বিজেপি'কে জনবিচ্ছিন্ন ও পরাস্ত করতে সিপিআই(এম) ২৩ তম কংগ্রেসে রাজনৈতিক লাইন ঠিক করল সর্বসম্মতভাবেই। এর মূল বিষয় হলো, নির্বাচনে বিজেপি বিরোধী ভোটকে যতটা সম্ভব এক জায়গায় নিয়ে আসা। এরজন্য নির্বাচনে জাতীয় বা রাজ্যে কোথাও কংগ্রেস বা কোনো আঞ্চলিক দলের সাথে জোটে যাবে না সিপিআই(এম), শুধু আসন বোঝাপড়া হবে। এই আসন বোঝাপড়া হবে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে। তাই রাজ্যে রাজ্যে এই আসন বোঝাপড়া বিভিন্ন হতে পারে।
কংগ্রেসের সংগে আসন সমঝোতার ব্যাপারে পার্টির কেরালা শাখার যথেষ্ট বিরোধিতা আছে। সে রাজ্য কংগ্রেসই সিপিআই(এম)’র প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। তাদের বক্তব্য হলো, কেরালায় আরএসএস-বিজেপি'র বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রশ্নে কংগ্রেস একেবারেই দায়িত্বশীল নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজ্যের এলডিএফ সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে তারা বিজেপি'র সহযোগী শক্তি হিসেবে কাজ করছে। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল ও বিজেপি উভয়ের বিরুদ্ধেই লড়াই করবে সিপিআই(এম)। কিন্তু দু’দলকে এক করে বিজেমূলের ধরণের প্রচার চালাবে না। পার্টি কংগ্রেসে গৃহীত রাজনৈতিক প্রস্তাবে এই রাজনৈতিক লাইনের বিষয়টি থাকে। প্রতিনিধিদের দীর্ঘ আলোচনার পর প্রস্তাবটি গৃহীত হয়েছে।
পার্টি কংগ্রেসকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের সেমিনারের আয়োজন সিপিআই(এম)’র পুরনো রীতি। এবারও কান্নুরে হচ্ছে ২০টা সেমিনার। সেমিনারে সিপিআই(এম)’র নেতৃত্ব বক্তব্য রাখছেন। সিপিআই'র সাধারণ সম্পাদক ডি রাজা, বামপন্থী বুদ্ধিজীবী সহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বকেও সেমিনারে বক্তব্য রাখার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এঁদের মধ্যে আছেন তামিলনাডুর মুখ্যমন্ত্রী স্টালিন, কংগ্রেস সাংসদ শশী থারুর প্রমুখ। শশী থারুর সেমিনার বলার বিষয়ে রাজি থাকলেও প্রদেশ কংগ্রেসের বিরোধিতায় তিনি সেমিনারে আসতে পারছেন না।
আইএনটিইউসি'র রাজ্য সভাপতি আর চন্দ্রশেখরও সেমিনারে আমন্ত্রিত ছিলেন। তিনিও দলের বিরোধিতায় সেমিনারে নেই। এমনকী চন্দ্রশেখর সেমিনারে বলার জন্য কান্নুরে এসেও গিয়েছিলেন। শশী থারুর না এলেও কেরালা প্রদেশ কংগ্রেসের নেতা ও প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কে ভি টমাস'কে সেমিনারে বলার ব্যাপারে রাজি করিয়েছে সিপিআই(এম)। স্টালিন ও শশী থারুরের যে সেমিনারে বলার কথা তার বিষয় ‘কেন্দ্র – রাজ্য সম্পর্ক ’। বিষয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বকে সেমিনারে বলার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছে সিপিআই(এম)। সেমিনারটি হবে ৯ এপ্রিল বিকেলে। কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন এর উদ্বোধন করবেন।
কে ভি টমাস বলেছেন : এইরকম একটি জাতীয় বিষয়ে সেমিনারে অংশগ্রহণ করে তিনি পার্টির কোনো শৃঙ্খলা ভঙ্গ করছেন না। প্রদেশ কংগ্রেস শাস্তি দেবার হুমকি দিলেও টমাসকে নিজের অবস্থান থেকে টলাতে পারে নি।
বর্তমান সময়ে অবিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিকে নানাভাবে অসহযোগিতা করে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। তার মধ্যে যেমন বামশাসিত কেরালা, ডিএমকে শাসিত তামিলনাডু রয়েছে, একইভাবে কংগ্রেস শাসিত রাজ্যগুলিও এর শিকার। সেইদিক দিয়ে দেখলে বর্তমানে দেশের রাজনীতিতে অন্যতম আলোচনার বিষয় হলো এটি। বিজেপি'র বিরুদ্ধে এইরকম একটি বিষয়ে কংগ্রেসের না যোগ দেওয়াটা অনেককে অবাক করেছে। কংগ্রেসের এইরকম একটি ভুল রাজনৈতিক অবস্থানকে একেবারেই হাতছাড়া করতে রাজি নয় সিপিআই(এম), বিশেষ করে, কেরালায়।
‘ধর্মনিরপেক্ষতার সামনে চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক অন্য একটি সেমিনারে প্রকাশ কারাত বলেছেন: “যাঁরা গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ তাঁরা সবাই বলবেন এই বিষয়ে আলোচনা জরুরি। এ ব্যাপারে আমি তাঁর বিবৃতি দেখেছি। তিনি লিখেছেন, এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ সেমিনার। তিনি সেমিনারে অংশ নিতে খুবই আগ্রহী। কিন্তু তাঁর পার্টির কেরালা ও এআইসিসি'র নেতৃত্ব তাঁকে যেতে বারণ করেছে। তাই তিনি আসতে পারবেন না।” এই অবস্থান জনগণের মধ্যে কংগ্রেস দলের “ইমেজ ও বিশ্বাসযোগ্যতায় ক্ষতি” করবে বলেও মত প্রকাশ করেন কারাত।
রাজনৈতিক লাইন নির্ধারণের পর সিপিআই(এম)’র কংগ্রেসে রাজনৈতিক – সাংগঠনিক রিপোর্টের ওপর আলোচনা চলছে। এই রিপোর্ট পেশ করেছেন প্রকাশ কারাত। বর্তমানে সিপিআই(এম)’র সারাদেশে সদস্য সংখ্যা ১০ লক্ষের মতো। যার অর্ধেকের বেশি হলো কেরালায়। পশ্চিমবঙ্গ সহ বহু রাজ্যে গত চার বছরে পার্টি সদস্য কমেছে। সারা দেশেই এক অসম বৃদ্ধির সমস্যার মধ্যে রয়েছে সিপিআই(এম)। এই পরিস্থিতিতে কেরালায় পার্টি সদস্য বেড়েছে, বেড়েছে জনভিত্তিও। কেরালার নির্বাচনী লড়াইয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করে টানা দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসেছে এলডিএফ।
কান্নুরে সিপিআই(এম)’র কংগ্রেসকে নিয়ে জনগণের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহও চোখে পড়ছে। পার্টি কংগ্রেসকে কেন্দ্র করে হওয়া প্রদর্শনী ও আন্তর্জাতিক বইমেলায় প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ আসছেন। কংগ্রেসে ঠিক হয়েছে, কেরালার এলডিএফ সরকারের বিকল্প জনমুখী কর্মসূচি – বিশেষ করে, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাক্ষেত্রে যে নজিরবিহীন সাফল্য অর্জন করেছে তা সারাদেশে তুলে ধরার ব্যপারে আগামীদিনে উদ্যোগ নেবে পার্টি। রাজনৈতিক - সাংগঠনিক এই দলিলের ওপর প্রতিনিধিদের আলোচনা ৯ এপ্রিল সকাল থেকে শুরু হয়েছে।এই দলিলটি চূড়ান্ত হবে ১০ এপ্রিল সকালে।
১০ এপ্রিল পার্টি কংগ্রেসের শেষ দিন। ওই দিন বিকেলে কান্নুরের জওহর স্টেডিয়াম হবে প্রকাশ্য সমাবেশ। সীতারাম ইয়েচুরি, প্রকাশ কারাত, পিনারাই বিজয়ন, মানিক সরকার, বৃন্দা কারাত, কোডিয়ারি বালকৃষ্ণণ, এম এ বেবি বলবেন। কেরালার সিপিআই(এম) নেতৃত্ব বলছে, ওই সমাবেশ হবে ঐতিহাসিক। সমাবেশে বক্তার তালিকায় কেরালার সিপিআই(এম) নেতাদেরই প্রাধান্য বেশি। পশ্চিমবঙ্গের কোনো বক্তা নেই।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন