ইলেক্টোরাল বন্ড বা নির্বাচনী বন্ড স্কীমকে আজ ‘অসাংবিধানিক’ বলে রায় দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। অবিলম্বে এই স্কীম বাতিলের নির্দেশ দিয়েছে শীর্ষ আদালত। এডিআর, সিপিআই(এম), কংগ্রেস নেতা জয়া ঠাকুর, স্পন্দন বিসোয়াল সহ একাধিক সংস্থা, রাজনৈতিক দল এবং ব্যক্তি এই বন্ডের বিরোধিতা করে আদালতে জনস্বার্থ মামলা (ADR & Anr. V. Union of India & Ors., Writ Petition (Civil) No. 880 of 2017) দায়ের করে। প্রশ্ন তোলা হয় ইলেক্টোরাল বন্ডের স্বচ্ছতা নিয়ে। আসুন, এক নজরে দেখে নেওয়া যাক কী এই ইলেক্টোরাল বন্ড।
কবে চালু হয় ইলেক্টোরাল বন্ড?
২০১৮ সালের ২ জানুয়ারি গেজেট নোটিফিকেশন ২০-র মাধ্যমে ভারত সরকার ইলেক্টোরাল বন্ড চালু করে। ২০১৭ সালে ফিনান্স আইনে সংশোধনী এনে ইলেক্টোরাল বন্ডের প্রস্তাব রাখা হয়। ২০১৭-র বাজেট বক্তৃতায় প্রথম এর উল্লেখ করেন তদানীন্তন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি।
কোন কোন অঙ্কের ইলেক্টোরাল বন্ড পাওয়া যায়?
১ হাজার টাকা, ১০ হাজার টাকা, ১ লক্ষ টাকা, ১০ লক্ষ টাকা এবং ১ কোটি টাকার ইলেক্টোরাল বন্ড চালু করা হয়।
ইলেক্টোরাল বন্ড কেনার নিয়ম কী?
নিয়ম অনুসারে দেশের নাগরিক এবং কর্পোরেট সংস্থা সরকার কর্তৃক তালিকাভুক্ত সংশ্লিষ্ট শহরে এসবিআই-এর শাখা থেকে এই বন্ড কিনতে পারত। এই বন্ড কেনার আগে কেওয়াইসি পূরণ করতে হত। নিয়ম অনুসারে বন্ড কেনার পর থেকে ১৫ দিনের মধ্যে তা কোনও রাজনৈতিক দলকে দান করতে হবে। ওই ব্যাঙ্কে থাকা অ্যাকাউন্টের মাধ্যমেই বন্ড ভাঙানো যাবে।
কারা ইলেক্টোরাল বন্ডে অনুদান পাবার যোগ্য?
ভারতীয় জনপ্রতিনিধিত্ব আইন, ১৯৫১-র ২৯এ ধারা অনুযায়ী নিবন্ধীকৃত রাজনৈতিক দল এবং যারা শেষ সাধারণ নির্বাচনে অথবা বিধানসভা নির্বাচনে কমপক্ষে ১ শতাংশ ভোট পেয়েছে তারা ইলেক্টোরাল বন্ডে অনুদান পাবার যোগ্য।
ইলেক্টোরাল বন্ড নিয়ে বিতর্ক কেন?
প্রথমত, যদিও কোনও নাগরিক বা কর্পোরেট ইলেক্টোরাল বন্ড কিনতে পারে কিন্তু তথ্য অনুসারে এখনও পর্যন্ত যত ইলেক্টোরাল বন্ড বিক্রি হয়েছে তার মধ্যে ১ লক্ষ থেকে ১ কোটি মূল্যের ৯৯ শতাংশ বন্ডই কিনেছে কর্পোরেটরা।
দ্বিতীয়ত, ইলেক্টোরাল বন্ড বিক্রির একমাত্র অধিকারী স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া। যেহেতু স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া বর্তমানে শাসকদলের পরিধির মধ্যে, সেক্ষেত্রে কোন সংস্থা বা ব্যক্তি ইলেক্টোরাল বন্ড কিনছে তা ক্ষমতাসীন শাসকের পক্ষে জানা সহজ। এক্ষেত্রে বিরোধী রাজনৈতিক কোনও দলকে কেউ ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে অনুদান দিলে ক্ষমতাসীন সরকারের পক্ষে সেই ব্যক্তি বা সংস্থাকে প্রভাবতি করার সম্ভাবনা থেকে যায়।
তৃতীয়ত, এক সংশোধনীর মাধ্যমে বিদেশি কর্পোরেটদের জন্য ইলেক্টোরাল বন্ডের দরজা খুলে দেওয়া হয়েছিল। ইলেক্টোরাল বন্ডের সমালোচকদের বক্তব্য অনুসারে, এর ফলে বিভিন্ন বিদেশি সংস্থা দেশের সরকার পরিচালনায় প্রভাব খাটাতে পারে।
শীর্ষ আদালত কী নির্দেশ দিল?
প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন ৫ বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়াকে (SBI) ২০১৯ সালের ১২ এপ্রিলের পর থেকে কেনা সমস্ত নির্বাচনী বন্ডের বিশদ তথ্য ৬ মার্চের মধ্যে নির্বাচন কমিশনের কাছে জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। এরপর সেই তথ্য প্রকাশ্যে আনবে কমিশন। SBI-কে অবিলম্বে বন্ড বিক্রি বন্ধ করার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। ডিভিশন বেঞ্চের অন্য বিচারপতিরা হলেন বিচারপতি সঞ্জীব খান্না, বিচারপতি বি আর গাভাই, বিচারপতি জে বি পারদিওয়ালা এবং বিচারপতি মনোজ মিশ্র।
এই প্রকল্পটি রাইটস টু ইনফরমেশন এবং সংবিধানের ১৯(১)(এ) ধারা লঙ্ঘন করে, তাই এই প্রকল্প বাতিল হওয়া উচিত বলে পর্যবেক্ষণ শীর্ষ আদালতের। শীর্ষ আদালত বলেছে, নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে কালো টাকার সমস্যা মোকাবিলার যে দাবি কেন্দ্র সরকার করেছে, তা সমর্থনযোগ্য নয়। কে অনুদান দিচ্ছে, তাঁর নাম প্রকাশ করা আবশ্যক।
আগামী ৬ মার্চের মধ্যে এখনও পর্যন্ত বিক্রিত সমস্ত ইলেক্টোরাল বন্ডের বিস্তারিত তথ্য নির্বাচন কমিশনের কাছে জমা দেবার নির্দেশ দিয়েছে শীর্ষ আদালত। নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে ১৩ মার্চ-এর মধ্যে এই সমস্ত তথ্য প্রকাশ করারও নির্দেশ দিয়েছে শীর্ষ আদালত।
ইলেক্টোরাল বন্ড সম্পর্কে অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মস-এর পর্যবেক্ষণ -
নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে ২০২১-২২ সাল পর্যন্ত সমস্ত রাজনৈতিক দল অনুদান পেয়েছে মোট ৯,১৮৮ কোটি টাকারও বেশি। যার মধ্যে ADR (অ্যাসোসিয়েশন অফ ডেমোক্রেটিক রিফর্মস)-এর তথ্য অনুসারে, বিজেপি এককভাবে এই অনুদানের ৫৭ শতাংশ পেয়েছে। কংগ্রেস পেয়েছে ১০ শতাংশের কিছু বেশি।
এডিআর আরও জানিয়েছে, ২০১৬-১৭ থেকে ২০২১-২২-এর মধ্যে ৭টি জাতীয় দল এবং ২৪টি আঞ্চলিক দল প্রায় ১৬,৪৩৭ কোটি টাকার অনুদান পেয়েছে। যার মধ্যে, ৯,১৮৮.৩৫ কোটি টাকা বা প্রায় ৫৬ শতাংশ এসেছে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন