২০১৮ সালে ‘মালাপ্পুরাম বিয়ন্ড টেলস’ (Malappuram Beyond Tales) নামে একটি তথ্যচিত্র তৈরি করেন কেরালার সাংবাদিক থপপিল শাহজাহান। যে তথ্যচিত্রটি পি জে অ্যান্টনি মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড জিতেছে।
এই তথ্যচিত্রের মূল বিষয় হল - কেরালার বহুত্ববাদী সমাজে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ভাতৃত্ববোধ।
কেরালার একটি অন্যতম জেলা হল মালাপ্পুরম, মুসলিম জনসংখ্যার দিক যে জেলাটি এখন রয়েছে সবার উপরে। এই জেলার হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে থাকা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা তুলে ধরা হয়েছে এই তথ্যচিত্রে। যেখানে বর্ণিত হয়েছে ৯ টি হৃদয়গ্রাহী কাহিনী।
২৩ মিনিটের তথ্যচিত্রটি শুরু হয়েছে তিরুরের থুনচান পারম্বুতে, যেখানে অবস্থিত আধুনিক মালায়ালামের জনক হিসাবে বিবেচিত থুনচাথু এজুথাচানের স্মৃতিসৌধ। বিজয়া দশমীর উৎসবের সময় এই জায়গায় আনা হয় হাজার হাজার শিশুকে। এই শিশুদের চিঠি লেখার পাঠ দিয়ে থাকেন বিশিষ্ট লেখকেরা। এসময় উৎসবের আমেজে মেতে ওঠে পুরো গ্রাম। শিশুদের দেওয়া হয় খাবার এবং দুধ। আর, এই পুরো উৎসবে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করে থাকেন মুসলিম যুবকেরা।
এ প্রসঙ্গে কবি কানেশ পুনুর বলেন, ‘আমি একজন অনুশীলনকারী মুসলিম। আর, এটি একটি হিন্দু প্রথা। কিন্তু আমরা মনে করি, এটি এমন একটি ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান, যেখানে শিশুদের চমৎকারভাবে লেখা শেখানোর পাঠ দেওয়া হয়।’
থুনচান পারম্বু (Thunchan Parambu) থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শোভা পারম্বুর (Shobha Parambu)। এখানে অবস্থিত শ্রী কুরুম্বা ভগবতী মন্দির (Sree Kurumba Bhagavathy temple)। আর, ঐতিহ্যগতভাবে এই মন্দিরের প্রধান পুরোহিত নিয়োগ করেন মুসলিম পরিবারের সদস্য বাপ্পু হাজি। তিনিই পুরোহিত নিয়োগ অনুষ্ঠানে নেতৃত্ব দেন এবং এই মন্দিরের পুরোহিত নিয়োগ করেন। এই প্রথা আজও অব্যাহত রয়েছে। তথ্যচিত্রে সেকথা তুলে ধরেছেন মন্দিরের পুরোহিত রাজীব। তিনি জানান, কীভাবে তাঁর বাবাকে তৎকালীন বাপ্পু হাজী এই পদে নিযুক্ত করেছিলেন এবং তাঁর বাবার মেয়াদের পরে তাঁকে নিয়োগ দিয়েছেন বর্তমান বাপ্পু হাজী।
তথ্যচিত্রে, মালাপ্পুরমের আরেকটি কাহিনী হল থিরুনাভায়ার (Thirunavaya) পদ্ম চাষের ক্ষেত নিয়ে। এখানে পদ্ম চাষ করেন মুসলিম কৃষকেরা। এবং, তা বিক্রি করা হয় প্রখ্যাত গুরুভায়ুর শ্রীকৃষ্ণ স্বামী মন্দিরসহ স্থানীয় মন্দিরগুলিতে। মন্দিরের পুরোহিতরা জানান, শুধুমাত্র পুজোর জন্য বাজারের থেকে অনেক কম দামে ফুল বিক্রি করে থাকেন মুসলিম কৃষকেরা।
ভ্যালানচেরি মুন্নাক্কাল জুমা মসজিদের (Valancherry Moonnakkal Juma Masjid) সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চিত্র ফুটে উঠেছে এই তথ্যচিত্রে। যা দীর্ঘ ২০ বছরের পুরানো। জানা গেছে, প্রতি সপ্তাহে মুন্নাক্কাল জুমা মসজিদের কাছে বসবাসকারী মানুষদের বিনামূল্যের রেশন দেওয়া হয়। আর, তা হিন্দু–মুসলমান, সকলকেই সমানভবে দেওয়া হয়। সকলেই এই রেশন পেতে মসজিদে আসেন।
এরপরেই, এই তথ্যচিত্রে তুলে ধরা হয়েছে কোট্টক্কলের পালাপুরা জুমা মসজিদের (Palappura Juma Masjid) কাহিনী। কারণ, এই মসজিদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ ‘মিম্বর’ নির্মাণের পুরো খরচ বহন করেছেন কোট্টক্কল আর্য বৈদ্য সালার প্রতিষ্ঠাতা বিএস ওয়ারিয়ার (BS Warrier)। আর, এই ‘মিম্বর’ নির্মাণের ধারণা পেতে তিনি গিয়েছিলেন বিখ্যাত মুসলিম তীর্থস্থান পোনানিতে।
তিরুরে অবস্থিত প্রখ্যাত সুফি ইয়াকুব থাঙ্গালের (Yakub Thangal) কবর এবং মাজার। মন্দিরের পাশাপাশি এই মাজারে যান হাজার হাজার হিন্দু পুরুষ ও মহিলারাও। মন্দিরে প্রার্থনার সময় তাঁরা যে নীলাবিলাক্কু (একটি হিন্দু ঐতিহ্যবাহী প্রদীপ) জ্বালান, সেই একই প্রদীপ তাঁরা জ্বালাতে আসেন এই মাজারে। শুধু তাই নয়, এই মাজারের কাছে উৎসবেরও আয়োজন করে থাকে স্থানীয় মন্দির কর্তৃপক্ষ।
এরপরে, কাহিনীর সূত্র চলে যায় কাত্তিলঙ্গাদি বালাগোকুলামে (Kattilangadi Balagokulam)। যেখানে কৃষ্ণ জয়ন্তী উৎসবের সময় শোভা যাত্রার আয়োজন করে থাকেন ভাসমান ইকবাল নামে এক মুসলিম।
একইভাবে, মুনিউর ভগবতী মন্দিরে আয়োজিত হয় এক উৎসবের। স্থানীয় ভাষায় যাকে বলা হয় ‘কালিয়াত্তকাভু’ (Kaliyattakavu)। আর, মন্দিরে গিয়ে এই অনুষ্ঠানের সূচনা করেন মুসলিম ধর্মগুরু মাম্বুরাম থাঙ্গাল (Mamburam Thangal)।
তথ্যচিত্রে শেষ গল্পটি হল পেরিন্থালমান্না টাউন জুমা মসজিদ (Perinthalmanna Town Juma Masjid) নিয়ে। প্রতি রমজান মাসে উপবাসের সময় এই মসজিদে আসেন মুসলিমরা। সন্ধ্যার সময় উপবাস ভেঙে ‘ইফতার’ করেন। আর, এই সময় আনন্দ প্রকাশ করতে কাদিনা বেদি (এক ধরনের আতশবাজি) ফাটিয়ে দিতেন পিরিয়ানী নামে এক হিন্দু ব্যক্তি। মূলত, এই আতশবাজিগুলি ঐতিহ্যগতভাবে হিন্দু মন্দিরগুলিতে ফাটানো হয় এবং তা আনা হয় অঙ্গদিপুরম মন্দির থেকে। কিন্তু পিরিয়ানীর মৃত্যুর পর এই প্রথা বন্ধ হয়ে যায়।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন