খাদ্যের দাবিতে মিছিলে লাঠি, গুলি, মৃত্যু ৮০ জনের - খাদ্য আন্দোলনের ৬২ বছর, ফিরে দেখা

মানুষ একটু খাবার চেয়েছিলো। সস্তা দরে নিজেদের প্রয়োজনের খাদ্য। তার দাবিতেই আন্দোলন। আর তাতেই চললো লাঠি, কাঁদানে গ্যাস, গুলি। রাস্তায় নেমে খাবারের দাবি জানাতে গিয়ে সরকারী হিসেব মতো মৃত্যু হল ৮০ জনের।
খাদ্যের দাবিতে মিছিলে লাঠি, গুলি, মৃত্যু ৮০ জনের - খাদ্য আন্দোলনের ৬২ বছর, ফিরে দেখা
গ্রাফিক্স - নিজস্ব
Published on

মানুষ একটু খাবার চেয়েছিলো। সস্তা দরে নিজেদের প্রয়োজনের খাদ্য। তার দাবিতেই আন্দোলন। আর তাতেই চললো লাঠি, কাঁদানে গ্যাস, গুলি। রাস্তায় নেমে খাবারের দাবি জানাতে গিয়ে সরকারী হিসেব মতো মৃত্যু হল ৮০ জনের। বেসরকারি হিসেবে সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি।

১৯৫৭ সাল থেকেই খাদ‍্য সঙ্কট দেখা গিয়েছিল রাজ‍্যে। সরকারি হিসেব অনুযায়ী ওই বছর রাজ‍্যে খাদ‍্যের ঘাটতি ছিল ৩ লক্ষ টন (চাল)। ১৯৫৮ সালে তা বেড়ে হয় ১২ লক্ষ টন। ১৯৫৯ সালে তা চরম আকার ধারণ করে। বাজার থেকে উধাও হয়ে গেছিলো চাল, গম। গ্রামে গ্রামে প্রায় দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি। খাদ্যের দাবীতে সোচ্চার হয়ে ওঠে মানুষ। বেছে নেয় গণ আন্দোলনের পথ। যে গণ আন্দোলনে প্রমাদ গুণেছিলো রাজ্যে তৎকালীন ক্ষমতাসীন কংগ্রেস সরকার। যার পরিণতি ৩১ আগস্টের নৃশংস সরকারী দমনপীড়ন।

ভয়াবহ খাদ‍্য সঙ্কটের আশঙ্কা‌ করে সঙ্কট মোকাবিলায় ১৯৫৮ সালে তৎকালীন অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির পশ্চিমবঙ্গ শাখা নির্দিষ্ট কয়েকটি ব‍্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছিল। চিঠির আকারে প্রকাশিত হওয়া এই নির্দেশে বলা ছিল - রাজ‍্যের বাইরে থেকে আমদানি করে বর্তমান ঘাটতি পূরণ করা, কৃষকরা যে ধান, চাল বিক্রি করবে তা বড় বড় ব‍্যাপারীদের কুক্ষিগত না হতে দেওয়া, প্রয়োজনমতো ঋণ ও রিলিফের ব্যবস্থা করা, খাদ্য কমিটি গঠন করা, উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া।

ভুখা মানুষের লাইন
ভুখা মানুষের লাইনছবি - সংগৃহীত

কিন্তু তৎকালীন সরকার এর একটিও গ্রহণ করেননি। যার ফলস্বরূপ ১৯৫৯ সালে প্রত‍্যাশা মতো চরম খাদ্য সঙ্কট দেখা দেয় রাজ‍্যে। বামপন্থী বিভিন্ন দল এবং গণ সংগঠনের ডাকে ওই বছর তৈরি হয় ‘মূল্যবৃদ্ধি ও দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটি’। শুরু হয় আন্দোলন। ৩ ফেব্রুয়ারি রাজ্য বিধানসভায় দাবি উত্থাপন করা হয়। জেলায় জেলায়, গ্রামে গ্রামে শুরু হয় প্রচার। ১৫ জুন রাজ্যের কংগ্রেস সরকারের খাদ্য নীতির বিরোধিতায় কলকাতায় হয় কেন্দ্রীয় সমাবেশ। পরবর্তী পর্যায়ে ২৫ জুন রাজ্যব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট ও হরতালের ডাক দেওয়া হয়।

ধাপে ধাপে তীব্র হতে থাকে আন্দোলন। ১৩ জুলাই হয় জেল ভরো আন্দোলন। গ্রেপ্তার হন ১৬৩৪ জন বাম কর্মী সমর্থক। ২৩ আগস্ট থেকে খাদ্যের দাবীতে রাজ্যজুড়ে গণ আন্দোলন শুরু হয়। প্রত্যক্ষ এই আন্দোলন শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গেই নেমে আসে সরকারী দমন পীড়ন। মাত্র ৩ দিনে গ্রেপ্তার করা হয় ৭ হাজারের বেশি বাম কর্মী সমর্থককে।

এরপরই আসে ঐতিহাসিক ৩১ আগস্ট। যেদিন কয়েক লক্ষ মানুষ জমায়েত হন কলকাতার শহিদ মিনার ময়দানে। খাদ্যমন্ত্রীর অপসারণ, পুলিশি দমন পীড়নের প্রতিবাদ এবং খাদ্যের দাবীতে মহাকরণ অভিমুখী ভুখা মানুষের ওই শান্তিপূর্ণ মিছিলে নেমে এলো ভয়ঙ্কর পুলিশি আক্রমণ। নির্মম লাঠিচার্জ। মৃত্যু হয় ৮০ জনের। আহত হাজারের বেশি।

ভুখা মানুষের মিছিল
ভুখা মানুষের মিছিলছবি - সংগৃহীত

এই ঘটনার প্রতিবাদে ১ সেপ্টেম্বর রাজ্য জুড়ে পালিত হয় ছাত্র ধর্মঘট। ধর্মঘটী ছাত্রদের ওপর পুলিশের বেপরোয়া গুলিচালনায় মৃত্যু হয় ৮ ছাত্রের। আহত হন ৭৭ জন।

রাজ্যে ৩ সেপ্টেম্বর ফের ডাক দেওয়া হয় সাধারণ ধর্মঘট ও হরতালের। সেদিনও গুলি চলে বিভিন্ন স্থানে। মৃত্যু হয় ১২ জনের। আহত হন ১৭২ জন।

২৮ সেপ্টেম্বর রাজ্য বিধানসভায় বিধান রায় মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব এনে বিরোধী দলনেতা জ্যোতি বসু বলেন – এ কথা মনে করিয়ে দিতে হচ্ছে যে, ৩১ তারিখ পুলিশের গায়ে একটিও আঁচড়ও পড়েনি। তা সত্ত্বেও ১৪ হাজার কনস্টেবল ঝাঁপিয়ে পড়ল পিছন থেকে, সামনে থেকে, চারপাশ থেকে। লাঠিপেটা করলো লোকের উপর। ১ তারিখে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে ছাত্রদের উপর।… এই যে ঘটনা হলো, পন্ডিত নেহরু এত কথা বললেন কিন্তু কোনোরকম দুঃখ প্রকাশ করতে পারলেন না! ৪১ জন মারা গেলেন সরকারি হিসাবে, আমাদের মতে ৮০ জন - তিন-চার দিনের মধ্যে মারা গেলেন, বলি, পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসি তখন কোথায় ছিল?

স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in