বিরোধী দলের মঞ্চ ‘ইন্ডিয়া’ সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য তাঁর অতীত রাজনৈতিক অবস্থান পরিবর্তনের ইতিহাসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
গত ২ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিকদের সাথে আলাপচারিতার সময় তিনি বলেছিলেন, আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস সারা দেশে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে এবং শতাব্দী প্রাচীন দলের পক্ষে ৪০ টি আসন জেতাও কষ্টসাধ্য হবে।
তিনি আরও বলেছিলেন, উত্তর ভারতের গেরুয়া শাসিত রাজ্যগুলিতে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই করার মতো শক্তি কংগ্রেসের নেই।
যদিও, লোকসভা নির্বাচনের মাত্র তিনটি পর্যায় বাকি থাকার সময় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের আগের অবস্থান থেকে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেছেন এবং সম্প্রতি বলতে শুরু করেছেন যে ইন্ডিয়া মঞ্চ লোকসভা নির্বাচনে ৩১৫টি আসন পাবে, যেখানে বিজেপির পক্ষে সর্বাধিক ১৯৫টির বেশি আসন জেতা সম্ভব হবেনা।
তৃণমূল সুপ্রিমোর সাম্প্রতিক এই মন্তব্যের পর, নির্বাচন বিশ্লেষকদের প্রশ্ন, ইন্ডিয়া মঞ্চের অংশীদার কংগ্রেস যদি ৪০ আসনে আটকে যায় তাহলে ইন্ডিয়া মঞ্চ কীভাবে ৩১৫টি আসন পাবে”
মুখ্যমন্ত্রীর কথায় বিভ্রান্তি আরও বেড়েছে কারণ যদিও তিনি ইন্ডিয়া মঞ্চ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করছেন, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের সম্ভাব্য আসন সংখ্যা কত হতে পারে সে বিষয়ে মুখ খোলেননি।
তাঁর সাম্প্রতিক বিবৃতি অনুসারে, কেন্দ্রে সম্ভাব্য ইন্ডিয়া মঞ্চ সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থন দেবে তৃণমূল। যদিও এর আগে তিনি জানিয়েছিলেন ইন্ডিয়া মঞ্চের সরকারে তৃণমূল নেতৃত্ব দেবে।
এক্ষেত্রে প্রশ্ন হল, তাঁর ভবিষ্যৎবাণী অনুসারে যদি সত্যিই ইন্ডিয়া মঞ্চ ৩১৫ টি আসন পেয়ে যায়, সেক্ষেত্রে ইন্ডিয়া মঞ্চের জন্য তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থন কতটা প্রয়োজনীয় হবে?
বিজেপির রাজ্য নেতৃত্ব অবশ্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই ধরনের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যকে গুরুত্ব দিতে নারাজ। অন্যদিকে কংগ্রেস এবং সিপিআই(এম) শীর্ষ নেতৃত্ব এই ইস্যুতে তাঁর কড়া সমালোচনা করেছে।
পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি এবং পাঁচবারের লোকসভা সাংসদ অধীর রঞ্জন চৌধুরী জানিয়েছেন, এই ধরনের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য মুখ্যমন্ত্রীর ক্রমাগত রাজনৈতিক অবস্থান পরিবর্তনের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ।
অধীর আরও বলেন, “আমি ওঁকে বিশ্বাস করি না। উনি ইন্ডিয়া মঞ্চ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। আমরা জাতীয় স্তরে শক্তিশালী হয়ে উঠছি বুঝতে পেরে এখন তিনি আবার আমাদের সাথে যোগ দেবার চেষ্টা করছেন।”
CPI(M) সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি এই প্রসঙ্গে বলেন, গত কয়েক মাস ধরে ইন্ডিয়া মঞ্চের সাথে সম্পূর্ণ অসহযোগিতার পরে, তাঁর এই ধরনের পরস্পরবিরোধী মন্তব্য আমাদের কাছে অর্থহীন।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা অবশ্য বলছেন, ১৯৯৮ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কংগ্রেস ভেঙে তৃণমূল কংগ্রেস গঠন করার পর থেকে একাধিকবার এই ধরনের ইউ-টার্ন রাজনীতি করেছেন।
শুরুতে তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপির সাথে জোট করেছিল এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রয়াত অটল বিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন সরকারে রেলের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হয়েছিলেন।
এরপর, ২০০১ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক আগে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে ঘুষের ঘটনা নিয়ে তেহেলকা স্টিং-অপারেশনের পরে তিনি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন এবং শক্তিশালী সিপিআই(এম)-এর নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য কংগ্রেসের সাথে জোটবদ্ধ হন।
২০০১ সালে বামফ্রন্ট বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার সাথে ক্ষমতায় ফিরে আসার পরে, তিনি আবার কংগ্রেসের সাথে তার সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং ফের বিজেপির সাথে জোট করেন এবং আবারও কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী হন।
এরপর, ২০০৪ লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস চূড়ান্ত বিপর্যয়ের মুখে পড়ে এবং শুধুমাত্র মমতা ব্যানার্জি কলকাতা-দক্ষিণ কেন্দ্র থেকে জয়ী হন। রাজ্যের বাকি সব কেন্দ্রে তৃণমূলের পরাজয় হয়।
এর পরেই তিনি আবারও বিজেপি থেকে দূরত্ব বাড়াতে শুরু করেন। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে তিনি কংগ্রেসের সাথে জোট বাঁধেন। এরই আগেই বাম দলগুলি পরমাণু চুক্তি বিতর্কের জেরে ডঃ মনমোহন সিং-এর নেতৃত্বাধীন ইউপিএ-১ সরকারের থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে।
কংগ্রেসের সাথে জোট করে পশ্চিমবঙ্গে ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে চমত্কার ফলাফলের পর, তিনি ২০১১ সালের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত দেশের প্রাচীনতম জাতীয় দলের সাথে সেই রাজনৈতিক বন্ধুত্ব বজায় রেখেছিলেন। এই নির্বাচনেই ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট শাসনের সমাপ্তি হয় এবং রাজ্যে তৃণমূল শাসনের সূচনা হয়।
এর পরেই কংগ্রেসের সাথে তৃণমূলের সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে তৃণমূলের বিরুদ্ধে দল ভাঙানোর অভিযোগ আনা হয়। এর কিছুদিন পরেই ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে কংগ্রেস এবং তৃণমূল কংগ্রেসের জোট আবারও ভেঙে যায়।
- with Agency Inputs
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন