১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট, একেবারে মধ্যরাতে সরকারিভাবে দিল্লির লালকেল্লার উপর তেরঙ্গা উড়িয়ে ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয় ভারত। মধ্যরাতে স্বাধীন হওয়ায় তারপর থেকে গত ৭৫ বছর ধরে দেশের কোটি কোটি মানুষ ১৫ আগস্ট দিনটিকেই ‘স্বাধীনতা দিবস’ হিসেবে পালন করেন। বিভিন্ন ক্লাব, স্কুল-কলেজ-সরকারি দফতর বা প্রতিষ্ঠানগুলিতে এইদিনই তেরঙ্গা উড়িয়ে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করা হয়।
কিন্তু আপনি কি জানেন, এই দেশে এমন অনেক জায়গা রয়েছে যেখানে ১৫ আগস্ট নয়, ১৮ আগস্ট ‘স্বাধীনতা দিবস পালন করা হয়! অবাক হচ্ছেন? বেশিদূর যেতে হবে না, এই রাজ্যেই রয়েছে সেই জায়গাগুলি। শুনলে আশ্চর্য হবেন, তবে এটাই সত্যি যে পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া, মালদা, মুর্শিদাবাদের একটা বড় অংশ এবং উত্তর ২৪ পরগণা ও দক্ষিণ দিনাজপুরে এমন বেশ কিছু গ্রাম রয়েছে যেখানকার মানুষ ১৮ আগস্ট দিনটিকেই তাঁদের ‘স্বাধীনতা দিবস’ হিসেবে পালন করেন। কেন?
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার সময় যখন ভারত ও পাকিস্তান যথাক্রমে হিন্দু ও মুসলিম প্রধান দেশ হিসেবে দু’ভাগ হওয়ার মুখে, তখন দুই দেশের মধ্যে সীমানা ভাগের মূল দায়িত্বে ছিলেন সিরিল র্যাডক্লিফ। অবিভক্ত ভারতবর্ষের কোন অংশ ভারতের আর কোন অংশ পাকিস্তানের, সেই সীমা নির্দেশনার পুরোটাই হয়েছিল র্যাডক্লিফ সাহেবের তত্ত্বাবধানেই। সেই সময় তাঁর নির্দেশেই এই বাংলার মালদা ও নদিয়া জেলার বেশিরভাগটাই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্গত হয়ে যায়। মালদা-নদিয়া ছাড়াও মুর্শিদাবাদ-সহ আরও কয়েকটি বর্তমান ইন্দো-বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া জেলার অংশকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়।
বেতারে দেশভাগ ও হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল হয়েও পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্তিকরণের খবর শুনে আতঙ্কে শিউরে ওঠেন ওই সমস্ত অঞ্চলের বাসিন্দারা। যার ফলে, ১৫ আগস্ট যখন গোটা দেশের মানুষ ২০০ বছরের পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্তির আনন্দে মেতে ওঠে, তখন বাংলার নদিয়া-মালদা জেলাগুলির মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে ভয় ও প্রতিবাদের আগুন। সেই প্রতিবাদ দেখেই ভারতের শেষ ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেন হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলকে ভারতের ভাগে এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলকে পাকিস্তানের ভাগে অন্তর্ভুক্তির কড়া আদেশ দেন। সেই নির্দেশ মেনে সীমানা কমিশন ১৭ আগস্ট মধ্যরাতে তাঁদের ভুল সংশোধন করে। এরপরেই ১৮ আগস্ট সাত-সকালেই মালদার ইংলিশবাজারের বাবুপাড়ায় ভারতের তেরঙ্গা ওড়ানো হয়। ওইদিনই প্রথমবার নদিয়া-মালদার মানুষ স্বাধীনতার আনন্দে মেতে ওঠেন।
পরবর্তীতে ১৯৯১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিমহা রাওয়ের অনুমতি নিয়েই নদিয়া জেলার শিবনিবাস-সহ একাধিক গ্রামের বাসিন্দারা ১৮ আগস্টকেই স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালন করা শুরু করেন। এরপর ২০০৮ সালে উত্তর ২৪ পরগণার বনগাঁ বার অ্যাসোসিয়েশনের তরফে বনগাঁ আদালত চত্বরে ১৫ আগস্টের বদলে ১৮ আগস্ট জাতীয় পকাতা উত্তোলন করা হয়। এইভাবেই ওই জেলাগুলির কৃষ্ণনগর, শান্তিপুর, রানাঘাট, শিকারপুর, করিমপুর, বালুরঘাটের মতো আধা মফঃস্বল শহরগুলিতেও ধীরে ধীরে সরকারিভাবে ১৮ আগস্ট দিনটিকেই স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন