দুই ছোটো রাজ্যে একই পদ্ধতিতে সাফল্য লাভের পর এবার বিজেপির নজরে ঝাড়খন্ড। ঠিক যে পদ্ধতি নিয়ে ছত্তিশগড় এবং হরিয়ানায় বিজেপি সফল হয়েছে সেই পদ্ধতিতেই ঝাড়খন্ডেও বাজিমাত করতে চাইছে বিজেপি। যে কোনও মূল্যে এই রাজ্যে ক্ষমতায় আসতে বদ্ধপরিকর দেশের শাসক দল। যদি তা হয়, তাহলে আগামী বছর বিহার বিধানসভা নির্বাচনে দল অনেকটাই সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবে বলে মনে করছে বিজেপি নেতৃত্ব। যদিও ঝাড়খন্ডে হেমন্ত সোরেন সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার হাওয়া বইছে, কিন্তু অন্য দুই রাজ্যের কৌশল এখানেও কাজ করবে কিনা তা জানতে অপেক্ষা করতে হবে আগামী ২৩ নভেম্বর পর্যন্ত।
২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে ঝাড়খন্ডে অনেকটাই এগিয়ে ছিল বিজেপি তথা এনডিএ। রাজ্যের ১৪ আসনের মধ্যে সেবার এনডিএ জয়ী হয় ১২ আসনে এবং ইউপিএ জয়ী হয় ২ আসনে। লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল অনুসারে ৬৩ বিধানসভা আসনে এগিয়ে ছিল বিজেপি এবং ১৮ আসনে ইউপিএ। সেবার মনে করা হয়েছিল বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির জয় সময়ের অপেক্ষা। যদিও সমস্ত সম্ভাবনা উল্টে দিয়ে বিজেপিকে ২৫ আসনেই থামিয়ে দিয়েছিল ঝাড়খন্ডের মানুষ। উল্টোদিকে ঝাড়খন্ড মুক্তি মোর্চা, কংগ্রেস এবং আরজেডি জোট পায় যথাক্রমে ৩০, ১৬ এবং ১টি আসন।
২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে ঝাড়খন্ডের ১৪ আসনের মধ্যে এনডিএ শিবির জয়ী হয়েছে ৯ আসনে এবং ইন্ডিয়া মঞ্চ পেয়েছে ৫ আসন। সেই হিসেবে গতবারের মত এবারের আসন সংখ্যা এবং ভোট শতাংশের হারে অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে এনডিএ শিবির। যদিও বিধানসভা ভোটেও যে সেই হিসেবেরই পুনরাবৃত্তি হবে তা কোনও রাজনৈতিক বিশ্লেষকই জোর দিয়ে বলতে পারছেন না ২০১৯-এর লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচনের পরিসংখ্যান মনে রেখে।
২০১৯-এর নির্বাচনের ফলাফল মাথায় রেখে বিজেপি এবারের নির্বাচনে ঘুঁটি সাজাচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে বিজেপি জয়ের জন্য জেএমএম বিরোধী ভোট একজায়গায় করতে সম্ভাব্য সমস্তরকমের পদক্ষেপ নিলেও তা শেষ পর্যন্ত কার্যকরী হবে কিনা এখনই বলা যাচ্ছে না। ইতিমধ্যেই আজসুর সঙ্গে বোঝাপড়া, জেডিইউ এবং এলজেপি (চিরাগ পাশোয়ান)-র সঙ্গে বোঝাপড়া সম্পন্ন হয়েছে।
এছাড়াও তফশিলি জাতি, উপজাতি, কুড়মি ভোট পক্ষে টানতেও সচেষ্ট বিজেপি। কারণ ঝাড়খন্ডে মোট ভোটারের ১২ শতাংশ তফশিলি জাতি, ২৭ শতাংশ তফশিলি উপজাতি এবং ১২ থেকে ১৬ শতাংশ কুড়মি ও মাহাতো ভোট। বাবুলাল মারান্ডির ঝাড়খন্ড বিকাশ মোর্চাকে বিজেপির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া কিংবা রঘুবর দাসকে ওড়িশার রাজ্যপাল করে পাঠানোও সেই লক্ষেই। একইভাবে জেএমএম ভেঙে চম্পাই সোরেনকে বিজেপিতে আনার লক্ষও এক।
২০১৯ ঝাড়খন্ড বিধানসভা নির্বাচনে এনডিএ শিবিরে কোনও আসনরফা হয়নি। ফলে বিজেপি এককভাবে ৭৯ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। বাবুলাল মারান্ডির ঝাড়খন্ড বিকাশ মোর্চা লড়ে ৮১ আসনে। অল ঝাড়খন্ড স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (আজসু) এককভাবে লড়াই করে ৫৩ আসনে। যে ভোট ভাগাভাগির কারণে বহু আসনে বিজেপির জয় কঠিন হয়ে যায়।
এবার যাতে কোনোভাবেই ভোট ভাগাভাগি হয়ে বিজেপির জয় কঠিন না হয় তাই সব শিবিরকে খুশি করার চেষ্টা চলছে বিজেপির পক্ষ থেকে। সেই লক্ষ্যেই প্রার্থী করা হয়েছে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মধু কোড়ার স্ত্রী গীতা কোড়া কিংবা শিবু সোরেনের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় সীতা সোরেনকে। এর পাশাপাশি জেএমএম, কংগ্রেস শিবিরকেও ভাঙানোর লাগাতার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। জেএমএম-এর চম্পাই সোরেনের মত হালে কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন প্রভাবশালী কংগ্রেস নেতা মানস সিনহা।
এছাড়াও নির্বাচন ঘোষণার আগে থেকেই ঝাড়খন্ডের দায়িত্ব দিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মাকে। যিনি ঝাড়খন্ড জুড়ে লাগাতার প্রচার চালাচ্ছেন। বিরোধীদের অভিযোগ, দলীয় প্রচারে বেশিরভাগ সময়েই চড়া সাম্প্রদায়িকতার ব্যবহার করছেন হিমন্ত। ইতিমধ্যেই এই বিষয়ে অভিযোগ জানিয়েছেন রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী ও জেএমএম নেতা হেমন্ত সোরেন।
হিমন্ত বিশ্ব শর্মার বক্তব্য অনুসারে, ঝাড়খন্ডে আদিবাসী, তফশিলিদের সংখ্যা দ্রুত কমছে এবং সেই জায়গা বর্তমান রাজ্য সরকারের মদতে ভরাট করছে বহিরাগত রোহিঙ্গারা। হিমন্তের দাবি, বাংলাদেশ থেকে মুর্শিদাবাদ হয়ে ঝাড়খন্ডে ঢুকছে রোহিঙ্গারা। যার ফলে আদিবাসী, তফশিলি হিন্দু জনসংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। যদিও অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই হিমন্তের দাবির সঙ্গে সহমত নয়।
এবারের ঝাড়খন্ড বিধানসভা নির্বাচনে এনডিএ অথবা ইন্ডিয়া মঞ্চ দুই শিবিরকেই যথেষ্ট বেগ দিতে পারে জয়রাম মাহাতোর দল ঝাড়খন্ড লোকতান্ত্রিক ক্রান্তিকারি মোর্চা। যদিও গত লোকসভা নির্বাচনে ৮ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এই দল মূলত পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ইন্ডিয়া মঞ্চেরই। একাধিক লোকসভা আসনে ভোট কেটে তারা বিজেপির জয়ের পথ মসৃণ করেছে। এবারের বিধানসভা নির্বাচনে নির্বাচনে ৭৬ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে জেএলকেএম। এই দল কোন দলের কত ভোট কাটবে তার ওপরেও বহু আসনের জয় পরাজয় নির্ধারিত হবে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল।
অন্যদিকে ইন্ডিয়া মঞ্চের বড়ো শরিক হিসেবে কংগ্রেস নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও আগের বারের পাওয়া ১৬ আসন কংগ্রেস এবারেও ধরে রাখতে পারবে কিনা তা এখন স্পষ্ট নয়। কারণ শহরাঞ্চলের যেসব আসনে কংগ্রেস প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে তার অধিকাংশতেই বিজেপির সঙ্গে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। যেহেতু ঝাড়খন্ড জুড়ে হেমন্ত সোরেন সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানবিরোধী হাওয়ার চোরাস্রোত বইছে তার মোকাবিলা করে আসন ধরে রাখা কংগ্রেসের কাছে চ্যালেঞ্জের। হরিয়ানার ফলাফল ইন্ডিয়া মঞ্চের অনুকূলে না যাওয়াও ঝাড়খন্ড ভোটে কংগ্রেসের মাইনাস পয়েন্ট।
তবে চুপচাপ বসে নেই হেমন্ত সোরেনও। বিজেপির সম্ভাব্য সমস্ত আক্রমণের মোকাবিলায় তিনিও গুটি সাজাচ্ছেন নিজের মত করে। আসন সমঝোতা নিয়ে বারবার আলোচনার মাধ্যমে তিনি বিবাদ মিটিয়ে নিতে চেষ্টা করেছেন কংগ্রেস, আরজেডি এবং সিপিআইএমএল-এর সাথে। এবারের নির্বাচনেও জয়ের বিষয়ে জেএমএম-কংগ্রেস-আরজেডি-র ইন্ডিয়া মঞ্চ যথেষ্ট আশাবাদী। রাজ্যে প্রতিষ্ঠানবিরোধীতার হাওয়া থাকলেও এখনও হেমন্ত সোরেনের জনপ্রিয়তা প্রশ্নাতীত। রাজ্যে বিজেপির প্রচার সম্পর্কে হেমন্ত সোরেনের অভিযোগ, বিজেপি এই রাজ্যের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশ নষ্ট করার চেষ্টা চালাচ্ছে। রাজ্যের মানুষই এর মোকাবিলা করবেন।
ঝাড়খণ্ডে মোট ভোটার সংখ্যা ২ কোটি ৬০ লক্ষ। যার মধ্যে ১ কোটি ৩১ লক্ষ পুরুষ এবং ১ কোটি ২১ লক্ষ মহিলা। ২০ থেকে ২৯ বছর বয়সী ভোটারের সংখ্যা প্রায় ৬৬ লক্ষ এবং এবার প্রথম ভোট দেবেন এরকম ভোটারের সংখ্যা প্রায় ১১ লক্ষ।
দুই দফা মিলিয়ে ঝাড়খন্ডের ৮১ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন মোট ১২১১ জন প্রার্থী। যার মধ্যে প্রথম দফার জন্য প্রার্থী ৬৮৩ জন এবং দ্বিতীয় দফায় প্রার্থী আছেন ৫২৮ জন। প্রথম দফায় ১৩ নভেম্বর ঝাড়খন্ডে ভোট হবে ৪৩ আসনে এবং দ্বিতীয় দফায় ভোট হবে ৩৮ আসনে। সবথেকে বেশি প্রার্থী আছেন ধানওয়ার কেন্দ্রে। প্রার্থী সংখ্যা ২৪ এবং সর্বনিম্ন প্রার্থী সংখ্যা দেওঘর কেন্দ্রে। যেখানে প্রার্থী হয়েছেন ৭ জন।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন