ইভো মোরালেস - এভাবেও ফিরে আসা যায়

ইভো মোরালেস
ইভো মোরালেস ফাইল ছবি ফেসবুক পেজ থেকে সংগৃহীত
Published on

একদম ভোরে দেখা করার আশ্বাস দিয়েছিলেন ভদ্রলোক, তাই সময় মেনেই ৫টা ৪৫ নাগাদ কোচাবাম্বার কোকো উৎপাদকদের ফেডারেশনের অফিসের সামনে পৌঁছে গিয়েছিলেন ডঃ স্ভেন হার্টেন।

ডঃ হার্টেন লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্স থেকে ডক্টরেট, তিনি পেরুতে বিশ্বব্যাঙ্কের হয়ে কাজ করেছেন, বর্তমানে ‘জার্মান ইন্সটিটিউট অফ ডেভলপমেন্ট ইভ্যালুইয়েশন’-এর গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন। আজ এখানে তাঁর আসা অবশ্য ঠিক পেশাদারি কারণে নয়। ঠিক সেই কারণেই একটু হতাশও হয়ে পড়েছিলেন হার্টেন, ‘নিউ ইয়র্কস টাইম’-এর মতো ভারী কাগজের দুই সাংবাদিককেও তিনি দেখতে পেয়েছেন, তাঁদেরও নিশ্চয়ই আজকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে, তাঁদের বাদ দিয়ে আজ যার সঙ্গে তিনি দেখা করতে এসেছেন তিনি কি আর সময় দেবেন?

ট্রেড ইউনিয়ন অফিস থেকে যিনি একদম কাঁটায় কাঁটায় সময় মিলিয়ে বেরলেন, তিনি কিন্তু গাড়িতে উঠতে উঠতে সাংবাদিকদের আগে হাস্যমুখে হার্টেনকেই ডেকে নিলেন। বোঝা গেল, কথা দেওয়ার কথা তাঁর মাথায় আছে। নিজেই ড্রাইভ করতে করতে পাহাড়ি পথে গাড়ি ছোটালেন হাসিখুশি মানুষটি – তিনি, বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট, ইভো মোরালেস। মাঝে টুক-টাক কথাবার্তা নিউ ইয়র্কস টাইমের সাংবাদিকটি বিশ্বরাজনীতি নিয়ে কঠিন কঠিন প্রশ্ন করতেই বেশি আগ্রহী – তার যথাযথ উত্তর দিলেও বোঝা গেল ভদ্রলোক হার্টেনের ব্যক্তিগত হালকা মাপের কথাই বেশি পছন্দ করছেন। ছোটবেলার কথা উঠল, ইভো বললেন তাঁর বাবা ছিলেন দরিদ্র কৃষক, তবে ছেলেকে পড়াশোনা করানোর প্রতি তাঁর চিরকালই আগ্রহ ছিল। তবে একাগ্র ভাবে পড়াশোনা করার আর্থিক সঙ্গতি তাঁর কোনকালই ছিল না, লামা পালন করা থেকে ক্ষেতের কাজ – এতেই অধিক সময় ব্যয় করতে হত। বিনোদন বলতে শুধু ছিল ফুটবল। দক্ষিণ আমেরিকার বহু ছেলের মতোই মোরালেস ছিলেন ফুটবল ভক্ত। লামা চরানোর ফাঁকে ফাঁকেই ছেঁড়াখোড়া চামড়ার বল নিয়েই কসরত করতেন তিনি। পাঁচ বছর বয়সে ইসালওই গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হয়েছিলে, এরপর একে একে মাধ্যমিক স্কুল আর কলেজের পড়াশোনাও শেষ করেন। পড়াশোনায় ভালো ছাত্র হলেও উচ্চশিক্ষার শেষে ডিগ্রি পেতে তখনকার বলিভিয়ায় যে পয়সা লাগত তা দেওয়ার ক্ষমতা তার পরিবারের ছিল না, তাই পরীক্ষায় পাস করেও ডিগ্রি পাননি তিনি।

এরই মধ্যে মাঝপথে খাওয়ার দোকান দেখে গাড়ি থামালেন ইভো। খেতে খেতে কথাবার্তা চলতে লাগল, মাঝে দোকানের মালিকের সঙ্গে একচোট ঝগড়া। সে কিছুতেই টাকা নেবে না, ইভো মোরালেস শুধু প্রেসিডেন্ট না – কোচাবাম্বার ঘরের ছেলে আর মোরালেসও ছাড়বেন না। টাকা মিটিয়ে আবার গাড়ি ছুটল, তার সঙ্গে ইভো বলতে লাগলেন নিজের জীবনের গল্প। আইসক্রিম বেচা, ট্রাম্পেট বাজানো, ইঁট বওয়া সব কাজই করেছেন তিনি। রাজনীতি নিয়ে প্রথম দিকে তেমন মাথা ঘামাতেন না, তাঁর পরিবারের লোকেদের দিন চালাতেই সময় কেটে যেত – রাজনীতি নিয়ে ভাবার সময় কই?

‘কবে থেকে মাথা ঘামাতে শুরু করেন ?’ – হার্টেনের প্রশ্নের উত্তরে ইভো জবাব দেন, তাঁর বয়স যখন বছর পনেরো তখন পারিবারিক তুতো ভাই মার্সিয়াল মোরালেস আয়ামার সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। মার্সিয়াল বলিভিয়াতে যখন চে সক্রিয় ছিলেন, তাঁর সংস্পর্শে এসেছিলেন – তখন থেকেই কমিউনিস্ট। বলিভিয়ায় খনি শ্রমিকদের মধ্যে তিনি কাজ করতেন, তিনিই ইভোকে প্রথম সমাজতন্ত্রের আদর্শের সঙ্গে পরিচয় ঘটান। আর পড়েছিলেন ফাউস্টো রেইনাগার ‘লা রেভোলিউসিওন ইন্ডিয়া’ – ক্যাথোলিক ধর্ম আর স্প্যানিশ সংস্কৃতির চাপে বলিভিয়ার আন্দিয়ান জনজাতি যে নিজের ভাষা-সংস্কৃতি ভুলে যেতে বসেছিল, তা ফেরত পাওয়া কতটা জরুরি এই বইটি থেকেই তিনি উপলব্ধি করেন।

ইভো দুই বছর সেনাবাহিনীতেও কাজ করেছেন। সেই সময় মার্কিন সমর্থিত সমরনায়করা কিভাবে দেশ চালাতেন, তা খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে তাঁর। ১৯৭৮ নাগাদ ইভো সৈনিকের পেশা ছেড়ে দিয়ে গ্রামে ফিরে আসেন। কিন্তু ‘এল নিনো’-র খরা তাঁদের গবাদি পশু থেকে ফসল সবই নষ্ট করে দিয়েছিল। নিজেদের গ্রাম ছেড়ে ইভোরা পাড়ি দেন কোচাবাম্বায়। এখানেই প্রথম কোকো চাষিদের ইউনিয়নে তিনি কাজ করতে শুরু করেন। কিন্তু এর পরেও হয়তো সক্রিয় রাজনীতিতে হয়তো তিনি আসতেন না, যদি না সমর শাসক লুই গার্সিয়া মেজার আমলে চোখের সামনে কোকো চাষিদের উপর নেমে আসা ভীষণ অত্যাচার তিনি নিজের চোখে না দেখতেন – যদি না চোখের সামনে সামান্য কারণে জীবন্ত এক চাষিকে সৈন্যবাহিনীর পুড়িয়ে দেওয়ার চিত্র তাঁর মাথায় না গাঁথা হয়ে থাকত।

আন্দিজ পাহাড়ের বাঁকে গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে কথাও চলতে লাগল আরও। ইভোর সব গল্পই ছোট ছোট সুখ-দুঃখের গল্প, নেতাদের বা আইডিওলগদের কাছ থেকে যে বিশাল উপাখ্যান মানুষ আসা করে – ইভো তার মধ্যে যেতে চাননা। কখনও কোকো চাষিদের সিন্ডিকেটের মিটিং-এর মাঝে ফুটবল খেলার গল্প, কখনও কোচাবাম্বার জল বেসরকারীকরণের প্রতিবাদ আন্দোলনের কাহিনী, কখনও বা দেশের প্রাকৃতিক গ্যাস বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে জোরালো সংগ্রামের কথা। ইভোর গল্পে তাঁর নিজের কথা কম, সাহসী কমরেডদের কথাই বেশি।

গল্প করতে করতেই গাড়ি গন্তব্যস্থলে এসে দাঁড়ালো। কোচাবাম্বার কোকো চাষিদের খোলা মিটিং বা আমপ্লিয়াদোস, আজ যেখানে ইভো অংশ নেবেন – এটাই তো তার রাজনীতির ভিত্তি। এইটা দেখতেই হার্টেন এসেছেন, যাঁদের সঙ্গে গল্প করছিলেন তাঁদের থেকে বিদায় নিয়ে মঞ্চে উঠে গেলেন ইভো। দর্শকাসনে বসতে না বসতেই হাতে কোকো পাতা দিয়ে তৈরি পানীয় এসে গেল। চুমুক দিতে দিতে মিটিং-এর কার্যাবলী দেখতে লাগলেন তিনি। রুশ বিপ্লব যখন হয়েছিল হার্টেনের জন্ম হয়নি। কিন্তু পেট্রোগ্রাদ সোভিয়েতে তিনি যদি উপস্থিত থাকতেন, তাহলে সেই পরিবেশের সঙ্গে সিন্ডিকেটের পরিবেশ তাঁর হয়তো আলাদা লাগত না। এ হল একেবারেই প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের অনুশীলন। একেকজন করে প্রতিনিধি উঠছেন, বক্তব্য রাখছেন তারপর নেমে যাচ্ছেন – প্রতিনিধি আসন থেকে উঠে আসছে সমর্থন বা বিরোধিতার আওয়াজ। এইরকম করতে করতে বেলা গড়াল। এবার আলোচনার পালা – প্রথমেই ইভো (হার্টেন লক্ষ্য করলেন, এখানকার কেউই ইভোকে ‘ইভো’ বলে সম্বোধন করছে না, মূলনিবাসীদের ইচ্চারণে ‘ইয়ু’ বলে ডাকছেন) কে কি বক্তব্য রেখেছেন এবং প্রধান বিরোধ কোন কোন জায়গায় সেগুলি স্পষ্ট করে দিলেন। এরপর আলোচনা চলতে লাগল, মাঝে মাঝে উত্তপ্ত ঝগড়ার পরিস্থিতিও হল, কিন্তু ইভো সবসময় এমন একটা সমাধানের পক্ষে মতামত নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন যেটা সবারই মনমত না। সব ক্ষেত্রে অবশ্য তাঁর মতও গ্রাহ্য হল না, তিনি প্রেসিডেন্ট হতে পারেন, সিন্ডিকেটের প্রধান সম্পাদক হতে পারেন, কিন্তু এখানে তিনি ‘ফার্স্ট এমং ইকুয়ালস’ মাত্র।

হার্টেন এখানেই শুনলেন ইভোর বিখ্যাত ক্যাচ ফ্রেজ - ‘এস্তা বিয়েন কম্পেনেরোস ?’ বা ‘ঠিক আছে তো, সাথী ?’ –এর ব্যবহার। যখনই দুটি সাংঘাতিক বিপরীত মতের সংঘাত হচ্ছে আলোচনার মাধ্যমে ইভো মাঝামাঝি একটা মতে আনার চেষ্টা করে তাঁর এই বিখ্যাত ব্যাক্যটি উচ্চারণ করছেন। প্রায় পাঁচটা নাগাদ সিন্ডিকেটের কাজ শেষ হল। ইভো সঙ্গী-সাথীদের সঙ্গে হালকা গল্প করছে – এঁরা তাঁর অনেক লড়াইয়ের সঙ্গী। হার্টেন সিন্ডিকেটের সাধারণ সদস্যদের অনেকের সঙ্গে গল্প শুরু করলেন। আয়ামারারা ভীষণ মিশুকে জনজাতি, সামাজিক মেলামেশা আর গল্পগুজব তাঁদের সমাজের প্রাণ। ইভোর টুকটাক অনেক গল্পই হার্টেন বের করলেন। এঁরা সবাই ইভোকে ভীষণ ভাবে ভরসা করেন দেখে হার্টেন একজন আমপ্লিয়াদোস প্রতিনিধিকে প্রশ্ন না করে পারলেন না, একজন মানুষকে তাঁরা এত ভরসা করেন কি করে? উত্তরে তিনি চলে গেলেন আন্দোলনের শুরুর দিনের কাহিনীতে।

তখন ১৯৮৯ সাল, ভিলা তুনারি হত্যাকান্ড, যেখানে ১১জন কোকো চাষিকে হত্যা করেছিল সেনাবাহিনী, তার মাত্র একবছর হয়েছে। এইগুলো নতুন কিছু নয়। আয়ামারা জনজাতি জানে চিরকালই তাঁদের সঙ্গে এইরকমই করা হয়েছে আর ভবিষ্যতেও হবে। কিন্তু অকুতভয় ইভো এগিয়ে এলেন প্রতিবাদে। ঐ দিনটি স্মরণ করার জন্য সভা করলেন, লড়াইয়ের ভরসা দিলেন, প্রতিশ্রুতি দিলেন এই লড়াই ছেড়ে তিনি যাবেন না। পরদিনই তাঁকে ধরে নিয়ে গেল সেনাবাহিনীর লোকেরা, অসম্ভব দৈহিক অত্যাচার করে দুর্গম পাহাড়ি জঙ্গলে ফেলে দিয়ে গেল তাঁকে। হাসতে হাসতে প্রতিনিধি জানালেন, ওরা ভেবেছিল ইয়ো ওখানেই মরে যাবেন। ওরা জানত না ইয়ো একবার কথা দিলে সেই কথা ভঙ্গ করেন না। ও যে কথা দিয়েছিল এই লড়াই ছেড়ে ও যাবে না, সেই ভীষণ প্রতিজ্ঞা বজায় রাখতেই ও শুধু ইচ্ছাশক্তিকে ভর করে বেঁচে ছিল ইউনিয়নের লোকেরা জঙ্গল খুঁজে ওকে উদ্ধার না করা পর্যন্ত। ইয়োকে ওরা যতই হটানোর চেষ্টা করুক, যে নিরুদ্দেশেই ফেলে আসুক - দিনের শেষে ইয়ো ঠিক ফিরে আসবেনই, আমাদের ভালোবেসে, আমাদের জন্য।

সূর্য তখন পশ্চিমে ঢলছে। লাউকা এনে গ্রামের সভাস্থল থেকে বেরিয়ে অস্তগামী সূর্যের দিকে তাকালেন ডঃ স্ভেন হার্টেন। তখন তাঁর পক্ষে জানা সম্ভবপর ছিল না, কিন্তু এই ঘটনার একদশক পড়ে ইভো আবার প্রমাণ দেবেন তাঁর উপর তাঁর কম্পেনারোসদের এই আস্থা কতটা সঙ্গত। প্রথমবার ওরা ইভোকে ফেলে দিয়ে এসেছিল গ্রামের বাইরে গভীর জঙ্গলে আর এইবার ওরা ইভোকে ফেলে দেবে দেশের বাইরে। কিন্তু মানুষের টানে, মানুষকে ভালোবেসে ইভো আবার ফিরে আসবেন রাজার মতো, ঠিক যেমন প্রথমবার ফিরেছিলেন। আজ ৯ নভেম্বর বলিভিয়ার ফিরলেন ইভো, আবারও প্রমাণ করে এভাবেও ফিরে আসা যায়।

স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in