মধ্যপ্রদেশের ঝাবুয়া জেলার দামোর পরিবারের পাঁচটি মেয়ে, যাদের বয়স ১১ থেকে ১৮ বছর, যারা আগে স্কুলে যেত, মহামারী শুরু হওয়ার পর থেকে তাদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। স্কুল যাওয়ার বদলে তারা এখন কাজ খুঁজতে বেরোতে বাধ্য হয়েছে।
২০২০ সালের মার্চ মাসে, মহামারীজনিত কারণে লকডাউনে স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে, ঝাবুয়া জেলার ধুমাদিয়া গ্রামের আশা দামোর ৭ শ্রেণীতে পড়তো। লকডাউনে পরিবারের আর্থিক দুরবস্থার কারণে তার বাবা নানসিংহ দামোরকে পরিবারকে টিকিয়ে রাখার জন্য ঋণ নিতে হয়েছিলো। এখন সেই ঋণ শোধের জন্য আশাকে নিজেকে তার গ্রাম থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে একটি খামারে কাজ করতে হচ্ছে। নতুন সরকারী নির্দেশ অনুসারে, এই সময় কোনো অনলাইন ক্লাস না করে অথবা বইখাতা না ছুঁয়েও তাকে ৮ শ্রেণীতে উত্তীর্ণ করা হয়েছে।
রাজ্য সরকারের DigiLEP উদ্যোগের অধীনে, সরকারি স্কুলের শিক্ষকরা লকডাউন চলাকালীন শিক্ষার্থীদের কিছু ধরণের পড়াশুনো চালিয়ে যাওয়ার জন্য হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে শিক্ষার্থীদের সাথে পড়াশোনার উপকরণ এবং ভিডিও পাঠিয়েছেন। যদিও এতে আশার মতো ছাত্রীদের কোনো লাভ হয়নি। কারণ এই গরিব পরিবারের কাছে কোনো স্মার্টফোন নেই। এই একই ঘটনা ঘটেছে আশেপাশের এবং আশার গ্রামের অনেক ছাত্রছাত্রীর ক্ষেত্রে।
আশা এবং তার ছোট বোন, ১১ বছরের নন্দিনী কর্মজীবনে নতুন। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে বহু আশাদের জীবন এমনই। প্রাথমিকভাবে, দামোর তার মেয়েদের নিয়ে নিকটবর্তী শহর বদনাওয়ারে রসুনের খামারে কাজ করতে যান। তিনি বলেন, "শুরুতে, আমি প্রায় দু’মাস রসুনের খামারে কাজ করেছি। আমরা সকাল সাড়ে ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কাজ করতাম।" এর জন্য, প্রতিদিন ২০০ টাকা করে মজুরি দেওয়া হয় এবং মাঠে থাকার জন্য একটি ছোট ঘর দেওয়া হয়। আশা জানিয়েছে, "আমরা গ্রাম থেকে নিজেদের খাবার যেমন গমের আটা, ডাল নিয়ে আসতাম এবং পাশের বন থেকে আনা কাঠ দিয়ে মাটির উনুনে রান্না করতাম।"
দামোর পরিবারটি ভিল আদিবাসী সম্প্রদায়ের অন্তর্গত, একটি তফসিলি উপজাতি। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে, ঝাবুয়া জেলার তফসিলি উপজাতিরা গ্রামীণ অংশে ৩৫ শতাংশ সাক্ষরতার হার সহ মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮৬ শতাংশ। দামোর এবং তার স্ত্রী কমলা নিজেরাই প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেনি। দামোর ক্লাস ৫ পর্যন্ত পড়লেও তাঁর স্ত্রী কমলা মাত্র এক বছর স্কুলে পড়েছেন। এই দম্পতির মোট ছ’টি মেয়ে। যার সবচেয়ে ছোটটিকে দামোরের বড় ভাই দত্তক নিয়েছে।
পরিবারটির গ্রামে একটি ছোট খামার রয়েছে এবং প্রতি বছর ফসল কাটার পরে এই দম্পতি অন্য খামারে কাজের সন্ধানে চলে যেত। কমলা জানিয়েছে, "সমস্ত খরচ সামলানোর জন্য, আমিও আমার স্বামীর সাথে বাইরে কাজ করতে যেতাম।"
আশার মা কমলা জানিয়েছেন, এখন স্কুল খোলা থাকলে বাচ্চাদের কাজে যেতে হত না। তিনি বলেন, "লকডাউনের আগে পাঁচ মেয়েই স্কুলে যেত; আমরা কখনই স্কুলে পড়ালেখার সাথে আপস করিনি।" তিনি আরও বলেন, যদি স্কুল খোলা হত তাহলে তাঁরা মেয়েদের বাইরে কাজ করতে পাঠাতেন না। কিন্তু তাদের বাড়ির অনেক কাজ বাকি এবং মাথায় অনেক দেনা। তিনি বলেন, "এখন আশা এবং নন্দিনী দুজনেই বড় হয়েছেন"।
আশার পরিবারের এক সদস্য বলেন, "ঘর মে পড়াই হো নাহি রাহি হ্যায়, ইসলিয়ে ২০০ কে পিছে জা রহে হ্যায়; ২০০ মিল গয়ে তো হো গই নোকরি, কিতাবো কো তো দেখা হি নেহি।” যার অর্থ, বাড়িতে পড়াশুনা হচ্ছে না। তাই তারা ২০০ টাকার পিছনে যাচ্ছে। তারা এইসময় বইয়ের দিকে মোটেও তাকায়নি।
মধ্যপ্রদেশ কমিশন ফর প্রোটেকশন অফ চাইল্ড রাইটস (এমপিসিপিসিআর)-এর তথ্য অনুসারে, কোভিডের বিধ্বংসী দ্বিতীয় তরঙ্গের পরে রাজ্যের চারটি আদিবাসী জেলায় প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত প্রায় ৪০ হাজার শিশু স্কুল ছেড়ে দিয়েছে।
এমপিসিপিসিআরের সদস্য ব্রিজেশ চৌহান বলেন, "মধ্যপ্রদেশের অন্যান্য জেলাগুলির অবস্থা আরও খারাপ। যা খুবই দুঃখজনক। আমরা অভিভাবকদের তাদের বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানোর জন্য উৎসাহিত করার চেষ্টা করছি। কিন্তু ভারতে নিম্ন-মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্তদের আর্থিক অবস্থা মহামারী শুরু হওয়ার পর থেকে আরও খারাপ হয়েছে।" "যখন প্রতিদিনের রেশনের জন্য এতগুলি বাড়ি এনজিওর উপর নির্ভরশীল, তখন অভিভাবকরা কীভাবে স্কুলের ফি দেবেন এবং বই কিনবেন?"
মে মাসে, মেয়েরা যখন চিতোর্দী রুন্ডির কাছে কাজলিয়া গ্রামে একটি রাস্তা নির্মাণের জায়গায় কাজ শুরু করে, তখন তাদের বোন মনীষা (১২) তাদের সাথে কাজে যোগ দেয়। ধুমাদিয়া এবং আশেপাশের গ্রামের অন্যান্য শ্রমিকদের সাথে কাজ করা আরও ১৫-২০ জন মেয়ের মধ্যে তিন বোন ছিল। বামানিয়া পঞ্চায়েত তাদের কাজ করার জন্য নিয়োগ করেছিল এবং প্রতিদিন ১৯৭ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। মনীষা বলেন, "তারা আমাদের গ্রামে শ্রমিক খুঁজতে এসেছিল। আমরা পুরো এক মাস কাজ করেছি। কিন্তু আমাদের কোনো পয়সা দেওয়া হয়নি। তবে, অন্য শ্রমিকদের মজুরি তাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে।"
বামনিয়ার সরপঞ্চ রামকন্যা মাখোদের স্বামী সঞ্জয় মাখোদ অবশ্য ১৪ বছরের কম বয়সী কোনও শিশুকে নিয়োগ করার কথা অস্বীকার করেছেন। "আমরা শ্রমিকদের প্রতিদিন ১৯৩ টাকা দিয়েছিলাম এবং সাইটে ১৪ বছরের কম বয়সী কোনও শিশু কাজ করেনি।"
ঝাবুয়া জেলার উপজাতি ছাত্রদের ক্ষমতায়নের জন্য কাজ করা এক এনজিও আদিবাসী চেতনা শিক্ষা সেবা সমিতির সম্পাদক বেনেডিক্ট দামোর জানিয়েছেন: "লকডাউনের সময় স্কুল বন্ধ থাকায়, ছাত্রদের শিক্ষা মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়েছে৷ তাদের বেশিরভাগই তাদের বাবা-মায়ের সাথে বাইরে কাজ করার জন্য যোগ দিয়েছে৷ এঁরা জীবিকা নির্বাহের জন্য গুজরাট এবং রাজস্থানে পাড়ি দিয়েছে।"
"শিশু শ্রম প্রথা এই জেলায় খুব সাধারণ। আপনি ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের হোটেল এবং অন্যান্য বিভিন্ন জায়গায় কাজ করতে দেখতে পাবেন। আমরা অভিযোগ জানাতে পারি না। কারণ তারা সেই উপার্জন দিয়ে তাদের পরিবারের দেখাশোনা করে; তাদের সামনে অন্য কোনো বিকল্প নেই।
এমপিসিপিসিআর-এর সদস্য চৌহান বলেন, মহামারীর আগেও এখানকার অনেক শিশু তাদের অভিবাসী অভিভাবকদের সাথে যাওয়ার জন্য স্কুল ছেড়ে দিত। এই প্রবণতা এখন অনেক বেড়েছে। "অনেক দিনমজুর রাজস্থান এবং গুজরাটে চলে গেছে। কারণ তারা কারখানায় কাজ করে প্রতিদিন প্রায় ৪০০-৫০০ টাকা আয় করে। যেখানে মধ্যপ্রদেশে MGNREGA-তে প্রতিদিন ১৯০ টাকা মজুরি দেওয়া হয়। বাবা-মা যখন কাজের জন্য অন্য জায়গায় চলে যায়, তখন বাচ্চাদেরও সেখানে যেতে হয় এবং তাই তারা স্কুল ছেড়ে দেয়। ৪০ হাজারের মধ্যে প্রায় ১০,৫০০ শিক্ষার্থী মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় তাদের বাবা মায়ের সাথে অন্য জায়গায় চলে গেছে।"
মধ্যপ্রদেশের আদিবাসী অধ্যুষিত জেলা, যেমন আলীরাজপুর, ধর, ঝাবুয়া এবং বেতুলে স্কুল ড্রপআউটের হার অনেক বেশি। তাই MPCPCR আদিবাসী কল্যাণ বিভাগকে চিঠি দিয়েছে যাতে এইসব ছাত্রদের হোস্টেলের সুবিধা দেওয়া যায়। এতে শিশুদের বাবা মা অন্য রাজ্যে কাজের জন্য গেলেও শিশুরা স্কুলমুখী হতে পারে এবং পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে। যদি তাদের বাবা-মা স্থানান্তরিত হয়।
চৌহান বলেন, "আমরা সন্দেহ করি যে অন্যান্য আদিবাসী জেলা - যেমন মান্ডলা, ছিন্দওয়ারা এবং ডিন্ডোরির পরিস্থিতি এই চারটি জেলার মতোই এবং আমরা শিক্ষা, শ্রম ও আদিবাসী কল্যাণ বিভাগকে চিঠি দিয়েছি যাতে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা চালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা যায়।"
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন