দেউচা পাঁচামিতে জমি না দেবার আন্দোলন ক্রমশ জোরদার হচ্ছে। ইতিমধ্যেই প্রায় হাজার জনের বেশি মানুষ দেউচা পাঁচামিতে জমি না দেওয়ার ফর্মে সই করেছেন। গ্রামের পর গ্রামে গ্রামসভা করে সাধারণ মানুষের সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ করা হচ্ছে। রাজ্য প্রশাসন দেউচা পাঁচামি নিয়ে সাফল্যের প্রচার শুরু করে দিলেও গ্রামের মাটি কিন্তু সম্পূর্ণ অন্য কথা বলছে। যদিও গতকালই সিউড়িতে প্রায় দুশো জন জমিদাতার হাতে প্রশাসনের তরফে তুলে দেওয়া হয়েছে নিয়োগপত্র।
দেউচা-পাঁচামী গ্রামসভা সমন্বয় হুল কমিটির আহ্বায়ক রতন হেমব্রম জানিয়েছেন, ‘‘যাঁরা সরকারকে জমি দিয়ে চাকরি নিচ্ছে তাঁরা কতজন এলাকায় বসবাস করেন? বেশিরভাগ থাকেন বাইরে। যাঁরা এলাকায় বসবাস করেন তাঁদের অধিকাংশই এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে। তাঁরা চান এই এলাকায় যে পাথর শিল্প রয়েছে তা আঁকড়ে বাপ-দাদাদের ভিটেমাটিতেই থাকতে।’’
এই পরিস্থিতিতে পাঁচামীর হরিণশিঙা থেকে হারমাডাঙাল, বারোমেসিয়া থেকে হাবড়াপাহাড়ি, পাথরচাল থেকে হাটগাছা, তেঁতুলবান্দি-পরপর আদিবাসী জনপদে হচ্ছে গ্রামসভা। প্রতিদিন নতুন নতুন জনপদে বসছে গ্রামসভা। এখনও পর্যন্ত একটিও গ্রামসভাতেও মানুষ কয়লা খনির পক্ষে তাঁদের সম্মতি দেননি।
বীরভূম জমি জীবন জীবিকা বাঁচাও মহাসভার তরফে জগন্নাথ টুডু জানিয়েছেন, ‘‘আমাদের পাঁচামীর যাঁরা প্রকৃত বাসিন্দা তাঁরা কেউ তাঁদের জমি জঙ্গলের অধিকার ছাড়তে চান না। আমরা গ্রামসভার বৈঠক করে মানুষের মতামত নিচ্ছি। সেখানে সিংহভাগ মানুষ কয়লাখনির বিরুদ্ধে। আমরা আমাদের আদিবাসীদের জমি জঙ্গলের অধিকারের যে আইন আছে তা নিয়েই লড়াই করব। গ্রামসভার সিদ্ধান্ত রাজ্যপালের কাছে পাঠাবো শীঘ্রই।’’
উল্লেখ্য, শনিবার সিউড়ির রবীন্দ্র সদনে আয়োজন হয়েছিল প্রশাসনিক শিবিরের। দেউচা-পাঁচামী প্রস্তাবিত কয়লাখনির জন্য জমিদাতাদের মনোনীত প্রার্থীদের গ্রুপ-ডি চাকরির নিয়োগপত্র দেওয়ার জন্য এই শিবিরের আয়োজন হয়েছিল প্রশাসন। প্রশাসনিক স্তর থেকে দাবি করা হয়েছে, প্রায় তিনশো জনকে আগেই জুনিয়র কনস্টেবল পদে নিয়োগ করা হয়েছে। এবার নিয়োগপত্র দেওয়া হয়েছে গ্রুপ-ডি পদে। জেলাশাসক বিধান রায় বলেছেন, ‘‘এদিন প্রায় দুশো জনের হাতে গ্রুপ-ডি পদে নিয়োগপত্র দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে এখনও পর্যন্ত নিয়োগের সংখ্যা প্রায় পাঁচশো।’’
এই নিয়োগপত্র প্রদান করতে এদিন সিউড়ির অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন ফিরহাদ হাকিম, পিডিসিএল’র চেয়ারম্যান পি বি সেলিম। ছিলেন অন্যান্য মন্ত্রী, সাংসদ, বিধায়ক ও জেলা প্রশাসনের কর্তারা। সেখানে ফিরহাদ হাকিম বলেছেন, ‘‘বাংলা জুড়ে শুধু কুৎসা করছে আজ। এখনও বলছি এই সিপিএম, তখনকার বামফ্রন্ট সরকার ষড়যন্ত্র করে টাটাকে তাড়িয়েছিল। কিন্তু মনে হচ্ছে যেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাড়িয়ে দিয়েছে। সিঙ্গুরে পিটিয়ে লাথি মেরে জমি নিয়েছিল বামেরা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মানুষকে বুঝিয়ে আর্থিক প্যাকেজ দিয়ে জমি নিচ্ছে দেউচা-পাঁচামীতে। লক্ষ কোটি টাকার উন্নয়ন হবে। প্রায় ৪০ হাজার মানুষ চাকরি পাবে।’’
তাঁর দাবি, প্রস্তাবিত কয়লাখনি প্রকল্পের জমিদাতাদের মনোনীত প্রার্থীদের মধ্যে যাঁরা পুলিশে চাকরির জন্য যোগ্য নন তাঁদেরকে এই সুবিধা দেওয়া হয়েছে। তাছাড়াও যাঁদের মনোনীত প্রার্থীর ১৮ বছর হয়নি, তাদের ১৮ বছর হওয়া পর্যন্ত মাসিক ১০ হাজার টাকা করে ভাতা দেওয়ার অঙ্গীকারপত্রতুলে দেওয়া হয়।
অন্যদিকে গ্রামে গ্রামে যেমন গ্রামসভা হচ্ছে ঠিক তেমনভাবেই প্রশাসনের বিলি করা ফরমের পালটা ফরমও ছাপানো হয়েছে। প্রশাসন ‘জমিদানে ইচ্ছুক’— এমন ফরম ছাপিয়ে মাস কয়েক আগে থেকেই তৎপরতা বাড়িয়েছিল। এবার তার জবাবে ‘দেউচা-পাঁচামী কয়লা খনির জন্য আমি আমার পৈতৃক ভিটে ও জমি দিতে অনিচ্ছুক’— এই ফরম ছাপিয়েছেন পাঁচামীর আদিবাসীরা। গ্রামে গ্রামে বিলি হয়েছে ফরম। তাতে স্বাক্ষরের সংখ্যা হাজার পেরিয়ে গিয়েছে বলেই জানিয়েছেন আদিবাসীরা।
ফিরহাদ হাকিম গতকাল জানিয়েছেন, ‘‘সিঙ্গুরের সঙ্গে দেউচা-পাঁচামীর এটাই পার্থক্য। জোর করে জমি নয়, বরং সুবিধাজনক প্যাকেজ দিয়ে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের থেকে জমি নিয়েই শিল্প তৈরি হচ্ছে এখানে। আর সিঙ্গুরে জোর করে জমি কাড়া হয়েছিল।’’ যদিও সিঙ্গুরে কারখানার জন্য স্বেচ্ছায় জমি দিয়েছিলেন ৮২% কৃষক। পাঁচামীতে এখনও জমি পায়নি মমতা ব্যানার্জির সরকার।
প্রসঙ্গত, দেউচা পাঁচামি প্রকল্পের জন্য তিন হাজার ৪০০ একর জমিতে যেমন বাস্তু জমি রয়েছে, তেমনি রয়েছে জঙ্গল, পাথর খাদান, পাথর ভাঙ্গার কল, চাষ জমি। বারোটি গ্রামে ২১ হাজারের বেশি মানুষ বাস করে। কিন্তু তাদের সঙ্গে কোনও রকম আলোচনা ছাড়াই যেভাবে প্রকল্প ঘোষণা করা হয়েছে, তাতে অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
শুধু পুনর্বাসন নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটা এক হাজার একর জমির উপর টাটার গাড়ি তৈরি মতো বিষয় নয়। এখানে প্রায় সাড়ে তিন হাজার একর জমির নীচ থেকে কয়লা তোলা হবে। জঙ্গল সাফ হবে, পাথর তোলা হবে। তারপর কয়লা কীভাবে তোলা হবে, পরিবেশ রক্ষায় কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, সেই বিষয়ে কিছুই জানানো হয়নি।
পরিবেশবিদদের আশঙ্কা, এর ফলে পরিবেশের ক্ষতি হতে পারে। এই ধরনের প্রকল্পকে সফল করতে বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া দরকার। কিন্তু তারা তা করেছে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
দেউচা-পাঁচামী কয়লা খনি বাতিলের দাবিতে গত এগারো মাস ধরে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন স্থানীয় ৩৬ টি গ্রামের আদিবাসীরা। গত ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে বারোমেসিয়ার ডাঙালে রিলে অনশন করছেন আন্দোলনকারীরা। এর আগে গত জুলাই মাসে সিউড়ি শহরে এসে বিক্ষোভ দেখিয়ে কয়েক ঘণ্টার জন্য জেলা শাসকের দপ্তর কার্যত স্তব্ধ করে দেন আদিবাসীরা।
আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন স্থানীয় আদিবাসী নেতা টেরেসা সোরেন। রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়ে তিনি বলেন, "আজ আদিবাসীদের কথা খুব মনে পড়ছে সরকারের! আজ আদিবাসীদের জন্য দরদ উথলে পড়ছে! আমরা আদিবাসী, এই জমি আমাদের, এই জঙ্গলও আমাদের। কোনো পরিস্থিতিতেই এই জমি-জঙ্গল ছেড়ে দেব না আমরা।"
এক আন্দোলনকারী মহিলা বলেন, "পাহাড়ের কেউ কয়লা খনি চায় না। প্রতিবাদ করায় পুলিশ দিয়ে হুমকি দেওয়া হচ্ছে আমাদের। আমরা এই লড়াইয়ের শেষ দেখে ছাড়বো।"
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন