জাতীয় শিক্ষানীতি প্রস্তুত হয় একটি দেশে শিক্ষার অভিমুখ কি হবে তা নির্ধারিত করার জন্য। শিক্ষানীতি থেকে এ কথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে দেশের সরকার দেশ ও দেশবাসীর অগ্রগতির জন্য কোন পথ প্রদর্শন করবে। ২০২০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতির প্রতিটি ছত্রেই এই মার্গ সুস্পষ্টরূপে উপস্থাপিত করেছে কস্তুরীরঙ্গন কমিশন এবং তাকে গ্রহণের মধ্যে দিয়ে ভারতবর্ষের বর্তমান সরকার। এই লেখার মধ্যে দিয়ে আমি সেই অভিমুখেরই কয়েকটি দিক তুলে ধরব।
প্রথমত, এই শিক্ষানীতি রচিত হয়েছে জ্ঞানের সমৃদ্ধির উদ্দেশ্য নিয়ে নয়, বরং দক্ষতা অর্জন, অর্থাৎ “skill development“ রয়েছে এর কেন্দ্রবিন্দুতে। তাই উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে যে পরিবর্তনগুলি প্রস্তাব করা হয়েছে তার বিভিন্ন অধ্যায়ে মৌলিক গবেষণার গুরুত্ব কম, বরং অনেক বেশী গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে “দক্ষতা অর্জন” বা “skill development“ এর উপর। সুতরাং বিশ্বের জ্ঞান ভাণ্ডারে নতুন সংযোজন নয়, আগামী দিনে বিভিন্ন স্তরে দক্ষ শ্রমিক তৈরী হল এই শিক্ষা নীতির উদ্দেশ্য। অবশ্য এটা নতুন কিছু নয়। যাঁরা গত কয়েক বছরে ভারতবর্ষের উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন তাঁদের প্রত্যেকেরই বিশ্লেষণ অনুযায়ী এই ঘটনা অবশ্যম্ভাবী ছিল। মূলত আমেরিকা ও অন্যান্য কয়েকটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার মাত্র কয়েকটি চিন্তাধারার অন্ধ অনুকরণ করে একটা শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরীর চেষ্টা গত কয়েক বছর ধরেই চলেছে যা ভারতবর্ষের বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন। এই শিক্ষানীতিতে সেটাই প্রকট হয়েছে।
এটা অবশ্যই স্বীকার্য যে দেশের অগ্রগতিতে বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষ কর্মীর বিশেষ ভূমিকা আছে। কিন্তু একই সাথে কোন বিষয়ের মূলে গিয়ে শিক্ষা লাভের সুযোগ না থাকলে, সেই বিষয়ে মৌলিক গবেষণায় অগ্রগতি একেবারেই অসম্ভব। মৌলিক গবেষণা লব্ধ যে জ্ঞান তা প্রয়োগের মাধ্যমেই দক্ষতা অর্জন সম্ভব। সুতরাং জ্ঞানের অধ্যয়ন এবং দক্ষতা অর্জনের জন্য অধ্যবসায় হাত ধরাধরি করে চলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান দুটি কাজ – “discovery and dissemination of knowledge”। অথচ জাতীয় শিক্ষানীতিতে কস্তুরীরঙ্গন কমিটির সুপারিশ হল দেশে তিন ধরণের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব বজায় রাখা – “research-intensive university“ বা RU, “teaching university“ বা TU এবং “degree granting college”। অর্থাৎ শিক্ষাপ্রদান ও গবেষণার জন্য পৃথক পৃথক উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরী করা। এই ব্যবস্থা কতটা বাস্তব সম্মত সে বিষয়ে সন্দেহ তো আছেই। পাশাপাশি, এইভাবে শিক্ষাপ্রদান ও গবেষণাকে বিচ্ছিন্ন করলে ছাত্র যেমন বঞ্চিত হবে সার্বিক শিক্ষার সুযোগ থেকে, তেমনি শিক্ষকের নিজস্ব অগ্রগতিও ব্যাহত হবে। সবচেয়ে বড় কথা হল মৌলিক গবেষণাকে শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জন থেকে বিচ্ছিন্ন করলে বা গুরুত্ব কম দিলে ভারতবর্ষের “আত্মনির্ভরতা” কখনোই সম্ভব হবে না, বরং আগামীদিনগুলিতেও ভারতবর্ষ বিজ্ঞান প্রযুক্তির গবেষণার ক্ষেত্রে আরও অনেক বেশী উন্নত দেশগুলির মুখাপেক্ষী হয়ে পড়বে।
আর একটি প্রস্তাব হল তিন বা চার বছরের ডিগ্রী কোর্স চলাকালীন বিভিন্ন স্তরে ছাত্রদের সেই কোর্স ত্যাগ করে ডিপ্লোমা বা অ্যাডভান্সড ডিপ্লোমা নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া। এই প্রস্তাবটি পেশাভিত্তিক বিষয়গুলি, যেমন ইঞ্জিনীয়ারিং শিক্ষার জন্য প্রয়োগ করা সম্ভবপর হলেও, অন্যান্য বিষয়, যেমন পদার্থবিদ্যা, রসায়ন বা ইতিহাস শিক্ষার ক্ষেত্রে কিভাবে প্রয়োগ হবে তা পরিষ্কার নয়। যে বিষয়গুলিতে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা একটা স্তর পর্যন্ত না পৌঁছালে পরবর্তীকালে এগোনো অসম্ভব – সেই বিষয়গুলিতে অগভীর বা ভাসা ভাসা জ্ঞান নিয়ে ছাত্রছাত্রীরা পরবর্তী জীবনে সমাজে কি অবদান রাখতে পারবে? সবচেয়ে বড় কথা হল এইরকম ডিপ্লোমা বা অ্যাডভান্সড ডিপ্লোমা নিয়ে পাশ করা ছাত্রছাত্রীরা কি ধরণের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের সুযোগ পেতে পারে তার কোন উল্লেখ এই শিক্ষানীতিতে নেই। যেমন পদার্থবিদ্যায় ডিপ্লোমা প্রাপ্ত একটি ছাত্র কর্মসংস্থানের কি সুযোগ পেতে পারে তার কোন বিশ্লেষণ করা হয়েছে কি? অর্থাৎ, আবার একই জায়গায় ফিরে আসছি – জাতীয় শিক্ষানীতিতে এই ধরণের সুপারিশের মাধ্যমে দক্ষতা-ভিত্তিক পেশাদারী বা বৃত্তিমূলক বিষয়গুলির উপর বেশী গুরুত্ব দেওয়ার হয়েছে এবং মূল (fundamental) ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি অবহেলিতই থেকে গেছে। ছাত্রছাত্রীদের এই বিষয়গুলিতে অন্তত স্নাতক স্তর পর্যন্ত সাধারণ জ্ঞান অর্জন করতে উৎসাহিত করার পরিবর্তে তাদের মাঝপথে পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়ার একটি রাস্তা তৈরী করা হল যা কখনোই একটি শিক্ষানীতির অভিপ্রায় হতে পারে না। তদুপরি পেশাদারী, বৃত্তিমূলক বা যে কোন বিষয় হোক, এইরকম একটা বিষয়সূচী কিভাবে তৈরী করা যাবে যাতে মাঝপথে ডিপ্লোমা প্রদানের মত শিক্ষা একজন ছাত্র বা ছাত্রী অর্জন করবে? বর্তমান সেমিস্টার ব্যবস্থায় এই কাজ করাও যথেষ্ট কঠিন।
২০২০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতির বিভিন্ন অধ্যায়ে আগামী দিনে শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে “artificial intelligence”, “machine learning” –ইত্যাদি কম্প্যুটার সায়েন্সের মাত্র কয়েকটি শাখার উল্লেখ করা হয়েছে। অবশ্যই বিশ্বায়নের যুগে তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতির দরুণ এই মুহূর্তে artificial intelligence, machine learning বা data science –এ দক্ষতার প্রয়োজনীয়তা আছে। কিন্তু গত পাঁচ দশকে কম্প্যুটার সায়েন্স বা তথ্য প্রযুক্তির ক্ষেত্রে যে গতিতে পরিবর্তন ঘটেছে তাতে আগামী কিছুদিনের মধ্যে উপরোক্ত শাখাগুলির থেকে অন্য কোন শাখার অধিকতর বিস্তার ঘটতে পারে বা অন্য কোন নতুন প্রযুক্তি সারা বিশ্বে অগ্রাধিকার পেতে পারে। সেক্ষেত্রে শিক্ষানীতির এই অংশগুলি গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে। সামগ্রিকভাবে কম্প্যুটার সায়েন্স বা তথ্যপ্রযুক্তির উপর গুরুত্ব না দিয়ে তার অন্তর্ভুক্ত দু-তিনটি বিষয়ের বিশেষ উল্লেখ নীতিপ্রণেতাদের অদূরদর্শিতারই পরিচায়ক। তাছাড়া যে শিক্ষানীতি দেশের সামগ্রিক শিক্ষার বিস্তারের জন্য রচিত হচ্ছে, সেখানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অন্যান্য ধারাকে উপেক্ষা করে কম্প্যুটার সায়েন্স বা তথ্য প্রযুক্তির অন্তর্ভুক্ত বিশেষ দু-তিনটি বিষয়ের বারংবার উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ অন্যান্য ক্ষেত্র, যেমন মহাকাশ গবেষণা বা ঔষধ-সম্পর্কিত গবেষণা যেখানে ভারতবর্ষ ইতিমধ্যেই স্বনির্ভরতার পরিচয় রেখেছে, সেইগুলির কোন উল্লেখ এই শিক্ষা নীতিতে নেই। অতীতের শিক্ষানীতিগুলিতে ভারতবর্ষের বিশেষ সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে মাথায় রেখে কৃষিভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণার ওপর বেশী গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। বর্তমান শিক্ষানীতিতে কৃষিকে বৃত্তিমূলক শিক্ষার অংশ হিসাবে উল্লেখ করা হলেও, অগ্রাধিকার দেওয়া হয়নি।
বর্তমানে সারা ভারতবর্ষ জুড়ে অনলাইন এডুকেশনের উপর জোর দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষানীতির বিভিন্ন অধ্যায়েও এই কথাই একাধিকবার তুলে ধরা হয়েছে। দ্বাদশ অধ্যায়ে সুপারিশ করা হয়েছে “ODL and online education provide a natural path to increase access to high-quality higher education”। অনলাইন এডুকেশন অর্থাৎ ইন্টারনেট, স্মার্ট ফোন ইত্যাদির মাধ্যমে ভিডিও লেকচার বা অন্যান্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে যে শিক্ষা তা কখনোই স্বাভাবিক শ্রেণীকক্ষ-ভিত্তিক শিক্ষার বিকল্প হতে পারে না। এই ধরণের মাধ্যম শ্রেণীকক্ষ-ভিত্তিক শিক্ষাকে আরও জোরদার করার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে, তাকে বাদ দিয়ে নয়। তাছাড়া আমাদের দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে অনলাইন এডুকেশনের উপর জোর দেওয়া মানে দেশের এক বিশাল অংশের ছাত্রছাত্রীকে শিক্ষার সমান সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা। ২০১৪ সালের ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভের এক রিপোর্ট অনুযায়ী দেশের মাত্র ২৭ শতাংশ পরিবারের কোন না কোন সদস্য ইন্টারনেট ব্যবহার করার সুযোগ পান। তাছাড়াও এদের মধ্যেও মাত্র ৪৭ শতাংশ পরিবারের কাছে অনলাইনে পড়াশোনা করার জন্য কোন উপযুক্ত যন্ত্র, যেমন স্মার্টফোন, কম্প্যুটার ইত্যাদি আছে। সুতরাং অনলাইন লেখাপড়া করার মত সুযোগ আমাদের দেশে আনুমানিক ১২.৫% পরিবারের ছেলেমেয়েদের আছে। বাকিরা এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত। ২০২০ সালেও এই পরিস্থিতির এমন কিছু উন্নতি ঘটেছে এরকম কোন প্রমাণ নেই।
এই বছর স্বাধীনতা দিবসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ১০০০ দিনের মধ্যে দেশের প্রতিটি গ্রামে অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ইন্টারনেট পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। যদি ধরেও নেওয়া যায় যে সরকারের পক্ষ থেকে এই কাজ সম্পন্ন করা হবে, প্রতিটি পরিবার এবং সেই পরিবারের পড়ুয়ারা এই পরিষেবার সুযোগ গ্রহণ করতে পারবেন? অর্থনৈতিক কারণ প্রধানতম বাধা হয়ে দাঁড়াবে। অন্য কারণ, যেমন এই ধরণের শিক্ষার মাধ্যমে স্বচ্ছন্দ বোধ না করাও শিক্ষার্থীদের এই ধরণের পড়াশোনা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে। অথচ, সমগ্র শিক্ষা নীতিতে এই বিষয়গুলি অনুচ্চারিত রেখেই বারবার অনলাইন বা ডিস্ট্যান্ট এডুকেশনের উপর জোর দেওয়া এবং একই সাথে ডিজিট্যাল লাইব্রেরী ইত্যাদি বিভিন্ন ধরণের বৈদ্যুতিন মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার সুপারিশ এক অংশের ছাত্র ছাত্রীদের কিছুটা সুযোগ প্রদান করলেও, কার্যত এক বিরাট অংশের ছাত্রছাত্রীকে এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত রাখবে।
আন্তর্জাতিকীকরণের নাম করে বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে ভারতবর্ষে ক্যাম্পাস তৈরীর জন্য ছাড়পত্র দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়গুলি উৎসাহিত হতেই পারে, কারণ বর্তমানে এদের অধিকাংশই ছাত্রের অভাবে বিপন্ন বোধ করছে। কিন্তু বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় মানেই শিক্ষার উৎকর্ষতা বজায় থাকবে এটা ভাবার কোন কারণ নেই। আমাদের দেশের সরকারী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি পরিকাঠামো এবং অর্থের অভাবে নিয়ত ধুঁকছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত এই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি থেকেই দেশের সেরা ছাত্ররা পাশ করে দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন উচ্চপদে আসীন হয়ে তাদের মেধা ও দক্ষতার পরিচয় রাখছে। দেশের এই সরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি থেকেই যে ছাত্র বা ছাত্রী তৈরী হচ্ছে তাদের একটা বড় অংশ পরবর্তীকালে তথাকথিত “Ivy League Universities”গুলিতে (আমেরিকার খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়গুলি যার উল্লেখ এই শিক্ষানীতিতে বহুবার করা হয়েছে) স্নাতকোত্তর গবেষণা করতে যাচ্ছে। সুতরাং এই সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে পরিকাঠামো ও অর্থের যোগানের দিক দিয়ে আন্তর্জাতিকমানে পৌঁছে দেওয়ার প্রচেষ্টাই শিক্ষানীতির মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত ছিল। অথচ বেসরকারীকরণের দিকে বেশী ঝুঁকে এবং একটা অহেতুক ইঁদুর দৌড়ের র্যাঙ্কিং সিস্টেমের মধ্যে সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলিকে ঢুকিয়ে দিয়ে তাদের অস্তিত্বকে সংকটের মধ্যে ফেলে দেওয়া হচ্ছে।
শিক্ষানীতির একেবারে শেষভাগে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির পরিচালন ব্যবস্থা নিয়ে বেশ কয়েকটি সুপারিশ করা হয়েছে। শিক্ষা ভারতীয় সংবিধানের যুগ্মতালিকায় থাকলেও এই পর্বে এসে রাজ্যগুলির কোনরকম ভূমিকারই উল্লেখ করা হয় নি। বরং ন্যাশনাল হায়ার এডুকেশন রেগুলেটরী অথরিটি নামে একটি সংস্থা তৈরী করে সমস্ত ধরণের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেই সংস্থার নির্দেশিকা মানতে বাধ্য থাকবে এইরকমই উল্লেখ করা হয়েছে। একটি বিশেষ ধাঁচে সমস্ত পরিচালন ব্যবস্থাকে বেঁধে ফেলার চেষ্টা হয়েছে যা বর্তমানে কেন্দ্র বা রাজ্যগুলির কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যমান নয়। আই আই টি, আই আই এম-এর মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির পরিচালন ব্যবস্থার অনুকরণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পরিচালন ব্যবস্থা তৈরী করা যেমন স্বশাসনের বিরোধী, তেমনি অবাস্তব ও অকার্যকর। বিশেষ করে আই আই টি বা আই আই এম-এর পরিচালন ব্যবস্থার মধ্যে স্বচ্ছতা কতটা বা স্বশাসনের অধিকার কতটা বজায় থাকে সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। বিগত বছরগুলিতে অনেকগুলি ঘটনা এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে অবিরত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের দিকেই ইঙ্গিত দেয়।
ভারতবর্ষের শিক্ষাব্যবস্থায় ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বিভাজন স্বাধীনতার সাত দশক পরেও রয়েছে। বরং বিগত কয়েক বছরে শিক্ষার দায়ভার সরকার ক্রমাগত নিজের উপর থেকে বেসরকারী হাতে তুলে দেওয়ায় এই বিভাজন আরও অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২০ সালের শিক্ষানীতিতে এই বিভাজন কমানোর কোন দিকনির্দেশ তো নেই, বরং যে সুপারিশগুলি করা হয়েছে তার মধ্য দিয়ে এই বিভাজন আরও অনেকগুণ বৃদ্ধি পাবে।
শিক্ষানীতির বাইশতম অধ্যায়ে এসে ভারতীয় সংস্কৃতিকে রক্ষা করার জন্য বেশ কয়েকটি সুপারিশ করা হয়েছে। এই অংশে এবং অন্য কয়েকটি অধ্যায়ে ভারতীয় সংস্কৃতি, বা ভারতীয় ভাষা বলতে যেগুলি উল্লখ করা হয়েছে তার মধ্যে দেশের এক বিরাট অংশের সংস্কৃতি বা ভাষা বাদ থেকে গেছে। এই অনুল্লেখ কখনোই আকস্মিক নয়, বরং বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের অঙ্গুলিহেলনেই ঘটেছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ থাকেনা। বিগত কয়েক বছরে বহুত্বকে অবহেলা করে সংখ্যাগুরুর যে প্রাধান্য ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা চলছে এবং যেভাবে মানবাধিকার বারবার লঙ্ঘিত হয়েছে এই সুপারিশগুলি তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই ধরণের সুপারিশ শিক্ষা ক্ষেত্রে বিভাজন নিয়ে আসবে এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতিকেও ব্যাহত করবে। তবে যেহেতু এই বিষয়টি দেশের সার্বিক উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত, এর সবিশেষ আলোচনা আলাদাভাবে হওয়া উচিত।
আরও বেশ কয়েকটি বিষয় এই শিক্ষানীতিতে রয়েছে যা গভীর সংশয়ের উদ্রেক করে বা শিক্ষার সংকোচনের দিকে নির্দেশ করে। অনেকেই সেইসমস্ত বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করেছেন। এই স্বল্প পরিসরে সবকটি বিষয় তুলে ধরা সম্ভব হল না। তবে ভবিষ্যতে এই শিক্ষার সংকোচনের বিরুদ্ধে এবং বিভাজনের বিরুদ্ধে আমাদের সরব থাকতে হবে।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন