আর কোনও রাখঢাক না রেখে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে বিনায়ক দামোদর সাভারকরকে একাসনে বসিয়েছে মোদী সরকার। তাও আবার এটি করা হয়েছে গান্ধীজীর নামাঙ্কিত মিউজিয়াম থেকে প্রকাশিত পত্রিকায়। বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই বিতর্ক শুরু হয়েছে। তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন গান্ধীজীর প্রপৌত্র তুষার গান্ধী, কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরি, লেখক-সাংবাদিক ধীরেন ঝা প্রমুখ।
গান্ধীজীর নামাঙ্কিত 'গান্ধী স্মৃতি অ্যান্ড দর্শন স্মৃতি' (GSDS)' মিউজিয়াম থেকে প্রকাশিত হয় 'অন্তিম জন' নামে ম্যাগাজিন। এই ম্যাগাজিনে শুধু সাভারকরের বন্দনাই নয়, মহাত্মা গান্ধীর চেয়ে তিনি (সাভারকর) কোনও অংশে কম ছিলেন না বলে দাবি করা হয়েছে। প্রচ্ছদেও ছাপা হয়েছে সাভারকরের ছবি। এই গান্ধী স্মৃতি মিউজিয়ামের চেয়ারম্যান খোদ প্রধানমন্ত্রী। তাতেই আরও জোরদার হয়েছে এই বিতর্ক।
'অন্তিম জন'-র জুন সংখ্যায় সাভরকরের 'হিন্দুত্ব' নিয়ে লেখা প্রকাশ করা হয়েছে। গান্ধীজীর ধর্মীয় সহিষুতা নিয়ে এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর সাভারকরকে নিয়ে লেখা প্রকাশ করা হয়েছে ওই পত্রিকায়। এইগুলি সবই পুরোনো লেখা। সাভারকরের অতি পরিচিত 'হিন্দুত্ব' বইয়ের একটা অংশই 'হিন্দুত্ব' শিরোনামে ছাপা হয়েছে এই পত্রিকায়। এছাড়াও সাভারকরকে নিয়ে অন্যান্য লেখকদের প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে ওই পত্রিকায়, যেমন - 'দেশভক্ত সাভারকর', ‘বীর সাভারকর এবং মহাত্মা গান্ধী'। পত্রিকার সম্পাদক প্রবীণ দত্ত শর্মা লিখেছেন, 'গান্ধী কা গুসসা'।
সাভারকরকে নিয়ে তৈরি প্রচ্ছদের মুখবন্ধ লিখেছেন ‘গান্ধী স্মৃতি অ্যান্ড দর্শন স্মৃতি’ মিউজিয়ামের ভাইস চেয়ারম্যান তথা বিজেপি নেতা বিজয় গোয়েল। তাতে সাভারকরকে 'মহান দেশপ্রেমিক' বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। তিনি বলেন, 'যেমন ছিলেন নেহেরু, যেমন ছিলেন প্যাটেল, তেমনি সাভারকর। আমরা ওদের আত্মত্যাগ থেকে শিক্ষা নিয়েছি।' ব্রিটিশ শাসনে কেউ সাভারকরের মত এতদিন জেলে ছিলেন না বলে তিনি দাবি করেছেন।
সাভারকর যে ব্রিটিশকে পর পর মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পেয়েছিলেন, সেই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে গোয়েল একটি সংবাদপত্রকে বলেন, 'অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় যাঁরা একদিনও জেল খাটেননি, সমাজে যাঁদের কোনও অবদান নেই, সাভারকরের মতো দেশপ্রেমিকেরও সমালোচনা করার দুঃসাহস দেখান তাঁরা। ভারতের ইতিহাস এবং স্বাধীনতা আন্দোলনে সাভারকরের স্থান এবং সম্মান মহাত্মা গাঁধীর থেকে কোনও অংশে কম নয়।'
১৯৪৮ সালে দিল্লির তিস জানুয়ারি মার্গে গান্ধীজিকে হত্যা করা হয়েছিল। এই জায়গাতেই গান্ধীজীর সমাধি এবং স্মৃতিসৌধ গড়ে তোলা হয়। পরে সেটিকে মিউজিয়ামে রূপান্তরিত করা হয়। এই দুইয়ে মিলে ‘গান্ধী স্মৃতি অ্যান্ড দর্শন স্মৃতি’ মিউজিয়াম। বর্তমানে, এই মিউজিয়ামের চেয়ারম্যান খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
এই ঘটনায় গান্ধীজীর প্রপৌত্র তুষার গান্ধী বলেন, ‘এটা একটা প্রতারণা।’ মোদী সরকারের প্রতি আক্রমণ করে তিনি একটি নিউজ পোর্টালকে বলেন, ‘এই প্রশাসন আরও বেশি বেশি করে গান্ধীবাদী প্রতিষ্ঠানগুলিকে দখল করতে চাইছে। গান্ধীবাদী মতাদর্শের উপরে বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শকে চাপিয়ে দেওয়ার বিপদ হাজির হয়েছে। আমরা এর প্রতিবাদ করছি।’
কঠোর ভাষায় তুষার গান্ধী বলেন, ‘এই পদক্ষেপ থেকে প্রমাণ হচ্ছে কিভাবে ওরা সাভারকরকে গান্ধীজীর সমতুল্য করতে চাইছে। এর থেকে প্রমাণ হয় সাভারকরকে নিয়ে ওদের বিশ্বাস কত অসাড় এবং নড়বড়ে।’ তিনি জানান, ‘গান্ধীবাদী আদর্শকে দূষিত করতে এবং বর্তমান সরকারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় এমন ভাষ্য তৈরি করার জন্য পরিকল্পিতভাবে এসব করা হচ্ছে।’
লোকসভায় কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরি বলেন, ‘সাভারকরকে বিরাট করে তোলার চেষ্টা হচ্ছে। এটা আরএসএস'র অ্যাজেন্ডা। কিন্তু ইতিহাস বলছে সাভারকর দৃঢ়তার সঙ্গেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। বর্তমান সরকারকে খুশি করতে দেশের ইতিহাসকে বিকৃত করা হচ্ছে।’ অধীর চৌধুরি জানান, ‘অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতোই গান্ধী স্মৃতি মিউজিয়ামেরও অবনমন ঘটাচ্ছে কেন্দ্র সরকার।’
‘গান্ধী'স অ্যাসাসিন: নাথুরাম গডসে অ্যান্ড দ্য মেকিং অফ হিজ আইডিয়া অফ ইন্ডিয়া’ (Gandhi’s Assassin: The Making Of Nathuram Godse And His Idea Of India)- গ্রন্থের লেখক, সাংবাদিক ধীরেন ঝা বলেছেন, গান্ধী হত্যায় সাভারকর একজন অভিযুক্ত। যদিও তিনি ছাড়া পেয়ে গিয়েছিলেন, যেহেতু অভিযোগ প্রমাণ করা যায়নি। গান্ধীজীর হত্যার যড়যন্ত্র যথাযথভাবে তদন্ত হয়নি বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, গান্ধীজীকে হত্যার ষড়যন্ত্র খতিয়ে দেখার জন্য কাপুর কমিশন গঠিত হয়েছে অনেক পরে, ১৯৬৬ সালে। কমিশন প্রথমে বলেছিল, সাভারকর এবং তার সঙ্গীরা গান্ধীজীকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন