দেশের ১৫তম রাষ্ট্রপতি হিসাবে সোমবার শপথ নিলেন দ্রৌপদী মুর্মু। ওড়িশার আদিবাসী নেত্রী দ্রৌপদী মুর্মুকে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী করার বিষয়কে বিজেপি হাইকমান্ডের একটি 'মাস্টার স্ট্রোক' বলে দাবি করেছে একাধিক সংবাদমাধ্যম। অনেকেই জানিয়েছে, আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনগুলিতে এমনকি, ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে আদিবাসীদের বিপুল জনসমর্থন পাবে বিজেপি।
তবে, কিছু প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবে উঠতে শুরু করেছে। তা হল - বিজেপির এই প্রতীকী পদক্ষেপে কি মধ্য ভারত এবং উত্তর-পূর্ব এলাকায় যেখানে বিপুল সংখ্যক আদিবাসীরা বাস করেন, তাঁদের কি কোনও উন্নতি হবে? তাঁদের উপর যে অত্যাচার হয়, তা কি প্রশমিত হবে?
মূলত, তিনটি বিষয় রয়েছে যা নিয়ে আদিবাসীদের মধ্যে অসন্তোষ দানা বেঁধেছে - বন অধিকার আইন (FRA), আদিবাসী কল্যাণের জন্য অর্থ বরাদ্দ এবং আদিবাসীদের উপর ক্রমবর্ধমান অত্যাচার রোধ - এই তিনটি বিষয়ে বিজেপির ভূমিকা খুব একটা সন্তোষজনক নয়।
বন অধিকার আইন (FRA) -
২০০৬ সালে পার্লামেন্টে পাশ হয় বন অধিকার আইন বা Forest Rights Act (FRA)। মূলত, জমির উপর আদিবাসী এবং বনবাসীদের আইনিভাবে অধিকার (পাট্টা) দিতে এই আইন পাশ করা হয়েছিল, যে জমিতে এই সম্প্রদায়ের মানুষেরা দীর্ঘদিন ধরে চাষ-আবাদ করে আসছেন। জীবিকা নির্বাহ করছেন।
কিন্তু দেখা যাচ্ছে - আদিবাসী জনজাতির সংখ্যা যে রাজ্যগুলিতে বেশি বা যে রাজ্যগুলি বিজেপি শাসিত - সেখানে এই আইনের প্রয়োগ বা বাস্তবায়ন খুব একটা হয়নি। অবিজেপি রাজ্যগুলি থেকে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলি প্রায়শই পিছিয়ে পড়েছে। ২০২২ সালের মার্চ মাসের শেষে যে চিত্র উঠে এসেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে সবথেকে বেশি জমির পাট্টা পেয়েছেন অন্ধপ্রদেশে বসবাসকারী আদিবাসী সম্প্রদায়। এরপরেই রয়েছে ওড়িশা।
আর যে সমস্ত রাজ্যে 'বন অধিকার আইন' প্রয়োগের চিত্র খুবই খারাপ, তার মধ্যে রয়েছে হিমাচলপ্রদেশ, কর্ণাটক, উত্তরাখণ্ড এবং উত্তরপ্রদেশ। সবকটিই বিজেপি শাসিত রাজ্য।
এই বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলির মধ্যে হিমাচল প্রদেশ এবং উত্তরাখণ্ড হল ছোট রাজ্য। তবে আয়তনে অন্যদের তুলনায় বৃহৎ উত্তরপ্রদেশে, যেখানে আদিবাসীদের জনসংখ্যা সবথেকে বেশি, সেখানে জমির অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ। তবে একমাত্র ব্যতিক্রম ত্রিপুরা। এই রাজ্যে আদিবাসীদের জমির পাট্টা দেওয়ার পরিমাণ জাতীয় গড়ের (৫০.৪ শতাংশ) থেকে কিছুটা বেশি।
আবার, গুজরাট - যেখানে একাটানা প্রায় ৩০ বছর বিজেপি ক্ষমতায় রয়েছে, সেই রাজ্যের আদিবাসীদের মধ্যে জমির অধিকার দেওয়ার পরিমাণ মাত্র ৫১ শতাংশ। অন্যদিকে, অ-বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলির মধ্যে অন্ধ্র প্রদেশ ৭৭ শতাংশ ও ওডিশা ৭১ শতাংশ আদিবাসীদের মধ্যে জমির অধিকার দিতে পেরেছে বলে গত ২০ জুলাই, রাজ্যসভায় জানিয়েছে কেন্দ্র সরকার।
আদিবাসী কল্যাণের জন্য অর্থ বরাদ্দ
কেন্দ্রীয় বাজেটের অর্থ থেকে একটি অংশ তফসিলি জাতি (SC) এবং তফসিলি উপজাতি (ST)-র জন্য কল্যাণমূলক প্রকল্পে সম্পূর্ণ ব্যয় করার কথা। মূলত, মোট জনসংখ্যার অনুপাতে SC এবং ST-র অনুপাত যেমন হবে, সেই অনুযায়ী অর্থ বরাদ্দ হয়ে থাকে। ২০১৭ সালের নীতি আয়োগের গাইডলাইন অনুসারে, এই অনুপাত হল SC-র জন্য ১৫.৪৯ শতাংশ এবং ST-র জন্য ৮.২ শতাংশ৷
কিন্তু, কেন্দ্র থেকেই দেওয়া তথ্যে দেখা যাচ্ছে - ২০১৮-১৯ সালে আদিবাসীদের জন্য প্রকৃত বরাদ্দ ছিল মাত্র ৪.৯ শতাংশ। আর ২০২২-২৩ সালের বাজেটে তা কিছুটা বাড়িয়ে ৭.৩ শতাংশ করা হয়েছে। নীতি আয়োগের গাইডলাইন অনুসারে যেটি ৮.২ শতাংশ হওয়ার কথা ছিল।
এরপর - আদিবাসীদের উপর ক্রমবর্ধমান অত্যাচার রোধের বিষয়
বিভিন্ন রাজ্য থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (NCRB) যে পরিসংখ্যান তুলে ধরেছে, তাতে জানা যাচ্ছে ২০২০ সালে সারাদেশে আদিবাসী বা তফসিলি উপজাতি (ST)-র উপর ৮২৭২টি নৃশংস ঘটনা ঘটেছে। তার মানে, একজন আদিবাসীর বিরুদ্ধে প্রায় প্রতি ঘণ্টায় অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। উল্লেখ্য, ভারতীয় দণ্ডবিধিতে খুন, ধর্ষণ, গুরুতর আঘাতকে অপরাধ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। একইসঙ্গে, নৃশংসতা প্রতিরোধ আইন (POA)-এ অপমান, বৈষম্য এবং জমি থেকে উচ্ছেদ করাকে অপরাধ বলা হয়েছে।
বিজেপি শাসিত রাজ্য সরকারগুলি সামাজিক জীবনে এই অপরাধের প্রবণতা কমানোর দিকে খুব কম মনোযোগ দিয়েছে। দলিতদের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা বিরাজ করছে।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন