সালে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ভিক্টর ইউনোকুভিচ। তিনি রুশ অলিগার্কদের দ্বারা সমর্থিত এবং তাঁকে সাধারণতঃ রুশপন্থী আখ্যা দেওয়া হলেও রাশিয়া ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মধ্যে তিনি একটা ভারসাম্য রাখতে আগ্রহী ছিলেন। সমস্যা বাঁধল যখন ইউনোকুভিচ ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি না করে ও আই.এম.এফ-এর থেকে ঋণ না নিয়ে সুলভে প্রাপ্ত রাশিয়ান ঋণ গ্রহণ করলেন। এই ঘটনা জনগণের কাছে ধরা দিল রাশিয়ার কাছে আত্মসমর্পণ রূপে। দীর্ঘদিন ধরে যে দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, অলিগার্কদের যথেচ্ছাচার নিয়ে মানুষের মনে দীর্ঘদিন ধরে যে বারুদের সঞ্চার হয়েছিল, তার বিস্ফোরণ হল।
শুরু হল ইউরো ময়দান বিক্ষোভের। এই বিক্ষোভের সত্যিকারের গণভিত্তি থাকলেও একে স্বাভাবিক ভাবেই ইউরোপিয়ান ইউনিয়নপন্থী অলিগার্করা নিজেদের কাজে লাগাতে চায়, তারা তাদের সমর্থিত দক্ষিণপন্থী দলগুলিকে ইউনোকুভিচের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। এই গণক্ষোভের ফলে রাজধানী ক্রমে অগ্নিগর্ভ হয়ে পড়ে। দফায় দফায় পুলিশ ও জনতার সংঘাত হয়। অবশেষে ইউনোকুভিচের সরকারকে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে উৎখাত করা হয় এবং ইউনোকুভিচ দেশত্যাগ করতে বাধ্য হন।
এই সমগ্র প্রক্রিয়া যদি রুশ সমর্থিত গোষ্ঠী করত, তাহলে স্বাভাবিক ভাবেই পশ্চিমের দেশগুলো তাকে ক্যু হিসেবে দেখাত। কিন্তু যেহেতু এতে তাদেরই স্বার্থ সিদ্ধি হচ্ছিল, তাই একে পশ্চিমী গণমাধ্যমে তুলে ধরা হল ‘Revolution of Dignity’ নাম দিয়ে। বিক্ষোভের চুড়ান্ত অ্যান্টি-সেমেটিক নেতারা ডাক, ‘সিংহাসন থেকে ইউনোকুভিচ ও মস্কোর ইহুদিদের টেনে নামাও। পশ্চিমের গণমাধ্যম তাই শুনেও শোনেনি।‘ এর পরে রাশিয়া এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে ক্রাইমিয়া দখল করে ও ডনবাসে ডনেৎসক এবং লুগানস্কে রুশ সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীরা গড়ে তোলে দুটি পৃথক প্রজাতন্ত্র।
এই সময় পশ্চিমা শক্তিগুলি আজোভ ব্যাটালিয়নের মতো নিও-নাৎসি গ্রুপগুলিকে প্রত্যক্ষ ভাবেই অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সহায়তা করতে শুরু করে রুশ সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিপক্ষে। নতুন ইউক্রেনের সরকার এই নিও-নাৎসি গ্রুপগুলিকে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করে। নতুন ইউক্রেনীয় রেজিমের বিরুদ্ধে যেই দাঁড়াক – সে কমিউনিস্ট হোক, ইউক্রেনে বসবাসকারী রাশিয়ান হোক, ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য হোক বা ইউনোকুভিচ সমর্থক ইউক্রেনিয়ান হোক, প্রত্যেকেই রাতারাতি চলে এল রাস্তার দখল নেওয়া পশ্চিম সমর্থিত নতুন তৈরি নিও-নাৎসি ঠেঙ্গাড়ে বাহিনীর নিশানায়। ইহুদি বা সমকামীরাও রেহাই পেলেন না। ইউক্রেনের রাস্তায় রাস্তায় নাৎসিরা মশাল হাতে সশস্ত্র মিছিল করল। এও পশ্চিমের গণমাধ্যম দেখেও দেখল না।
ইউক্রেনের কমিউনিস্ট পার্টি কিন্তু ইউরো ময়দান গণবিক্ষোভের সময় ইউনোকুভিচের বিপক্ষেই ছিল। কিন্তু অচিরেই তাদেরকে নিষিদ্ধ করা হল এই দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠীগুলির চাপে। স্তেফান বান্দেরা বা রোমান শুখেভিচের মতো ফ্যাসিস্ট, নাৎসি কোল্যাবরেটররা নায়কের সম্মান পেতে লাগলেন শুধু সোভিয়েত বিরোধী ছিলেন বলে। পশ্চিমী শক্তিগুলি এগুলোও না দেখার ভান করে তলায় তলায় উৎসাহ জুগিয়ে যেতে লাগল।
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে একদা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কথা দিয়েছিল যে পুনরায় ঐক্যবদ্ধ জার্মানির এক পা পূর্বে NATO সম্প্রসারিত হবে না। এই প্রদত্ত প্রতিশ্রুতির কথা বিস্মৃত হয়ে NATO সোভিয়েত ইউনিয়নের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও বিস্তার লাভ করেছে পোল্যান্ড, চেক ও স্লোভাক প্রজাতন্ত্রদ্বয়, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া, বুলগারিয়া ও তিনটি বাল্টিক প্রজাতন্ত্রে। বাকি রয়ে গেছে ইউক্রেন এবং বেলারুশ। স্বভাবতই শঙ্কিত রাশিয়া কখনও চায়নি এই দুটি রাষ্ট্রও NATO-এর অন্তর্ভুক্ত হোক।
এই পরিস্থিতিতে বৃহত্তর শান্তির স্বার্থে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমের শক্তিগুলো যদি এই প্রতিশ্রুতি দিত যে এই দুটো দেশ কখনো NATO ভুক্ত হবে না, তাহলে রাশিয়া সম্ভবতঃ অস্ত্র হাতে তুলত না। কিন্তু দিনের পর দিন আলোচনায় পশ্চিমা শক্তিগুলির, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক পা না পেছোনোর জেদ জার্মানির কূটনৈতিক বোঝাপড়ার চেষ্টা সত্ত্বেও ২০১৪ থেকে ধুঁইয়ে ওঠা এই পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক হতে দেয় নি। মিনস্ক চুক্তি থেকে কিছুটা হলেও যে শান্তিপূর্ণ সমাধানের রাস্তা বের করা গেছিল, তা সফল হতে পারেনি। এই তো গেল পশ্চিমের শক্তিগুলোর এবং তাদের সমর্থিত অলিগার্ক পুষ্ট ইউক্রেন রাষ্ট্রের এই সংঘাতে দায়িত্ব। এরপর রাশিয়ার দায়িত্বের কথায় আসা যাক।
এই যুদ্ধ সূচনা হওয়ার আগে অবধি সামগ্রিক পরিস্থিতির দায় যুযুধান দুই পক্ষের মধ্যে রাশিয়ার সামান্য হলেও কম ছিল। তবুও এটা বলে রাখা প্রয়োজন, রাশিয়া সমর্থিত অলিগার্করা দীর্ঘ দিন ধরেই ইউক্রেনের অর্থনীতি লুটের সঙ্গে যুক্ত আছে, এই বিষয়ে তাদের দায়িত্ব, ইউরোপ সমর্থিত অলিগার্কদের থেকে তাদের ক্ষমতা বেশি বৈ কম না। ক্ষমতায় থাকাকালীন রুশ সমর্থিত অলিগার্ক ও তাদের পেটোয়া রাজনীতিবিদরা ব্যাপক দুর্নীতি থেকে রাষ্ট্রীয় সম্পদের খোলাখুলি লুণ্ঠন, সবই করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে ইউরোময়দানে প্রথম যে গণক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল, পরবর্তীকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন তার সুযোগ নিলেও ক্ষোভ তাদের সৃষ্ট না, সেই ক্ষোভ ছিল খাঁটি।
একথা অনস্বীকার্য, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেমন নিজের উদ্দেশ্য সাধনে ইউক্রেনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছে, বিভিন্ন নিও-নাৎসি গোষ্ঠী সহ অতি-দক্ষিণ থেকে দক্ষিণপন্থী শক্তিকে নানা ভাবে সাহায্য করেছে। রাশিয়াও একই ভাবে ইউক্রেনের মধ্যে থেকে রুশ বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিগুলিকে অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সহায়তা প্রদান করেছে নিজেরই স্বার্থে। NATO-এর সম্প্রসারণ নিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই নিরাপত্তার অভাব বোধ করছিল রাশিয়া। তাদের NATO-এর সম্প্রসারণের হার্ড লিমিটের দাবি অন্যায্য ছিল না। কিন্তু তাঁদের যেমন নিরাপত্তার অধিকার আছে, ইউক্রেনেরও তেমন নিরাপত্তার অধিকার আছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেমন একদা কথা দিয়েছিল জার্মানির পূর্বে কোনো NATO সম্প্রসারণ হবে না, ঠিক তেমনই রাশিয়াও ইউক্রেন থেকে সকল পরমাণু অস্ত্র সরিয়ে নেওয়ার বিনিময়ে তার নিরাপত্তার ও ভৌগলিক অখন্ডতা বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি NATO-এর পূর্ব ইউরোপে আগ্রাসী সম্প্রসারণের মধ্যে দিয়ে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে, ক্রাইমিয়া দখল ও ডনবাসে রুশ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে রাশিয়াও কি তা করেনি ? এর পরেও যেহেতু ক্ষমতার নেশায় পশ্চিমী শক্তিজোট ও বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নব্য-নাৎসিদের অস্ত্র, অর্থ ও প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করে, রাশিয়ার কিছু নৈতিক উচ্চভূমি অবশিষ্ট ছিল। কূটনৈতিক ভাবে ইউক্রেনের সমস্যাকে সমাধানের চেষ্টা করলে যে উচ্চভূমি নষ্ট হত না, কিন্তু এই আগ্রাসী যুদ্ধ শুরু করার মাধ্যমে তারা তা হারিয়েছে। একথা যেমন সত্যি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অসম্ভব ঔদ্ধত্যের সঙ্গে আলোচনা পরিচালনা করছিল, একই সঙ্গে এও সত্যি জার্মানি সহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি দেশ ছিল যারা যুদ্ধ অপেক্ষা সমস্ত পরিস্থিতি বোঝাপড়ার মাধ্যমেই মিটিয়ে নিতে আগ্রহী ছিল। রাশিয়ার এই সামরিক হস্তক্ষেপ সেই সম্ভবনায় জল ঢেলে দিল।
ইউক্রেনীয় ও রুশ জনতার দীর্ঘ ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক ইতিহাস আছে, আছে সুগভীর সাংস্কৃতিক বন্ধনও। আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ফ্যাসিস্ট বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ার গৌরবময় ইতিহাস। তারপরেও ইউক্রেনের রুশপন্থী ও ইউরোপ পন্থী অলিগার্কদের সীমাহীন লোভ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মুনাফার জন্য নীতি বিসর্জন দেওয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সম্প্রসারণবাদ এবং রাশিয়ার ধৈর্যহীন, বেপরোয়া, আগ্রাসী বিদেশনীতি এবং ইউক্রেনের নিও-নাৎসিবাদ এবং উগ্র জাতীয়তাবাদকে প্রশ্রয় প্রদান আজ এই পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। সামরিক সংঘাতের যে অগ্নি প্রজ্বলিত হয়েছে, তা আদৌ প্রশমিত করা সম্ভব হবে কিনা, এর উত্তর ভবিষ্যৎ-এর গর্ভে।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন