ইচ্ছাকৃতভাবে প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থাকে দুর্বল করছে রাজ্য সরকার - ৭ হাজার স্কুল উধাও প্রসঙ্গে ABPTA

ABPTA সাধারণ সম্পাদক মোহন দাস পণ্ডিত বলেন, সরকারের ভুল নীতির জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আজ এই বেহাল অবস্থা। সব ইচ্ছাকৃত। স্কুল না থাকলে শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে না। সরকারের টাকা বেঁচে যাবে।
রাজ্যে ১০ বছরে উধাও ৭ হাজারের বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয়
রাজ্যে ১০ বছরে উধাও ৭ হাজারের বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয়প্রতীকী ছবি
Published on

‘রাজ্যের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে ইচ্ছাকৃতভাবে দুর্বল করে দিচ্ছে রাজ্য সরকার’। রাজ্যের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার ভয়াবহ অবস্থা প্রসঙ্গে বুধবার পিপলস রিপোর্টারের প্রতিনিধিকে একথা জানালেন অল বেঙ্গল প্রাইমারি টিচার্স অ্যাসোসিয়শনের (এবিপিটিএ) সাধারণ সম্পাদক মোহন দাস পণ্ডিত।

গত দশ বছরে রাজ্যে প্রায় ৭ হাজার প্রাথমিক স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়া সংক্রান্ত সংবাদ এদিনই বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এর কারণ জানতে চাইলে মোহন দাস পণ্ডিত বলেন, সরকারের ভুল নীতির জন্য আজ এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

রাজ্যের তৃণমূল সরকারের সদিচ্ছার অভাবের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, "এটা পূর্ব পরিকল্পিত। ২০১২ সালে অভীক মজুমদারের নেতৃত্বে প্রাথমিকের বইগুলো পাল্টে দেওয়া হলো। অতীতে বিষয়ভিত্তিক বই ছিল। সেটাকে ‘আমার বই’ বলে একটা বইয়ে রূপান্তরিত করলো। ফলে বিষয়ভিত্তিক রইলো না। বইয়ের ভার লাঘব করার নাম করে বিষয়বস্তুর সরলীকরণ করা হলো অর্থাৎ ছোট করে দেওয়া হলো। তখন থেকেই ছাত্র-ছাত্রীরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বিমুখ হওয়া শুরু করলো। তাদের অভিভাবকরা দেখল যে বেসরকারি বিদ্যালয়ে বিষয়ভিত্তিক অনেকগুলো বই আছে। আর সরকারি বিদ্যালয় অবৈজ্ঞানিকভাবে সব বিষয়কে এক জায়গায় এনে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর জন্য একটাই বই ‘আমার বই’ চালু করলো। তখনই অভিভাবকদের একটা বড় অংশ সরকারি বিদ্যালয়ের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। যাদের একটু পয়সা আছে তাঁরা ভাবলো সরকারি বিদ্যালয়ে পড়িয়ে লাভ নেই।"

রাজ্যের বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষকদের শূন্যপদ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "দীর্ঘদিন ধরে অনেক বিদ্যালয়ে কোনও শিক্ষক নেই। শিক্ষক নিয়োগ যে হচ্ছে সেটা সামঞ্জস্যপূর্ণ না। অর্থাৎ যে বিদ্যালয়ে দরকার নেই সেখানে শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে, আর যেখানে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা অনেক বেশি সেখানে শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে না। ফলে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত ঠিক থাকছে না।"

শিক্ষার পরিকাঠামোকেও দায়ী করেছেন ABPTA সম্পাদক। তিনি বলেন, "পরিকাঠামোর জন্যও অনেকে বেসরকারি বিদ্যালয়ের দিকে ঝুঁকছে। আজকালকার দিনে পরিকাঠামো খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বিদ্যালয়ের বিল্ডিং ভালো হতে হবে, চেয়ার-টেবিল থাকবে, শিক্ষণের উপযুক্ত উপকরণ থাকবে, তবেই তো ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আকর্ষিত হয়ে আসবে। সরকারি বিদ্যালয়ে এই জায়গাটা অবহেলিত হচ্ছে। ফলে একটা অংশের ছাত্র-ছাত্রী উৎসাহ হারিয়ে বেসরকারি বিদ্যালয়ের দিকে চলে যাচ্ছে।"

মোহন বাবুর আরও অভিযোগ, ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া অনেক বিদ্যালয় এখনও টাকা পায়নি। তিনি বলেন, "আমফান ঝড়ে বহু বিদ্যালয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনা, উত্তর ২৪ পরগনা, পূর্ব মেদিনীপুরের একাধিক ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্যালয় এখনো ক্ষতিপূরণের টাকা পায়নি। অথচ যেখানে ততটা ক্ষতি হয়নি সেখানের স্কুল টাকা পেয়ে গেছে।"

শিক্ষকদের শিক্ষাদানের পরিবর্তে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। তিনি বলেন, "শিক্ষকদের জনগণনা, ভোটের কাজে নিযুক্ত রাখা হচ্ছে। শুধু ভোটের দিনে ডিউটি নয়, প্রায় গোটা বছরই ভোট সংক্রান্ত নানা রকম কাজ থাকে। ভোটার তালিকায় নাম তোলা, ভুল সংশোধন করা - এই সমস্ত কাজই শিক্ষকদের দিয়ে করানো হয়। তাই খাতায় কলমে বিদ্যালয়ে শিক্ষক থাকলেও সেই শিক্ষক এই সমস্ত কাজের জন্য বিদ্যালয়ে আসতে পারছেন না। যদি ৭২ হাজার বুথ থাকে রাজ্যে, প্রতি বুথে একজন করে শিক্ষককে অধিকাংশ সময়ই এই কাজগুলোতে নিযুক্ত রাখা হয়। অর্থাৎ কয়েক হাজার শিক্ষক গোটা বছরই ভোটের ডিউটি করে যাচ্ছেন। অথচ খাতায় কলমে লেখা আছে তাঁরা শিক্ষক। ফলে ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষকদের কাছে পাচ্ছে না।"

বর্তমান পরিস্থিতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ২৩ মাস টানা স্কুল বন্ধ ছিল অথচ বেসরকারি স্কুলগুলো খোলা ছিল। এরপর অপরিকল্পিতভাবে গরমের অজুহাতে ফের স্কুল বন্ধ করে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। এরকম হলে সরকারী স্কুলে ছাত্র আসবে কেন?

মিড ডে মিল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "মিড ডে মিলে মাথাপিছু ৪ টাকা ৯৭ পয়সা করে দেওয়া হচ্ছে। একটা ডিমের দাম ৬ টাকা। ১০০০ টাকা গ্যাসের দাম, ২০০ টাকা করে তেল। এরপর সবজি, মসলা তো আছেই। তাহলে ছাত্রছাত্রীদের কী পুষ্টি দেওয়া হবে? মিড ডে মিলের খাবারের জন্যও যে ছাত্রছাত্রীরা বিদ্যালয়ে আসবে, সেটাও তো আমরা ঠিকঠাক ভাবে দিতে পারছিনা, পাতলা ঝোল খাওয়াতে হচ্ছে। মিড ডে মিলটা যদি স্কুলে বসিয়ে খাওয়ানো হতো সেটা একরকম বিষয় ছিল, কিন্তু বর্তমানে স্কুল বন্ধ থাকার জন্য ড্রাই ফুড দিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যা বাড়ির সকলে ভাগ করে খাচ্ছে, ফলে ছাত্রছাত্রীরা পুষ্টি পাচ্ছে না। এই সমস্ত কারণের জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আজ এই বেহাল অবস্থা। সব ইচ্ছাকৃত। স্কুল না থাকলে শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে না। সরকারের টাকা বেঁচে যাবে।"

আপ ও কেরল সরকারের প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, দিল্লির আপ সরকার শিক্ষা ব্যবস্থার খোলনলচে পাল্টে দিয়েছে। সরকারী বিদ্যালয়গুলির দারুণ উন্নতি করেছে। কেরল সরকারও একই পথে হাঁটছে। ফলে সেই সমস্ত রাজ্যগুলিতে ছাত্রছাত্রীরা সরকারি বিদ্যালয়ের প্রতি আকর্ষিত হচ্ছে।

স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in