শুধু ভারতে নয়, হিন্দুত্বের প্রচার ও প্রভাব বিস্তারে প্রায় দুই দশক ধরে মার্কিন মুলুকে কাজ করছে একাধিক আরএসএস ঘনিষ্ঠ সংস্থা। এজন্য তারা বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচও করছে।
সম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়া সিটিজেন ওয়েবে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। যে রিপোর্ট অনুসারে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সংঘ পরিবার ঘনিষ্ঠ যে সকল গোষ্ঠী আছে, তারা হিন্দু সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবাদের প্রসার, রাজনৈতিক কৌশল নির্মাণ, সংখ্যালঘুদের উপর বিদ্বেষমূলক প্রচার, সমালোচকদের উপর আক্রমণ এবং পৌরাণিক ইতিহাস ভিত্তিক কাহিনী নির্মাণে খুবই সক্রিয় ভাবে কাজ করছে।
'মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হিন্দু জাতীয়তাবাদী প্রভাব, ২০১৪-২০২১: দ্য ইনফ্রাস্ট্রাকচার অফ হিন্দুত্ব মোবিলাইজিং' শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘এই কাজ করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আরএসএস ঘনিষ্ঠ সাতটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা প্রায় ১ হাজার ২২৭ কোটি টাকা (১৫৮.৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) খরচ করেছে। এমনকি, ২০০১-২০১৯ সালের মধ্যে এই সংস্থাগুলি ভারতেও বিপুল পারিমাণ টাকা পাঠিয়েছে হিন্দুত্বের প্রচারের জন্য।
এই সাতটি সংস্থা হলো - ১) অল ইন্ডিয়া মুভমেন্ট ফর সেবা, ২) একল বিদ্যালয় ফাউন্ডেশন অফ আমেরিকা (ইভিএফএ), ৩) ইন্ডিয়া ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রিলিফ ফান্ড, ৪) পরম শক্তি পীঠ, ৫) পিওয়াইপি যোগ ফাউন্ডেশন, ৬) বিশ্ব হিন্দু পরিষদ অফ আমেরিকা (ভিএইচপিএ) এবং ৭) সেবা ইন্টারন্যাশনাল।
কিভাবে উঠে এসেছে এই তথ্য? রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, সংস্থাগুলির ট্যাক্স প্রদানের হিসাব, সরকারী নথি, জনগণের মতামত এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে জানা গেছে - মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হিন্দু জাতীয়তাবাদী একটি ইকোসিস্টেম কাজ করছে। প্রতিটি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আরএসএস-এর গভীর যোগাযোগ রয়েছে। এই সংস্থাগুলি ২০১৪ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে মার্কিন জনগোষ্ঠী, শিক্ষাক্ষেত্র এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রভাব বিস্তারের জন্য বিপুল অর্থ খরচ করেছে।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা নিজেদের একটি পরিচয় তুলে ধরেছে। হিন্দু সংস্কৃতির দ্বাররক্ষী এবং হিন্দুদের প্রতিনিধি হিসেবে নিজেদের তুলে ধরছে তারা। অনুদান সংগ্রহ করছে। মার্কিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে হিন্দুত্বের ইতিহাসের প্রবেশ ঘটানোর জন্য সমর্থন যোগানো বা লবিং করছে। দক্ষিণ এশিয়ার উপর মার্কিন সরকারের আন্তঃ এবং বিদেশ নীতির পরিবর্তন করার চেষ্টা, সংঘ ঘনিষ্ঠ রাজনীতিবিদদের অর্থ সাহায্য এবং সমালোচকদের নিশানা করছে তারা।
একইসঙ্গে তারা ‘উদ্বাস্তুদের মধ্যে আরএসএসের প্রভাব বিস্তারের জন্য যুব অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মন্দির নিয়ে আলোচনা এবং হিন্দুত্বকে রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে সমর্থন করে এমন ব্যক্তিদের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য প্রকল্পে তহবিল গঠন করার চেষ্টা চালাচ্ছে।’
এই রিপোর্টে আরএসএস প্রভাবিত সংস্থাগুলির বেশকিছু কর্মসূচীকে চিহ্নিত করা হয়েছে (ফিগার-১)। যেগুলি বিশ্বের বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী এবং স্বৈরাচারী আন্দোলন থেকে সংবাদমাধ্যম, সুশীল সমাজ গোষ্ঠী এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলি খুঁজে পেয়েছে।
সংখ্যালঘুদের (বিশেষ করে মুসলিম, দলিত এবং খ্রিস্টানদের) গণপিটুনি ও অপরাধীকরণ করা।
কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং বাসস্থান নিয়ে ধর্মীয় ও বর্ণ সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বৈষম্য করা।
মুসলমান এবং শ্রেণিগতভাবে পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের উপর পুলিশের অত্যাচার।
ধর্ম এবং বর্ণ ভিত্তিক বিভাজন তৈরি করা এবং আন্তঃধর্মীয় পরিবারের উপর আক্রমণ শানানো।
হিন্দু ছাড়া বাকি সকলের উপাসনালয়ে আক্রমণ, ধ্বংস এবং বন্ধ করে দেওয়া।
বিভিন্ন আন্দোলনের নেতানেত্রী, সাংবাদিকদের টার্গেট করা।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করা।
হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রভাবশালী তীব্র সমালোচকদের হত্যা করা।
সংখ্যালঘুদের, বিশেষ করে মুসলমানদের নিশানা করে নাগরিকত্ব আইন পরিবর্তন করা
‘বিদেশী’ আটক করে রাখার জন্য ‘ডিটেনসন ক্যাম্প’ তৈরি করা।
মত প্রকাশ এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে খর্ব করা।
আসাম এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরে গণহত্যা সংগঠিত করা।
চিত্র ১. ভারতে হিন্দু জাতি গঠনের পদক্ষেপ
সংঘ পরিবারের চাপ এবং কাজের প্রভাব নিয়ে আরেকটি চিত্র (ফিগার-২) তুলে ধরা হয়েছে রিপোর্টে। এখানে আরএসএস ঘনিষ্ঠ সংস্থাগুলির কিছু প্রশাসনিক এবং কাগজে কলমে আর্থিক অনিয়মের বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে।
রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, হিন্দু স্বয়ংসেবক সংঘ (HSS) নাম নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (RSS)। ২০২০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই সংগঠনের শাখা ছিল ২২২ টি। মোট ৩২ টি রাজ্য এবং ১৬৬ টি শহর জুড়ে তারা কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতি সপ্তাহে হিন্দু স্বয়ংসেবক সংঘের যুব এবং পারিবারিক বৈঠকে অংশ নিচ্ছে প্রায় ৮ হাজার ৮৮০ জন মানুষ। ২০১৯-২০ সালের হিন্দু স্বয়ংসেবক সংঘের বার্ষিক প্রতিবেদন (Annual Report) এবং ট্যাক্স রেকর্ড থেকে এই তথ্য উঠে এসেছে।
With Inputs - NewsClick
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন