জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যা, খাদ্য ঘাটতি এবং ২০২২ সালে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মারাত্মক তাপপ্রবাহের কারণে প্রায় ৯০ শতাংশ ভারতীয়র মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়েছে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় বৃহস্পতিবার এই তথ্য সামনে এসেছে।
'পিএলওএস ক্লাইমেট' জার্নালে প্রকাশিত "প্রাণঘাতী তাপপ্রবাহে ভারতের উন্নয়ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন" (Lethal heatwaves are challenging India’s sustainable development) শীর্ষক এই সমীক্ষাটি এমন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে, যখন ভারতের বেশ কয়েকটি অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার কারণে ইতিমধ্যেই তীব্র দাবদাহ চলছে। ভারতে বর্তমানে জলবায়ুর ভয়াবহ অবস্থা পরিমাপ করা এবং তা নিয়ন্ত্রণে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে ন্যাশনাল ক্লাইমেট ভালনারেবিলিটি ইন্ডিকেটর (National Climate Vulnerability Indicator) (CVI) ব্যবহার করা হয়।
CVI-তে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক, জৈব-পদার্থিক, প্রাতিষ্ঠানিক এবং পরিকাঠামোগত বিষয় যুক্ত থাকলেও এতে তাপ প্রবাহের ফলে ক্রমবর্ধমান শারীরিক ঝুঁকির কোনো সূচক নেই। যা নিয়ে কেমব্রিজের সমীক্ষায় সতর্ক করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে ভারতীয়রা চরম তাপপ্রবাহে কী ধরণের সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে তা নীতিনির্ধারকদের বিবেচনা করতে এই সূচক সাহায্য করবে।
রিপোর্টের প্রথম লেখক, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো, ডক্টর রমিত দেবনাথ জানিয়েছেন, "ভারতের যেসব অংশে ক্রমবর্ধমান তাপপ্রবাহের কারণে মানুষ সবথেকে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় পৌঁছে যাচ্ছে তা নির্ধারণ করতে একটি তাপ সংক্রান্ত পরিমাপ জরুরি। যা তাপপ্রবাহ বৃদ্ধি সংক্রান্ত কর্ম পরিকল্পনাকে আরও কার্যকর করতে সাহায্য করবে।"
তিনি আরও বলেন, এর ফলে, আমরা বুঝতে পারবো প্রচণ্ড তাপ কীভাবে দেশের কোন অংশের মানুষকে প্রভাবিত করছে।
ভারতীয় জনসংখ্যার উপর তাপ তরঙ্গের পুনরাবৃত্ত প্রভাব পরিমাপ করার ক্ষেত্রে একটি "তাপ সূচক" অন্তর্ভুক্ত করার জন্য এই গবেষণাটিই প্রথম।
আশেপাশের অবস্থার তুলনায় মানবদেহ কতটা গরম অনুভব করে, যখন আর্দ্রতা এবং বাতাসের তাপমাত্রা একসাথে যোগ করা হয়, তা সূচকটি পরিমাপ করতে সক্ষম।
সমীক্ষা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, সিভিআই (CVI) ভারতীয় জনসংখ্যার জন্য তাপ তরঙ্গের প্রধান ঝুঁকি এবং বিপদের কারণগুলিকে অবমূল্যায়ন করে, কারণ এতে তাপপ্রবাহ সংক্রান্ত কোনো ধরনের পরিমাপ অন্তর্ভুক্ত নয়।
এই সূচক অনুপস্থিত থাকায় দেশের মূল ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলিকে চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে যায়। যেমন দিল্লি এবং অন্যান্য বৃহত্তর শহুরে অঞ্চলগুলি সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ।
গবেষকরা তাপ সংক্রান্ত তীব্রতার বিভাগগুলিকে আলাদা আলাদা ভাবে নথিবদ্ধ করার জন্য রাজ্য-স্তরের জলবায়ু বিষয়ক সূচকগুলির বিষয়ে প্রাপ্ত তথ্য সহ ভারত সরকারের জাতীয় স্তরের তথ্য এবং অ্যানালিটিক্স প্ল্যাটফর্ম থেকে প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন।
এরপর ২০০১ থেকে ২০২১ সাল - বিগত ২০ বছরে রাষ্ট্রসংঘের সাস্টেনেবল ডেভলপমেন্ট গোলস (SDGs)-এ ভারতের অগ্রগতি এবং ওই সময়ে চরম আবহাওয়াজনিত কারণে মৃত্যুর তথ্য পরীক্ষা করা হয়েছে।
এই গবেষণার ফলাফল থেকে জানা গেছে, যে রাষ্ট্রসংঘের সাস্টেনেবল ডেভলপমেন্ট গোলস (SDGs) অনুসারে বিশ্ব তালিকায় গত দুই দশকে ভারত নীচে নেমে গেছে। কারণ রাষ্ট্রসংঘের সাস্টেনেবল ডেভলপমেন্ট গোলস (SDGs)-এর ১৭টি ক্ষেত্রের মধ্যে ১১টি পূরণ করেনি, যার সবকটিই SDG 13 (ক্লাইমেট অ্যাকশন) এর জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
পূর্ববর্তী গবেষণায় দেখা গেছে, ভারতের ঘন ঘন তাপ প্রবাহ দেশের অর্থনীতি এবং জনস্বাস্থ্য ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে ২০৫০ সালের মধ্যে এর ফলে ৩০০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ প্রভাবিত হবেন এবং ২১০০ সালের মধ্যে ৬০০ মিলিয়নের বেশি মানুষের জীবনযাত্রায় এর সরাসরি প্রভাব পড়বে। যদিও এই আশঙ্কা দেখা দেবার পরেও এই বিষয়ে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়নি বলে সতর্ক করেছে এই গবেষণাপত্র।
সমীক্ষায় আরও দেখা গেছে যে তাপ প্রবাহের কারণে শারীরিক ঝুঁকি পরিমাপ না করায় SDG 2 (ক্ষুধার্ত শূন্যতা), SDG 3 (সুস্বাস্থ্য এবং সুস্থতা), SDG 5 (লিঙ্গ সমতা), SDG 8 (শালীন কাজ এবং অর্থনৈতিক বৃদ্ধি), SDG 9 (শিল্প, উদ্ভাবন এবং পরিকাঠামো), SDG 10 (বৈষম্য কমানো), এবং SDG 15 (ভূমিতে জীবন) প্রভৃতি ক্ষেত্রে অগ্রগতি ব্যাহত হতে পারে।
একটি ছোট পরিসরে, গবেষকদের দ্বারা শহুরে স্থায়িত্বের একটি কেস স্টাডিতে দেখা গেছে যে দিল্লির বাসিন্দারা কিছু কঠিন পরিস্থিতি সহ্য করেছেন এবং প্রায় সমস্ত জাতীয় রাজধানী অঞ্চল (এনসিআর) তাপপ্রবাহের সময় সূচকে বিপদের স্তরে পৌঁছেছে। এর প্রস্তাবিত সমাধানগুলির মধ্যে রয়েছে উন্নত পরিমাপ, স্বল্প-আয়ের আবাসনে অতিরিক্ত তাপ রোধ করা, তাপ তরঙ্গের স্থিতিস্থাপক অংশীদারিত্ব তৈরি করা এবং আন্তর্জাতিক কর্ম পরিকল্পনা থেকে শিক্ষা নেওয়া।
এই গবেষণায় সহায়তা করেছে বিল এবং মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন, কোয়াড্রেচার ক্লাইমেট ফাউন্ডেশন, লডস ফাউন্ডেশন, কেইনস ফান্ড এবং আফ্রিকা আলবোরাডো গ্রান্ট।
(PLOS Climate ম্যাগাজিনে প্রকাশিত গবেষণাপত্র থেকে অনুলিখিত)
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন