তৃণমূল প্রথম থেকেই জানত তাঁরা হারবে। তাই প্রথম থেকেই নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করার চেষ্টা করেছে। মানুষ ক্ষুব্ধ, বিরক্ত। তাঁরা সেটা ব্যালটের মাধ্যমে প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। আমি ধন্যবাদ জানাই সেই সব মানুষকে, সেই সব বামপন্থী কর্মীদের যারা যান কবুল লড়াই দিয়েছেন। মঙ্গলবার কলকাতায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে একথা বলেন সিপিআইএম রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম।
তিনি আরও বলেন, পঞ্চায়েতের নির্বাচন তো নয়। যেন মাফিয়ারাজ কায়েম রাখার জন্য যুদ্ধ। মনোনয়ন পর্ব থেকে যা শুরু হয়েছে, প্রত্যাহার পর্ব, নির্বাচনের দিন, হিংসা, তার বলি, উপনির্বাচন, তার তালিকা পর্যন্ত, যেভাবে বামপন্থীদের জোর করে লড়াই থেকে সরানোর চেষ্টা করা হয়েছে, সবজায়গায় বাতিল করাতে পারেনি, প্রত্যাহার করাতে পারেনি, ব্যালটে নাম পর্যন্ত দেয়নি এরকমও হয়েছে।
এদিন সাংবাদিকদের সেলিম বলেন, যেখানে মিডিয়া রিপোর্ট করলো ছাপ্পা হয়েছে, লুঠ হয়েছে সেটাকে বাদ দিয়ে কালীঘাট, ক্যামাক স্ট্রীট থেকে যে লিস্ট দেওয়া হল তা অনুসারে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হল।
তিনি আরও বলেন, আমি চ্যালেঞ্জ করছি, যে সমস্ত বুথে পুনঃনির্বাচন হয়েছে, ফলাফল এলে স্পষ্ট হয়ে যাবে কীভাবে এক লাইনে ভোট লুটেরা, মস্তান, পুলিশের একটা বড়ো অংশ, রাজ্য প্রশাসনের সর্বোচ্চ অংশ এবং রাজ্য নির্বাচন কমিশন এক সাথে কাজ করেছে।
পঞ্চায়েত নির্বাচনে মানুষের ভূমিকা মনে করিয়ে দিয়ে এদিন তিনি বলেন, একদিকে তৃণমূল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে না দেবার, গণতন্ত্র লুঠ করার, লুটের পঞ্চায়েত বজায় রাখার চেষ্টা করেছে। অন্যদিকে লাল ঝান্ডা নিয়ে, কংগ্রেস, আইএসএফ-কে সঙ্গে নিয়ে লড়াই জারি রেখেছে। আজও সারাদিন সেই লড়াই চলছে। মধ্যরাত পর্যন্ত চলবে। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। লুটেরাদের তাড়িয়ে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার লড়াই, গণতন্ত্র রক্ষা করার, প্রতিষ্ঠা করার লড়াই চালিয়ে নিয়ে যেতে সিপিআইএম বদ্ধপরিকর। এ লড়াই চলবে। এ এক লাগাতার সংগ্রাম। রক্তাক্ত হলেও, আক্রান্ত হলেও, বাড়ি ছাড়া হলেও এই লড়াই চলবে। বাঙলার মানুষ এই মাফিয়া রাজ থেকে উদ্ধার করবে।
পঞ্চায়েত নির্বাচনের গণনা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সিপিআইএম রাজ্য সম্পাদক বলেন, আজ সকালে গণনা শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ কাউন্টিং এজেন্টদের লাঠি চালিয়ে বের করে দিয়েছে। কাউন্টিং এজেন্টদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। আজও বহু জায়গায় কাউন্টিং সেন্টারে বিধায়করা বসে আছে। সিপিআইএম যেখানে জিতছে সেখানে বারবার কাউন্টিং করানো হচ্ছে। জেতা প্রার্থীকে সার্টিফিকেট দেওয়া হয়নি। সার্টিফিকেট দিয়েও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। যেখানে সেসব করে পারেনি সেখানে ব্যালটে কালি ছিটিয়ে দিয়েছে, সিপিআইএম-এর ছাপ মারা ব্যালট জানলা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে।
রাজ্যের মানুষকে অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বলেন, একটা বড়ো অংশের মানুষ এই লড়াইতে সামিল হয়েছেন। তাঁরা প্রকাশ্যে তৃণমূলের গুন্ডামির বিরোধিতা করতে রাস্তায় নেমেছেন। ভোট দিয়েছেন। ভোটের প্রক্রিয়ায় সাহায্য করেছেন। এমনকি মহিলারাও এই লড়াইতে সামিল হয়েছেন। এটা বাঙলার রাজনীতির ক্ষেত্রে একটা বড়ো মোড়।
রাজ্যের শাসকদলের বিরুদ্ধে গুন্ডামির অভিযোগ এনে তিনি বলেন, ওরা ভেবেছিল বোমা পিস্তল দেখিয়ে, গুন্ডামি করে মানুষকে ভয় দেখিয়ে নিষ্ক্রিয় করে রেখে দেবে। কিন্তু বাঙলার মানুষ নির্জীব নয় এটা আজ প্রমাণিত। কিন্তু এই লড়াই এখানেই শেষ নয়। এই লড়াই চলবে। ৪০ জনের বেশি মানুষ মারা গেছেন। তাঁরা যে পক্ষেরই মানুষ হন তাঁদের স্মরণে রাখতে হবে।
এদিন সেলিম বলেন, আজও বহু এসপি, ডিএম ফোন তোলেননি। যেসব জায়গায় গণ্ডগোল হয়েছে সেই সব জায়গার এসপি, ডিএম ক্যামাক স্ট্রীটের অফিসের নির্দেশে প্রভুভক্তি প্রমাণ করছেন। তাঁরা নির্বাচন কমিশনের গাইডলাইন, ম্যানুয়াল কিছুই মানেননি।
নির্বাচন কমিশন প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে এদিন তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের সাইট কাজ করছে না। ডিজিটাল সাইট। তৃণমূলের ফল খারাপ হলে কমিশনের সাইট বসে যায়। আপডেট করা হচ্ছে না। মনোনয়ন পর্ব থেকে আমরা দেখেছি আপডেট করা হচ্ছেনা। মনোনয়ন পর্ব থেকে আমরা বলছি আপডেট করা হয়নি।
ভোট গণনা পদ্ধতি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, এখনও দাবি করছি পঞ্চায়েত সমিতি, জেলা পরিষদে সঠিক ভাবে গণনা করার। মানুষ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছে। যারা অবৈধ প্রবেশ করে আছে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের যদি মুরোদ থাকে তাহলে তারা নির্দেশ দিন তাঁদের অবিলম্বে বের করে দেওয়ার।
তিনি আরও বলেন, পূর্ব বর্ধমানের রায়না। পলাসনে ১৮টার মধ্যে ১৮টাই জিতেছে সিপিআইএম। সার্টিফিকেট দেওয়া হচ্ছে না। উত্তর ২৪ পরগণা, দক্ষিণ ২৪ পরগণা, নদীয়া, পশ্চিম বর্ধমান, কুচবিহার, হাওড়া, উত্তর দিনাজপুর, হুগলীতে একই জিনিস। যেসব জায়গায় জয় সুনিশ্চিত বামপন্থীদের সেখানে প্রথম থেকে পুলিশ অত্যাচার করেছে। মানুষ যখন প্রতিবাদ করছে তখন পুলিশ তাঁদের দিকে তেড়ে যাচ্ছে। আজ কাউন্টিং-এর সময় গণনাকেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। মানুষ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছে। মানুষের এই লড়াইকে আমি অভিনন্দন জানাচ্ছি।
নতুন লড়াইয়ের ইঙ্গিত দিয়ে এদিন মহম্মদ সেলিম বলেন, আগামীকাল থেকে নতুন করে লড়াই শুরু হবে। কারণ বাংলাকে বাঁচাতে হবে। দখলদারি চলবে না। আগেই বলেছিলাম এটা ২০১৮ নয়, ২০২৩। আর আজকে বলছি, এই আষাঢ় মাসে কিন্তু বর্ষণ শেষ হবেনা। মানুষ একবার জেগেছেন, রাস্তায় নেমেছেন, তাই এই রাস্তার লড়াই জারি থাকবে। যতক্ষণ না পশ্চিমবঙ্গে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে পারবো ততক্ষণ এই লড়াই জারি থাকবে।
এদিন সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে মহম্মদ সেলিম বলেন, বাজারে বিজেপি নেই। কিন্তু হোলসেল মার্কেটে আছে। লড়াইটা হচ্ছে বামপন্থীদের নেতৃত্বে, কংগ্রেস, আইএসএফ অন্যান্য আরও অনেক শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে তৃণমূলের সঙ্গে। সেইজন্য তৃণমূলের আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দুতে বামপন্থীরাই।
অন্য এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, গোটাটাই হচ্ছে কয়লা চোর, বালি চোর, চাকরি চোর, তাঁদের তাড়ানোর জন্য মানুষের লড়াই। তৃণমূল যেভাবে সেটাকে গুন্ডা, বদমাইশ, মাফিয়া দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করছে সেভাবেই কেন্দ্রীয় সরকার এবং বিজেপি সেই একই কাজ করছে।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন